মামুন খান : ৯০ দশকের শুরু থকে ২০০৫-০৬ সাল পর্যন্ত খুলনাঞ্চলে কয়েকটি চরমপন্থী সংগঠন বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। হত্যা, চাঁদাবাজি, লুটতরাজ ছিল তখনকার নিত্যদিনের ঘটনা। এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেনী-পেশার মানুষের দিন-রাত কাটত সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে। বিএনপি-জামাত জোট সরকারের সর্বশেষ শাসনামলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের শাসনামলে পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এখন বিচ্ছিন্নভাবে সন্ত্রাস-সহিংসতা ঘটলেও আগের মতো নিষিদ্ধ চরমপন্থী দলের তৎপরতা আর নেই।
পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি, বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) জনযুদ্ধ, নিউ বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টিসহ কয়েকটি দলের বেপরোয়া সন্ত্রাসী কার্যক্রম মানুষকে দিশেহারা করে তুলেছিল। রূপসা, তেরখাদা, দিঘলিয়া, ডুমুরিয়া, ফুলতলাসহ বিভিন্ন উপজেলার গ্রামীন জনপদে ওই সব সংগঠনের শক্ত ঘাটি ছিল, যদিও এক পর্যায়ে তাদের দুবৃত্বপনার বিস্তৃতি শহরাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছিল।
বিভিন্ন পর্যায়ের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের টার্গেট করে চিঠির মাধ্যমে চাঁদা চওয়া, চাহিদা না মেটাতে পারলে খুন করা, হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ভিতীকর পরিবেশ তৈরি করে সংশ্লিষ্ট এলাকায় চাঁদাবাজির ক্ষেত্র নির্বিঘ্ন করা প্রায় নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। সর্বহারা জনগণের শ্রেণী শত্রু খতমের কথা পোস্টারে-লিফলেটে প্রচার করলেও তারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতাদের পোষ্য সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়েছিল। টাকার বিনিময়ে দুবৃত্বরা তাদের স্বার্থ হাসিল করত। খবরের কাগজে প্রায় প্রতিদিনই তাদের হাতে এক বা একাধিক খুন হওয়া মানুষের সংবাদ গুরুত্ব সহকারে ছাপা হতো। হতভাগ্যদের কেউ খুন হতো গুলিতে, কাউকে মারা হতো জবাই করে। বিভিন্ন শ্রেনী পেশার কয়েকজন প্রবীন মানুষ এবং অন্তত দেড় যুগ আগে চরমপন্থী সংগঠন থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা দু-তিন জনের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্রগুলো জানান, গ্রাম-শহরের বিভিন্ন স্থানের বেকার যুবক, বখে যাওয়া তরুন কিংবা চোর-ডাকাত অনেকেই ওই সব বাহিনিতে যোগ দিয়েছিল। তাদের হাতে-হাতে ছিল দেশি তৈরি পাইপগান, ওয়ান শ্যুটার গান, বন্দুক, রাইফেল, পিস্তল, রিভলবারসহ বিভিন্ন ধাঁরালো অস্ত্র। ছিল অত্যাধুনিক বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রও। দুবৃত্বরা আনসার ক্যাম্প হতে বেশ কিছু থ্রি নট থ্রি রাইফেলও লুট করেছিল। অন্ধকার নামতেই গ্রামে-গ্রামে তাদের বাহিনির নাশকতামূলক কার্যক্রম শুরু হতো। কখনও অধিপত্য বিস্তার নিয়ে বাহিনিতে-বাহিনিতে লড়াই চলতো। পরাজিত পক্ষ প্রতিশোধ নিতে অপর পক্ষের অবস্থান নেয়া এলাকায় হামলা চালাতো। তারা সেখানে খুন-জখমের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের বাড়ীতে লুটপাট করতো।
সূত্রমতে, বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে রাজনৈতিক পৃষ্টপোষকতায় নিষিদ্ধ চরমপন্থী ক্যাডাররা একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, খুলনা প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি ও দৈনিক জন্মভূমি এবং রাজপথের দাবী পত্রিকার সম্পাদক হুমায়ূন কবীর বালুকে তার অফিসের সামনে বোমা হামলায় হত্যা করে। চরমপন্থী সন্ত্রাসীরা এ হতাকাণ্ড সংগঠিত করে বলে আদালতের রায়ের পর্যবেক্ষনে উল্লেখ করা হয়। এর আগে আরেক প্রথিতযশা সাংবাদিক মানিক চন্দ্র সাহাকে তারা খুলনা প্রেসক্লাবের নিকটতম দূরত্বে বোমা হামলা করে খুন করে। এরপর পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি এমএল (জনযুদ্ধ) নামের নিষিদ্ধ সংগঠনের পক্ষ থেকে লিফলেটের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করা হয়েছিল। মানিক সাহাও খুলনা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি এবং একুশে পদকপ্রাপ্ত। ৯০ দশকের মাঝামাঝি খুলনা সদর থানার অদূরে জাতীয় পার্টির তৎকালীন মহানগর সাধারণ সম্পাদক ও চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবুল কাশেমকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে। কিলিং মিশনে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির দুই জন ক্যাডার অংশ নিয়েছিল বলে ওই মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খুনির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী থেকে জানা গেছে।
১৯৭১ সালে ভারতের চারু মজুমদারের অনুসারীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে নকশালবাড়ী আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দলবাজী, চাঁদা ও কর্তৃত্ব নিয়ে ভাগাভাগির দ্বন্দে তারা নানা দল ও উপ-দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল বলে জানা গেছে।
সূত্রগুলো জানান, ১৯৯১ থেকে ৯৬ সালে চরমপন্থী ক্যাডাররা চাঁদাবাজি ও লুটপাটের পাশাপাশি দক্ষিনাঞ্চলের নোনা পানির চিংড়ি ঘের মালিকদের ভাড়াটে ক্যাডার হিসেবে কাজ করেছে। ওই সময় আদালত চত্বর থেকে ফিল্মি স্টাইলে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির ক্যাডার তপন ওরফে দাদা তপনকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। এরপর তার নেতৃত্বে জনযুদ্ধ নামে আরেকটি চরমপন্থী সংগঠন আত্মপ্রকাশ করে। একসময় পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে তার মৃত্যু হয়। অন্যদিকে, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির আঞ্চলিক নেতা আব্দুর রশিদ মালিথা ওরফে তাপু খুলনার বেশ কয়েকটি উপজেলা নিয়ে তাদের সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছিল। নগরীতেও তার ক্যাডারদের তৎপরতা ছিল। তিনিও একসময় পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। এরপর ওই সংগঠনের তাত্বিক নেতা মোফাখ্খার চৌধুরী ওরফে মধু বাবু পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর বন্দুক যুদ্ধে নিহত হন। ডুমুরিয়া উপজেলার মনোরঞ্জন গোসাই ওরফে মৃণাল ৮০’র দশকে চরমপন্থী সংগঠনে যোগ দিলেও ১৫-১৬ বছর পর বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলেন। তিনি এবং তার সহযোগী আলম ভারতে পুলিশের হাতে নিহত হন।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী শাসনামলে চরমপন্থী সংগঠনের সদস্যদের অস্ত্র সমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরৎ আসার সুযোগ দেয়া হয়। তখন অনেকে অস্ত্র সমর্পণ করেন এবং সরকার তাদের আনসার বাহিনীতে চাকুরির ব্যবস্থা করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামাত ক্ষমতায় আসলে চরপন্থী সংগঠনের তৎপরতা আবারও বেড়ে যায়। যদিও এরপর তত্বাবধায়ক সরকার এবং ২০০৮ সাল হতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শাসনামলে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর তৎপরতায় খুলনায় চরমপন্থী দলগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়ে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর খুলনা জেলা কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ কামরুজ্জামান জামাল দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে একটি বাড়ী তৈরি করতে গেলেও চরমপন্থীদের চাঁদা দিতে হতো। ঠিকাদারসহ সকল ব্যবসায়ীরাও একই অবস্থায় ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নয়ন হওয়ায় চরমপন্থী দলগুলোর তৎপরতা নেই। মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরেছে। সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিতে না হওয়ায় নির্বিঘ্নে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজ এগিয়ে চলেছে।
তিনি বলেন, চরমপন্থী দলের নামে সন্ত্রাসী তৎপরতা বন্ধ হলেও ওই সব নিষিদ্ধ সংগঠনের কিছু ক্যাডার বিএনপি-জামাতের শেল্টারে আছে। তারা অবরোধ-হরতালের নামে নাশকতা চালাচ্ছে। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে তাদের শেকড় উপড়ে ফেলা হবে।
খুলনা জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ সাঈদুর রহমান-পিপিএম দৈনিক জন্মভূমিকে বলেন, চরমপন্থীদের একটি বড় অংশ আত্মসমর্পনের পর স্বাভাবিক জীবনে ফেরৎ আসে। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর পদক্ষেপের কারণে এ অঞ্চলে এখন চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের কোনো তৎপরতা নেই।