সিরাজুল ইসলাম, আশাশুনি থেকে ফিরে : সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া ইউনিয়নের খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধের ভাঙন কবলিত এলাকা গত দুই দিনেও সংস্কার করা সম্ভব হয়নি। ইতিমধ্যে ভেসে গেছে হাজার হাজার বিঘা মৎস্যঘের ও ফসলি জমি। বিধ্বস্ত হয়েছে শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি। প্লবিত হয়েছে কমবেশি প্রায় ১০টি গ্রাম।
ভাঙন কবলিত এলাকার মানুষের ঈদে নির্ঘুম রাত কাটাতে হয়েছে। বর্তমানে বেঁড়িবাধের উপর আশ্রয় নিয়েছেন তারা। গরু-ছাগল, হাস, মুরগিসহ গৃহস্থালির জিনিস পত্র নিয়ে রয়েছেন নিদারুন কষ্টে। স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে রিং বাধ দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন শেষে সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোস্তাক আহমেদ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনা অঞ্চলের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সৈয়দ শহিদুল আলম দ্রুত বেঁড়িবাধ সংস্কারের আশ্বাস দিয়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, সোমবার (৩১ মার্চ) ঈদের দিন সকাল ৯টার দিকে ঈদের নামাজ শেষে পাউবো বিভাগ-২ এর আওতাধীন ৭/২ পোল্ডারের বিছট গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন আব্দুর রহিম সরদারের মৎস্য ঘেরের কাছ থেকে প্রায় দুইশ ফুট এলাকা জুড়ে বেড়িবাঁধ হঠাৎ করেই খোলপেটুয়া নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এর ফলে আনুলিয়া ইউনিয়নবাসীর মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। স্থানীয় গ্রামবাসীরা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে দুই দফায় ভাঙ্গন পয়েন্টে বিকল্প রিংবাধ নির্মাণের চেষ্টা চালালেও তা জোয়ারের তোড়ে ব্যর্থ হয়ে যায়। গত দুই দিনেও বেড়িবাধ সংস্কার না হওয়ায় ইতিমধ্যে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ। ভেসে গেছে চার শতাধিক মৎস্য ঘেরের হাজার হাজার বিঘা জমি। তলিয়ে গেছে ৫ শতাধিক বিঘার বোরো ধান। বিধ্বস্ত হয়েছে শতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি। বিদ্যুতহীন রয়েছে সেখানকার তিনটি গ্রাম।
বাড়িঘর ছেড়ে তিন শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন অন্যত্র। অনেকেই বাড়িঘর ছাড়ার প্রস্ততি নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে পানিতে প্লাবিত হয়েছে আনুলিয়া ইউনিয়নের নয়াখালী, বিছট, বল্লবপুর, বাসুদেবপুর, আনুলিয়া, চেচুয়া, কাকবাশিয়া, মীর্জাপুরসহ আশপাশের প্রায় ১০ টি গ্রাম। প্লাবিত এলাকার মানুষ বর্তমানে কেউ কেউ বেড়িবাঁধের উপর আশ্রয় নিয়েছেন। গরু-ছাগল, হাস-মুরগিসহ গৃহাস্থলির জিনিস পত্র নিয়ে প্লাবিত অঞ্চলের মানুষ নিদারুন কষ্টের মধ্যে রয়েছে। বেড়িবাঁধ দ্রুত সংস্কার করা না হলে আনুলিয়া ইউনিয়নসহ পার্শ্ববর্তী খাজরা ও বড়দল ইউনয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশংকা করছেন স্থানীয়রা।
এদিকে, আজ (মঙ্গলবার) সকালে সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক মোহাম্মাদ মোস্তাক আহমেদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনা অঞ্চলের তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী সৈয়দ শহিদুল আলম, পানি উন্নয়ন বোর্ড-সাতক্ষীরা-১ এর নির্বাহি প্রকৌশলী মো. সাখাওয়াত হোসেন, আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী অফিসার কৃষ্ণা রায়, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রুহুল কুদ্দুসসহ স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াত এর নেতৃবৃন্দ ভাঙন কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। পরিদর্শন শেষে জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বেড়িবাঁধ দ্রুত সংস্কারের আশ্বাস দিয়েছেন।
বাংলাভিশনের গুগল নিউজ ফলো করতে ক্লিক করুন
স্থানীয়দের অভিযোগ, বাঁধ দুর্বল হয়ে পড়ার পেছনে অবৈধ পাইপলাইন ও গেট সিস্টেম অন্যতম কারণ। তারা অবিলম্বে এই পদ্ধতি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। স্থানীয়রা বাঁধ সংস্কারের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জোরালো দাবি তুলেছেন প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাছে।
স্থানীয় ইউনিয়ন বিএনপি নেতা এসএম শওকত হোসেন জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিছট গ্রামের যে স্থান বাঁধ ভেঙ্গে গেছে ওই স্থানটি দীর্ঘদিন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। ঈদের নামাজ পড়ার সময় তারা জানতে পারেন হঠাৎ বাঁধটি ধসে গ্রামের মধ্যে পানি ঢুকছে। তারা নামাজ শেষ না করেই কয়েক হাজার মানুষ এক হয়ে বাঁধটি সংস্কারের চেষ্টা করেন। কিন্তু সকাল ১১টার দিকে জোয়ারের তোড়ে তাদের সে উদ্যোগ ভেস্তে যায়। ফলে খোলপেটুয়া নদীর পানিতে একের পর এক গ্রামে পানি ঢুকতে শুরু করে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে আনুলিয়া ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ।
আনুলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা রুহুল কুদ্দুস জানান, দুপুর ও রাতের জোয়ারে ভাঙন আরও গভীর হয়েছে। এর ফলে নতুন নতুন এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জরুরি ভিত্তিতে বেড়িবাঁধ সংস্কার করা প্রয়োজন। ইতোমধ্যে পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসন, ইউএনও, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া হলে প্লাবিত এলাকার মানুষের আরো বাড়বে। তিনি আরও জানান, আমাদের এখানে বলগেট (বালু ও মাটি বহনের জাহাজ) প্রয়োজন। একটি বলগেট এসেছে, তবে এটি দিয়ে কতক্ষণ কাজ চালানো সম্ভব? আমরা আশা করছি, রাতারাতি আরও চারটি বলগেট আসবে, তারপর পুরোপুরি কাজ শুরু হবে। তবে এই ধরনের ভাঙন রোধ করতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদ জানান, আশাশুনি উপজেলার আনুলিয়া ইউনিয়নের বিছট গ্রামে খোলপেটুয়া নদীর পাশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ছিল। কিন্তু গতকাল সেটার ১০০ মিটার অংশ ভেঙে গেছে। এতে ৮ থেকে ১০টি গ্রামে পানি ঢুকেছে। আমি খবর পাওয়ার পরপরই পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জরুরি নির্দেশনা দিয়েছি। তবে ঈদের কারণে শ্রমিক সংকট ও বালু বোর্ড আনতে দেরি হওয়ায় কাজ শুরু করতে বিলম্ব হয়েছে।
তিনি আরও জানান, আমি সকালেই ঘটনাস্থলে এসে দেখেছি পরিস্থিতি ভয়াবহ। আমরা যদি দ্রুত ব্যবস্থা নিতে না পারি, তাহলে পরবর্তী জোয়ারে আরও প্রায় আধা কিলোমিটার বাঁধ ভেঙে যেতে পারে। ইতোমধ্যে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি বিভাগকে একত্রে কাজ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয়রা আমাদের সহযোগিতা করছেন, আমরা যত দ্রুত সম্ভব এই বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করছি।
আশাশুনি ভেরি বাদে ভাঙ্গন ১৫গ্রাম প্লাবিত : দায়ভার পানি উন্নয়ন বোর্ডের

Leave a comment