মাদারীপুর অফিস : অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালী যাবার সময় নৌকাডুবিতে নিহত ২৩ জনের মধ্যে ১১ জনের পরিচয় মিলেছে। তাদের বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায়। মামা-ভাগ্নেসহ নিহতের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। এই ঘটনায় জড়িত দালালদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন স্বজন ও এলাকাবাসী। পুলিশ বলছে, এ ব্যাপারে নেয়া হবে আইনগত ব্যবস্থা। আর নিহতদের লাশ দেশে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানিয়েছে প্রশাসন।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের হাসান মাতুব্বর ও কুলসুম বেগমের ছেলে টিটু হাওলাদার পরিবারের স্বচ্ছলতা ফেরাতে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালী পাড়ি জমাতে গিয়ে নৌকাডুবিতে মারা যান। মোবাইলে ছেলের মৃত্যুর ছবি দেখে সংবাদে শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ছেন তিনি। ছেলে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলে বার বার মুর্ছা যান।
নিহত টিটু হাওলাদারের মা কুলসুম বেগম বলেন, ‘আমি আমার বাবাকে চাই। আমার এই একটাই সন্তান। আমি অনেক কষ্ট করে আমার সন্তানকে বড় করেছি। আমি রফিক দালালকে ১৬ লাখ টাকা দিছি। সে বলছে, আমার ছেলে সুন্দর ভাবে পাঠাবে।’Ñএকই ভাবে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে টিটুর বাবা হাসান হাওলাদার বলেন, ‘আমি অনেক কষ্ট করে আমার ছেলেকে বড় করছি। অনেক ধার দেনা করে পাঠাই। এখন আমি কিভাবে ধার দেনা শোধ করবো। আমার ছেলে তো নাই। গতকাল দালালে আমার ছেলের লাশের ছবি পাঠাইছে। আমি এখন কী করবো’-বলে বিলাপ করতে থাকেন।-একই ভাবে শোকে স্তব্দ হয়ে আছে টিটু হাওলাদারের মামা আবুল বাশার আকনের বাড়িতেও। নিহত টিটু হাওলাদারের মামা আরেক নিহত আবুল বাশার আকনের বড় ভাই বাচ্চু আকন বলেন, ‘আমি আমার ভাই ও ভাগিনাকে হারিয়ে ফেলেছি। আমার ভাইয়ের জন্য দুই বারে দুই দালালকে ২৮ লাখ টাকা দিয়েছি। জমি জমা বিক্রি করেছি। ধার দেনা করেছি। এখন আমরা সর্বশান্ত হয়ে গেছি। সরকারের কাছে দাবী করছি, টাকা পয়সা সবই তো গেছে। এখন আমার ভাইয়ের লাশটা যদি সরকার ফিরিয়ে যেন দেয়। আর ভাগিনা টিটুর লাশটাও সরকারের কাছে ফেরত চাই। আর এই ঘটনায় জড়িত দালালদের কঠোর শাস্তি দাবি করছি।
শুধু টিটু হাওলদারের পরিবারই নয়। মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার ১১ যুবকের নৌকাডুবিতে মৃত্যুর ঘটনায় এলাকাজুড়ে চলছে শোকের মাতম।
থানা পুলিশ, জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা নিহতদের পরিচয় হলো, রাজৈর উপজেলার পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের চা বিক্রেতা হাসান হাওলাদারের ছেলে টিটু হাওলাদার, গোবিন্দপুরের বাসিন্দা আক্কাস আলী আকনের ছেলে আবুল বাশার আকন, সুন্দিকুড়ি গ্রামের নীল রতন বাড়ৈ, সাগর বাড়ৈ, একই গ্রামের মহেন্দ্র নাথ বিশ্বাসের ছেলে সাগর বিশ্বাস, গোবিন্দপুরের ফিরোজ শেখের ছেলে ইনসান শেখ ও আশিষ কীর্তনীয়া, বৌলগ্রামের নৃপেন কীর্ত্তনীয়ার ছেলে অমল কীর্ত্তনীয়া, একই গ্রামের চিত্ত সরদারের ছেলে অনুপ সরদার, শাখারপাড় গ্রামের সজিব মোল্লা, সাতবাড়িয়ার রাজীব। সবার বয়স ২০-৩০ বছরের মধ্যে।
নিহতেদর স্বজনরা জানায়, দালালদের খপ্পড়ে পড়ে গত জানুয়ারি মাসের শুরুতে ইতালীর উদ্দ্যেশে বাড়ি ছাড়ে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার সুন্ধিকুড়ি গ্রামের সাগর বিশ^াস, আশীষ কীর্তনীয়া, সাগর বাড়ৈ। শাখারপাড়ের সজীব মোল্লা, সাদবাড়িয়ার রাজীব হোসেন, বৌলগ্রামের অনুপ সরকার ও নৃপেন কীর্তনীয়া, গোবিন্দপুর গ্রামের ইনসান শেখ ও আবুল বাশার। পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের টিটু হাওলদার ও গোবিন্দপুর গ্রামের আবুল বাশার সম্পর্কে মামা-ভাগ্নে। আবুল বাশার লিবিয়া কয়েক মাসে আগেই গিয়েছিলেন। পরে যান তার ভাগ্নে টিটু হাওলাদার। গত ২৪ জানুয়ারি লিবিয়া থেকে একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকায় যাত্রা করেন তারা। মাঝপথে ভুমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে প্রাণ হারায় ২৩ জন। এরমধ্যে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার এই ১১ তরুণ।
দালালদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের আশ^াস দিয়েছে পুলিশ। আর নিহতদের লাশ দেশে ফিরিয়ে আনতে দূতাবাসের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশ প্রশাসন।
রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাসুদ হোসেন খান বলেন, আমরা ইতোমধ্যে শুনেছি লিবিয়ার ভূমধ্যসাগরে নিহত ২৩ বাংলাদেশীর মধ্যে ১১ জনেরই বাড়ি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার বাসিন্দা। আমরা নিহতদের তালিকা তৈরী করে কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাবো। যাতে লাশগুলো দেশে স্বজনদের কাছে ফেরত আসে সেই উদ্যোগ গ্রহণ করবো।
এসময় রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাসুদ হোসেন খান আরো বলেন, এই ঘটনায় রাজৈর হরিদাসদি গ্রামের স্বপন মাতুব্বর, মজুমদারকান্দি গ্রামের মনির হাওলাদার ও ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার আলীপুরের রফিকুল ইসলাম দালাল জড়িত থাকার কথা মৌখিক ভাবে শুনেছি। ঘটনার পর থেকে দেশে থাকা দালালরা আত্মগোপনে রয়েছেন। অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।