
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : লবণ বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে উৎপন্ন হয়। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে সমুদ্রের লোনা পানি দ্বারা ডিসেম্বর হতে মধ্য মে পর্যন্ত দীর্ঘকাল যাবৎ লবণ উৎপাদিত হয়ে আসছে। বর্তমানে খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলেও লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে। আগেকার মানুষ সমুদ্রের পানি কাঠের চুলায় জ্বাল দিয়ে বা রোদে শুকিয়ে (সৌর পদ্ধতিতে) লবণ উৎপাদন করতো যা নিকট অতীত পর্যন্ত চালু ছিল। ২০০০-২০০১ মৌসুম হতে নতুন পদ্ধতিতে (পলিথিন পদ্ধতি) লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে। সনাতন পদ্ধতিতে একর প্রতি লবণের উৎপাদন ছিল ১৭.২৫ মেট্রিক টন এবং নতুন পদ্ধতিতে প্রতি একরে লবণ উৎপাদিত হয় প্রায় ২১ মেট্রিক টন। নতুন পদ্ধতিতে সনাতন পদ্ধতির তুলনায় ৩৫% অধিক ও আন্তর্জাতিক মানের লবণ উৎপাদিত হয়, যা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব।
লবণ উৎপাদন প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলের একটি দেশীয় শিল্পোদ্যোগ ছিল। ‘মুলঙ্গী’ নামে খ্যাত চট্টগ্রামের এক শ্রেণির লোক অতীতকাল থেকে সমুদ্রের পানি সিদ্ধ করে লবণ উৎপাদন করত। তাদের লবণ উৎপাদন ক্ষেত্রকে ‘তোফল’ বলা হতো। মুগল আমলে ‘নিমক জায়গীর মহাল ও নিমক এয়জ মহাল’ নামক দুটি সরকারি বিভাগ এই শিল্প নিয়ন্ত্রণ করতো। নিজামপুর, জুলদিয়া ও বাহারছরা এই তিনটি চাকলার অধীনে মোট ৩৯টি লবণ সংগ্রহ ক্ষেত্র ছিল। ষোড়শ শতকে লবণ উৎপাদনকারীদের সরকারিখাতে মাশুল দিতে হতো। মুগল আমল পর্যন্ত লবণ শিল্পে সরকারের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। এর ব্যবস্থাপনা ছিল জমিদার শ্রেণীর হাতে, তারা লবণ চাষিদের দিয়ে লবণ উৎপাদন করার জন্য স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দাদন প্রদান করত। ১৭৫৭ থেকে ১৭৬৫ সালের মধ্যে অনেক ইংরেজ প্রত্যক্ষভাবে ও বেনিয়াদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে লবণ ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে।
লবণ উৎপাদনের জমি, কক্সবাজার
লবণ শিল্পে ব্রিটিশদের উদ্যোগে ১৭৬৫ সালে বণিক সমিতি গঠিত হয় এবং এতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তারা লাভবান হয়। পরবর্তীকালে ওয়ারেন হেস্টিংস লবণ শিল্পের ওপর সরকারের একচেটিয়া আধিপত্য প্রয়োগ করে লবণ আবাদের জন্য সর্বোচ্চ দরদাতাকে লবণ উৎপাদনের জমি পাঁচ বছরের জন্য লিজ দিতে শুরু করেন। ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এ পদ্ধতি রহিত হয়ে বার্ষিক চুক্তি সম্পাদিত হতে থাকে। এ পদ্ধতি ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। কোম্পানি তখন এজেন্সির মাধ্যমে সরাসরি লবণ উৎপাদন ব্যবস্থাপনায় জড়িত হয় এবং যৌথ নিলামের আয়োজন করে বাজারজাতকরণেও সম্পৃক্ত হয়। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কোম্পানির এই আধিপত্য চলতে থাকে। কোম্পানি কর্তৃক আরোপিত কর প্রশাসন, বিদেশ থেকে লবণ আমদানি এবং ভারতে লবণ উৎপাদন নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে দেশীয় লবণ শিল্পকে ধ্বংস করা হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনির শাসনের প্রথম দিকে চট্টগ্রামে ৭৯-৯৯ হাজার মণ লবণ উৎপাদিত হতো। তখন কোম্পানির কর্মচারীরা চট্টগ্রামে উৎপাদিত লবণের ব্যবসা করত। পরবর্তীকালে লিভারপুর থেকে লবণ আমদানির কারণে প্রকৃতিজাত এই শিল্পটি ধ্বংস হয়ে যায়। ব্রিটিশ সরকার সামুদ্রিক লবণ উৎপাদন করা বেআইনি ও দন্ডযোগ্য অপরাধ বলে ঘোষণা করে এবং স্বদেশী লবণের উপর অতিমাত্রায় কর আরোপ করায় এই শিল্প বন্ধ হয়ে যায়। চট্টগ্রামের বহু মুলঙ্গী পেটের দায়ে গোপনে অল্প লবণ প্রস্ত্তত করে জীবন ধারণ করত এবং ধরা পড়ে শাস্তিও ভোগ করত। এভাবে নির্যাতন চালিয়ে চট্টগ্রামের প্রাচীন লবণ শিল্পকে ধ্বংস করা হয়েছিল। বিশ শতকের ত্রিশের দশকে মহাত্মা গান্ধীর লবণ আন্দোলনের প্রভাবে লবণ উৎপাদন আবার শুরু হলেও নতুন লবণ শিল্প প্রতিষ্ঠায় ব্রিটিশদের প্রবল বিরোধিতা ছিল। ১৯৪৭-এর পর থেকে এই লবণ শিল্পটি পুনরুজ্জীবিত হলেও এখানকার উৎপাদিত লবণের উপর অধিক আবগারী শুল্ক ধার্য করায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানিকৃত খনিজ লবণের সাথে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় চট্টগ্রামে উৎপাদিত লবণ পিছনে পড়ে যায়।
১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (ইপসিক) প্রতিষ্ঠা করা হয়। যার উত্তরসুরী বর্তমানে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক)। এই প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব কর্মসূচি হিসেবে নিয়মিত জনবল দ্বারা ১৯৬০-৬১ অর্থবছর থেকে লবণ শিল্পসংক্রান্ত কার্যক্রম আরম্ভ করে এবং ১৯৮৫ সালের জুন পর্যন্ত পরিচালিত হয়। ১৯৬৪ সালে লবণ উৎপাদনকারী ইউনিটসমূহের একটি শুমারি অনুষ্ঠিত হয়। শুমারি সর্বমোট ১৬,৫৪১টি লবণ উৎপাদনকারীর ইউনিট, লবণ উৎপাদনের আওতায় মোট ১১,৭৬৯ একর জমি এবং এই শিল্পে মোট ৫০,৮৫৪ জন শ্রমিকের কর্মসংস্থান রেকর্ড করে। উৎপাদনের পরিমাণ ছিল প্রায় ০.৩ মিলিয়ন টন এবং এর মূল্যমান ছিল ২০ মিলিয়ন টাকা। লবণ উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলি ছিল চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, বরিশাল এবং খুলনা জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাসমূহ। প্রাকৃতিক জলবায়ুর তারতম্য, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এবং জমি লিজ প্রদানের শর্তাদির ওপর প্রতি বছর এর উৎপাদন ওঠা-নামা করত। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন লবণ শিল্প উন্নয়নের কাজ হাতে নেয়। এটি বাস্তবায়নের জন্য ১৩ মিলিয়ন টাকার প্রকল্প গৃহীত হয়। পরবর্তীকালে কার্যক্রম বাস্তবায়নে ইউনিসেফের কাছ থেকে ২২.৬ মিলিয়ন টাকা অর্থসাহায্য পাওয়া যায়। স্বাধীনতার আগে কখনও বাংলাদেশে লবণ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়নি। ১৯৯০ সালে ৩,৭৭৫.০০ লক্ষ (সংশোধিত) টাকা প্রাক্কলিত ব্যয় বিসিক বিশেষ উন্নয়ন ও উৎপাদন শীর্ষক ৩টি কর্মসূচি গ্রহণ করে। যার মধ্যে একটি উপ-প্রকল্প ছিল লবণ শিল্পের উন্নয়ন সম্পর্কিত এবং এর প্রাক্কলিত ব্যয় ১,১৮৯.০০ লক্ষ (সংশোধিত) টাকা। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল লবণ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, গুণগত মান বৃদ্ধি, উৎপাদনকারীদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, গবেষণা ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণ, লবণ চাষীদের উদ্বুদ্ধকরণ এবং লবণের চাহিদা, সরবরাহ ও উৎপাদন পর্যবেক্ষণ করা। প্রকল্পটি জুলাই ১৯৯০ হতে জুন ২০০০ এবং সংশোধিত জুলাই ১৯৯০ হতে জুলাই ২০০৫ পর্যন্ত সরকারি প্রকল্প হিসেবে লবণ শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে। ২০০৬-২০০৭ অর্থবছর থেকে এ প্রকল্পটি সরকারের রাজস্ব বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ প্রকল্পের কেন্দ্রগুলির অবস্থান কক্সবাজার জেলার ৭টি থানা যথা: সদর, রামু, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া, টেকনাফ এবং চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী থানা এলাকার ১২টি কেন্দ্র। লবণের স্বাভাবিক চাহিদা মেটানো এবং আপদকালীন সময়ে সরবরাহ নিশ্চিত করে দাম স্থিতিশীল রাখতে এ প্রকল্পটি ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম জেলায় ৬৭,৭৫১ একর জমিতে ৩৪,৫৫৩ জন চাষি সৌর পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন করছে। জাতীয় অর্থনীতিতে লবণ শিল্পখাত প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১২০০ কোটি টাকার অবদান রাখছে। বাংলাদেশের প্রায় ১০-১৫ লক্ষ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে লবণ শিল্পের উপর নির্ভরশীল।
সৌর পদ্ধতিতে (প্রচলিত পদ্ধতি ও মৌসুমভিত্তিক) লবণ উৎপাদন সম্পূর্ণভাবে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব। ২০০৯-২০১০ অর্থবছরে লবণের চাহিদা ১৩.৩৩ লক্ষ মেট্রিক টনের বিপরীতে ১৭.০৭ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে।
জনসংখ্যা, গবাদিপশু এবং শিল্প কারখানা বৃদ্ধির সাথে সাথে লবণের চাহিদাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। লবণের বর্ধিত চাহিদা মেটানো এবং উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করার লক্ষে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাশাপাশি বিকল্প লবণ উৎপাদন এলাকা তৈরির জন্য বিসিক ১৯৯৩-৯৫ মেয়াদে খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চলে ১৩৫.৮০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এ প্রকল্পের আওতায় খুলনা জেলার কয়রা উপজেলার মদিনাবাদ এবং দাকোপ উপজেলার বেতকাশি এবং সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বুড়ি গোয়ালিনী ও আশাশুনি উপজেলার প্রতাবনগর এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ১৮.৩২ একর জমি লিজ নিয়ে ৪টি লবণ প্রশিক্ষণ ও উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়।
দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯৯৭-২০০২ মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য ১৯৫ লক্ষ টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। তৃতীয় পর্যায়ে জুলাই ২০০৫ হতে ২০০৮ এবং সর্বশেষ জুন ২০০৯ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ে প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ২৮৮ লক্ষ টাকা। এখানে পর্যায়ক্রমে ৩০,০০০ একর জমি লবণ চাষের আওতায় আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া পটুয়াখালী, বরগুনা, বাগেরহাটের সমুদ্র উপকুলীয় এলাকা ছাড়াও নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ, হাতিয়া ও সদ্বীপ এলাকা পরীক্ষামূলকভাবে লবণ চাষের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে।
ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার হতাশা নিয়ে লবণ চাষ শুরু করেছেন চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার চাষিরা। জমিতে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি জমিয়ে তাতে সূর্যের তাপ দিয়ে পানি শুকিয়ে তৈরি হয় লবণ। এ উপজেলার বঙ্গোপসাগরে উপকূল বেষ্টিত বিভিন্ন ইউনিয়নে লবণ উৎপাদনে ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। সবেমাত্র এ জায়গার চিংড়িঘের গুটিয়ে মাঠ তৈরি করে লবণ উৎপাদন করছেন তারা। লবণ চাষের সাফল্যকে পুঁজি করে এ বছরও চাষিরা পুরোদমে কাজ করে যাচ্ছেন। বিগত অর্থ বছরগুলোতে লবণের ব্যাপক হারে দাম পাওয়ায় চাষিরা এবারও লবণ উৎপাদন করতে উৎসাহ পেয়েছেন। ফলে মজুতকৃত লবণ বিক্রির পাশাপাশি লবণমাঠ তৈরিরও ধুম পড়েছে। বিগত দিনের মজুতকৃত লবণগুলো ৫ থেকে ৬ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। অথচ এ লবণ এখন খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকার বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। বিগত বছরগুলোতে প্রতি কানি (৪০ শতক) জমি ৩ থেকে ৪ হাজার টাকায় লাগিয়ত নেওয়া যেত। প্রতি কানিতে চাষাবাদে খরচ পড়ে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। এতে লাভ হয় খরচের দ্বিগুণ। তবে বর্তমানে প্রতি কানি জমিতে লাগিয়ত ১৫ হাজার টাকার পরও খরচ হয় পলিথিন ৬ হাজার, পানি সেচ ৪ হাজার ও মজুরি ৩০ হাজার টাকা। এতে প্রতি কানিতে খরচ পড়ে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। প্রতি কানিতে ৩০০ মণ লবণ উৎপাদন হয়। কিন্তু কম দামে বেচে চাষিরা হতাশায় ভোগেন। প্রতি মণ লবণ উৎপাদনে ২৫০ টাকার বেশি খরচ হলেও চাষিরা প্রথমে ৩০০ ও পরবর্তীতে ২৬০ টাকা থেকে ২৮০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হন। এতে খরচ এবং লভাংশ প্রায় সমান সমান। এতে চাষিরা লবণের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তবুও চাষিদের মজুতকৃত লবণ বিক্রির ধুম পড়েছে। প্রথম দিকে চাষিরা প্রতিমণ লবণ ২৯০ থেকে ৩৩০ টাকায় বিক্রি করেছেন। তবে পরবর্তীতে ধীরে ধীরে কমে আসবে। দেশের কক্সবাজার এবং খুলনার পর চট্টগ্রামের একমাত্র বাঁশখালীতেই লবণ উৎপাদন হয়। বাঁশখালীতে ছনুয়া, সেখেরখীল, গ-ামারা, সরল, পশ্চিম মনকিচর, কাথরিয়া, খানখানাবাদ, পুঁইছুড়ি (আংশিক) এলাকার লবণ উৎপাদনে অগ্রগামী। চাহিদা কম থাকায় বেশ কিছু ব্যবসায়ী লবণ মজুত করে রাখেন। এ লবণের দাম তেমন না বাড়লেও চাষিরা মজুতকৃত লবণ বিক্রির করতে মেতে উঠেছেন। সরেজমিন গত মঙ্গলবার উপজেলার গ-ামারা, ছনুয়া, সরল, শেখেরখীল ইউনিয়নের এলাকা পরির্দশনকালে চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ তিন ইউনিয়নে কয়েক হাজার একর মাঠজুড়ে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যে ব্যস্ত সময় পার করছে অর্ধশতাধিক চাষি পরিবার। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চাষিদের অন্য কোনো কাজ করার সময় থাকে না। তবে আবহাওয়া অনুকূল থাকায় গত উৎপাদন মৌসুমে প্রচুর পরিমাণ লবণ উৎপাদন হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে মজুত রয়েছে বিপুল পরিমাণ লবণ। ডিসেম্বর মাস থেকে শুরু হয়ে মে পর্যন্ত লবণ উৎপাদন অব্যাহত থাকে। উপকূলের অধিকাংশ মানুষের লবণ চাষে আগ্রহ থাকলেও নায্যমূল্য না পাওয়ায় তারা হতাশ হয়ে পড়েন। উপকূলের উপজেলাতে দুই ধরনের পদ্ধতিতে লবণ উৎপাদন হয়। বর্তমানে সরকার লবণচাষিদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য বিদেশ থেকে লবণ আমদানি বন্ধ করে দেওয়ায় চাষিরা পূর্ণ শ্রম লবণ মাঠে লাগাচ্ছেন। বাঁশখালীতে উৎপাদিত লবণ বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সারা দেশে বাজারজাত করা হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) বাঁশখালীর উপকূলীয় এলাকায় নিজস্ব তদারকির মাধ্যমে লবণ উৎপাদন ও বাজারজাত করে। ছনুয়া খুদুকখালী এলাকার চাষি রেজাউল করিম বলেন, আমি প্রতি বছর ১২ কানি জমিতে লবণ চাষ করি। প্রতি কানি জমিতে পলিথিন ৬ হাজার, পানি সেচ ৪ হাজার, মজুরি ৩০ হাজার ও জমির লাগিয়ত ২০ হাজার টাকা খরচ করি। প্রতি কানিতে খরচ হয় ৬০ হাজার টাকা। লবণ উৎপাদন হয় কানিতে ৩০০ মণ। আমরা প্রতি মণ বিক্রি করি মাত্র ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা। খরচ আর উৎপাদনে তেমন কোনো লাভ হয় না। গতবছর ১২ কানি জমিতে ৪ লাখ টাকা লোকসান ছিল। বিদেশি লবণের কারণে স্থানীয় চাষিরা লবণের দাম পান না। বর্তমানে লোকসানের কারণে বহু চাষি লবণ উৎপাদনে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। সরল এলাকার চাষি ইয়াছিন, শাহেদ, মোজাফ্ফর, আরিফ, খালেদ জানান, লবণের চাষ এবারও প্রতি বছরের মতো খুব ভালো হবে বলে আশা করি। সরকার যদি বাঁশখালীর উপকূলীয় এলাকায় উৎপাদিত এসব লবণ দেশের সর্বত্র সরবরাহ করতে সহযোগিতা করে, তাহলে এখানকার লবণ চাষিরা আরও বেশি উপকৃত হবেন। তারা এ লবণ শিল্প রক্ষা এবং মানসম্মত লবণ উৎপাদনে সরকারকে আরও বেশি মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান। বাঁশখালীর গন্ডামারা এলাকার বিশিষ্ট লবণ ব্যবসায়ী আবু আহমদ বলেন, বাঁশখালীতে যে লবণ উৎপাদন হয় তা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হলে দেশের চাহিদা পূরণ করে বাইরেও রপ্তানি করা যাবে। কিন্তু কিছু ব্যবসায়ী ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধির জন্য বাইরে থেকে লবণ আমদানি করে দেশে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। বর্তমান সরকার তা কঠোর হস্তে দমন করায় বাঁশখালীতে বর্তমানে অর্ধলক্ষাধিক চািষ লবণের ন্যায্যমূল্য ও পরিশ্রমের যথাযথ মর্যাদা পাবেন বলে আশায় বুক বেঁধেছেন। এ ব্যাপারে লবণ ব্যবসায়ী আনিছুর আলী বলেন, লবণ চাষের জন্য প্রথমে জমিকে ছোট ছোট ভাগ করে নেওয়া হয়। এরপর ভেজা মাটিকে রোলার দিয়ে সমান করে বিছিয়ে দেওয়া হয় মোটা পলিথিন। জোয়ার এলেই মাঠের মাঝখানে তৈরি করা গর্তে জমানো হয় সাগরের লবণ পানি। বালতি ভরে বিছানো পলিথিনের উপর রাখা হয় পানি। রোদে জলীয় বাষ্প হয়ে উড়ে যায় পানি। ফলে মাঠে জমে লবণের আস্তরণ। সে লবণ তুলে স্তূপ করে রাখা হলে অবশিষ্ট পানি সরে যায়। পূর্বের চেয়ে বেড়ে এখন লবণের দাম মণপ্রতি ২৯০ থেকে ৩৩০ টাকা পর্যন্ত রয়েছে। দাম বৃদ্ধি না হলেও চাষিরা তাদের মজুতকৃত লবণ বিক্রি করছেন। সামনে এ দাম না পাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। তাই তারা তাদের মজুদ লবণ তড়িগড়ি বিক্রি করে দিচ্ছেন। ছনুয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ বলেন, এ এলাকার অধিকাংশ মানুষ লবণ চাষ করেন। যুগ যুগ ধরে এ ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষ কম খরচে বেশি লাভ পাওয়ার আশায় লবণ চাষ করে থাকেন। এ ইউনিয়নটি লবণ শিল্পে সমৃদ্ধ বললেও চলে। বর্তমানে আমার ইউনিয়নের অধিকাংশ চাষি ন্যায্যমূল্য পাবেন আশায় লবণের মাঠে রাত-দিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
তাপপ্রবাহে পুড়ছে দেশ। ক্ষতির মুখে পড়েছে নানা ধরনের ফল-ফসল। তাই বৃষ্টির আশায় চাতক পাখির মতো আকাশের পানে চেয়ে আছে দেশের বেশিরভাগ মানুষ। কিন্তু উল্টো চিত্র কক্সবাজারের লবণচাষিদের। চলমান তাপপ্রবাহ তাদের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। মৌসুমের এখনো ১৭ দিন বাকি থাকলেও ইতিমধ্যেই সর্বোচ্চ লবণ উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে সেখানে। তাই তীব্র গরম উপেক্ষা করেই উপকূলের লবণচাষিরা মাঠে স্বাভাবিকভাবে কাজ করছেন।
কক্সবাজার বিসিক সূত্র জানায়, চলতি লবণ মৌসুমে কক্সবাজারের আট উপজেলা ও চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে চাষকৃত মোট লবণ জমির পরিমাণ ৬৮ হাজার ৩৫৭ একর। গত বছর ছিল ৬৬ হাজার ৪২৪ একর। গত বছরের তুলনায় এ বছর লবণ চাষের জমি বৃদ্ধি পেয়েছে ১ হাজার ৯৩৩ একর। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে চলতি বৈশাখ মাসের শেষ দিন পর্যন্ত লবণ উৎপাদন অব্যাহত থাকতে পারে। অবশ্য চলতি মৌসুমে (২৮ এপ্রিল পর্যন্ত) ২২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৫৮ টন লবণ উৎপাদন হয়েছে; যা গত সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। এর আগে গত বছর (২০২২-২৩ অর্থবছর) সবচেয়ে বেশি লবণ উৎপাদন হয়েছিল। সে সময় পর্যন্ত সর্বোচ্চ উৎপাদনের রেকর্ড ছিল ২২ লাখ ৩২ হাজার ৮৯০ টন।
চলতি মৌসুমে বেড়েছে লবণচাষির সংখ্যাও। এবার ৪০ হাজার ৬৯৫ জন চাষি লবণ উৎপাদন করছেন, যা গত বছর ছিল ৩৯ হাজার ৪৬৭ জন।
কক্সবাজার বিসিকের তথ্যানুযায়ী, চলতি মৌসুমে (১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত পাঁচ মাস) কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, চকরিয়া, টেকনাফ, ঈদগাঁও, রামু ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের (বিসিক) কক্সবাজার কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক মুহাম্মদ রিদুয়ানুর রশিদ জানান, গত কয়েক দিন কক্সবাজার উপকূলের লবণ চাষ এলাকায় দৈনিক ৩০-৩৫ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হচ্ছে। গত মৌসুমে এ সময়ে দৈনিক সর্বোচ্চ উৎপাদন ছিল ৩০ হাজার মেট্রিক টন। এবার মৌসুমের সর্বোচ্চ লবণ উৎপাদন হয়েছে গত তিন-চার দিন।
পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া ইউনিয়নের লবণচাষি মো. হুমায়ান কবির বলছেন, ১০-১৫ দিন এমন অবস্থা বিরাজ করলে ৭ থেকে ৮ লাখ মেট্রিক টন লবণ (দৈনিক ৩০-৩৫ হাজার টন ধরে) উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘তাপপ্রবাহ আমাদের লবণচাষিদের আশীর্বাদে পরিণত হয়েছে। কিন্তু কোনো কারণে কালবৈশাখীর তান্ডব কিংবা বৃষ্টি হলে লবণ উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। এক দিনের বৃষ্টিতে প্রায় এক সপ্তাহ লবণ উৎপাদন বন্ধ থাকে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কক্সবাজার জেলার পেকুয়া, কুতুবদিয়া, সদর উপজেলা, ঈদগাঁও, টেকনাফ, চকরিয়া উপজেলার বিভিন্ন উপকূলে চলতি সপ্তাহ জুড়ে মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৩৮০ টাকায়। পরিবহন ও ঘাটের টোল পরিশোধে মণপ্রতি খরচ পড়ে ৩০-৪০ টাকা। এতে প্রান্তিক পর্যায়ের চাষিরা মণপ্রতি লবণের দাম পাচ্ছেন ৩০০ টাকা করে।
কুতুবদিয়া উপজেলার উত্তর ধুরং ইউনিয়নের লবণচাষি মো. সাহেদ বলেন, ‘তীব্র তাপপ্রবাহ চলমান থাকলেও আমাদের মাঝে কোনো দুঃখ নেই। এখন যেভাবে চলছে তা আরও কিছু দিন বিদ্যমান থাকলে চাষিরা লাভের মুখ দেখবেন বলে আশা রাখছি।’
মহেশখালীর মাতারবাড়ী এলাকার লবণচাষি জসিম উদ্দিন ও পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়নের লবণচাষি আলাউদ্দিন বলেন, তীব্র গরমে লবণের বাম্পার উৎপাদন হচ্ছে। দুই দিন পরপর লবণ ওঠানো যাচ্ছে। তীব্র গরমে লবণের ভালো উৎপাদন হয় আর লবণের দানাও ভালো হয়।
কক্সবাজার উপকূলীয় লবণচাষি সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব রেজাউল করিম জানান, তীব্র তাপপ্রবাহে প্রান্তিক পর্যায়ের চাষিরা কষ্ট করে লবণ উৎপাদন অব্যাহত রাখলেও মাঠপর্যায়ে লবণের দাম একটি সিন্ডিকেটের কবজায়। তারাই লবণের দাম একেক সময় একেক রকম নির্ধারণ করে। চলতি লবণ মৌসুমের শুরুতে গত ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে ৫০০ টাকা মণ লবণ বিক্রি হয়েছে। দাম ভালো পাওয়ায় কয়েক বছর চাষ ছেড়ে দেওয়া অনেকেই আগ্রহ নিয়ে মাঠে নামে। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারিতে হঠাৎ প্রতি মণ লবণের দাম এসে দাঁড়ায় ৩০০-৪০০ টাকায়। চাষিদের দাবি ছিল, মাঠপর্যায়ে প্রতি মণ লবণের দাম পুরো মৌসুম জুড়ে ৫০০ টাকা নির্ধারণ থাকুক। কিন্তু দালাল ফড়িয়াদের কারণে মাঠপর্যায়ে চাষিরা ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না।
মৌসুম শেষ হওয়ার সপ্তাহ দুয়েক বাকি থাকতেই এবার লবণের উৎপাদন ৬৩ বছরের আগের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে; উপকূলের ৬৮ হাজার ৩৫৭ একর জমিতে এখন পর্যন্ত উৎপাদন হয়েছে ২২ লাখ ৩৯ হাজার মেট্রিক টন। বৃষ্টিবিহীন বাকি দিনগুলো পাওয়া গেলে উৎপাদিত হবে আরও অন্তত ৪ থেকে ৫ লাখ মেট্রিক টন লবণ। এরই মধ্যে লবণ উৎপাদনে রেকর্ড করেছেন প্রান্তিক চাষিরা। বাণিজ্যিকভাবে লবণ চাষে গত ৬৩ বছরে ২২ লাখ ৭২ হাজার মেট্রিক টন লবণ কখনো উৎপাদিত হয়নি। সর্বশেষ ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি ২২ লাখ ৩২ হাজার ৮৯০ মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হয়েছিল।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) তথ্য অনুযায়ী, জেলাতে বাণিজ্যিক লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছিল ১৯৬০ সালে। চলতি মৌসুমে (১৫ নভেম্বর থেকে ১৫ মে পর্যন্ত পাঁচ মাস) জেলার টেকনাফ, কক্সবাজার সদর, পেকুয়া, মহেশখালী, ঈদগাঁও, চকরিয়া, কুতুবদিয়া ও বাঁশখালীতে ৬৮ হাজার ৩৫৭ একর জমিতে লবণ চাষ হচ্ছে। ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত লবণ উৎপাদিত হয়েছে ২২ লাখ ৭২ হাজার মেট্রিক টন। গত মৌসুমে এই সময়ে উৎপাদিত হয়েছিল প্রায় ২১ লাখ ৭৫ হাজার মেট্রিক টন। এ হিসাবে চলতি মৌসুমে গত মৌসুমের তুলনায় এ পর্যন্ত ৬৪ হাজার মেট্রিক টন লবণ বেশি উৎপাদন হয়েছে।
বিসিকের কক্সবাজার লবণ শিল্পের উন্নয়ন কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া বলেন, মৌসুমজুড়ে দাবদাহ, ৬৮ হাজার ৩৫৭ একর জমির শতভাগে আধুনিক পলিথিন প্রযুক্তিতে চাষবাদ এবং অতিরিক্ত ১ হাজার ৯৩৩ একরের বেশি জমিতে লবণ চাষের কারণে উৎপাদনে নতুন রেকর্ড হয়েছে।
বিসিক লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, ২০২০ সালে যখন লবণনীতি করা হয়, তখন দেশে লবণের বার্ষিক চাহিদা ২৩ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হয়েছিল। চলতি মৌসুমে দেশের লবণের চাহিদা ২৫ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন।
মো. ইদ্রিস আলী বলেন, একদিকে যেমন ৬৩ বছরের মধ্যে এবার রেকর্ড লবণ উৎপাদন হয়েছে ঠিক তেমনি দৈনিক গড়ে লবণ উৎপাদন হচ্ছে রেকর্ড পরিমান। আগে যেখানে দৈনিক গড়ে সর্বোচ্চ ৩৬ হাজার মেট্রিক টন লবণ হয়েছে সেখানে এই রেকর্ড ছাড়িয়ে চলতি মৌসুমে দৈনিক গড়ে ৩৯ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদন হচ্ছে। আশা করি, যদি দাবদাহ আর কিছুদিন থাকে তাহলে দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি লবণ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে।
টেকনাফের সাবরাং, শাহপরীরদ্বীপ, হ্নীলা ইউনিয়নের রঙিখালী, খারাংখালী, সিকদারপাড়া, কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল, চৌফলদন্ডী, পিএমখালী এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, উৎপাদিত লবণচাষিরা মাঠের ওপর স্তূপ করে রেখেছেন। কেউ কেউ বাড়িঘরের আঙিনায় মজুত করে তার ওপর পলিথিন বিছিয়ে দিচ্ছেন। আবার অনেকেই লবণ মাঠে গর্ত করে পলিথিন বিছিয়ে লবণ মজুদ করছেন।
চৌফলদন্ড এলাকার চাষি গিয়াস ও খুরুশকুলের চাষি ইদ্রিস বলেন, এখন প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। কয়েক দিন পর অর্থাৎ বৃষ্টি হলেই লবণের মৌসুম শেষ হবে। তখন প্রতি মণ লবণের দাম আরও ১০০ টাকা বেড়ে যেতে পারে। প্রতি মণ লবণ তখন ৪০০ টাকা বা তার চেয়ে বেশি টাকায় বিক্রি হবে এই আশায় চাষিরা লবণ মজুত করছেন।
হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রাশেদ মোহাম্মদ আলী বলেন, টানা দাবদাহ পরিস্থিতিতে লবণের বাম্পার উৎপাদন হচ্ছে। তবে লবণের দাম কমে গেছে। এখন প্রতি মণ লবণ ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে মৌসুমের শুরুতেই সর্বোচ্চ ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিলো।
কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, বাণিজ্যিকভাবে লবণ উৎপাদন শুরুর ৬৩ বছরে এবার চাষিরা লবণ উৎপাদনে যে সাফল্যে দেখিয়েছেন, অতীতে এমনটা আর হয়নি। সরকারের নানামুখী উদ্যোগের ফলে চাষিরা লবণ মাঠে ফিরেছে এবং দামও ভালো পাওয়ায় চলতি মৌসুমে রেকর্ড লবণ উৎপাদিত হয়েছে।
এদিকে বিসিকের জনসংযোগ কর্মকর্তা পারুল আক্তার কেয়া স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপিতে বলা হয়েছে; জাতীয় লবণনীতি, ২০২২ অনুযায়ী শিল্প মন্ত্রণালয়ের দিকনির্দেশনায় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প কর্পোরেশন (বিসিক) লবণ শিল্পের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতেগড়া প্রতিষ্ঠান বিসিকের মাধ্যমেই ১৯৬১ সাল থেকে দেশে পরিকল্পিতভাবে লবণ উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে কক্সবাজারে অবস্থিত বিসিকের লবণ শিল্পের উন্নয়ন কর্মসূচি কার্যালয়ের আওতাধীন ১২টি লবণ কেন্দ্রের মাধ্যমে কক্সবাজার জেলার সকল উপজেলায় এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে লবণ চাষের জন্য লবণ চাষিদের প্রশিক্ষণ, ঋণ প্রদান এবং প্রযুক্তি সম্প্রসারণসহ সার্বিক সহায়তা প্রদান করা হয়।
বিগত ৬২ বছরের মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে লবণ উৎপাদনের সর্বোচ্চ রেকর্ড ছিল ২২ লক্ষ ৩২ হাজার ৮৯০ মে.টন। চলতি লবণ মৌসুমের ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত ২২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৫৮ মে.টন লবণ উৎপাদনের মাধ্যমে বিগত বছরের সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে এবং লবণ উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে। চলতি লবণ মৌসুমে লবণ চাষকৃত মোট জমির পরিমাণ ৬৮ হাজার ৩৫৭ একর, গত বছর ছিল ৬৬ হাজার ৪২৪ একর। গত বছরের তুলনায় এ বছর লবণ চাষের জমি বৃদ্ধি পেয়েছে ১ হাজার ৯৩৩ একর। চলতি লবণ মৌসুমে লবণ চাষির সংখ্যা ৪০ হাজার ৬৯৫ জন, যা গত বছর ছিল ৩৯ হাজার ৪৬৭ জন। গত বছরের তুলনায় এ বছর লবণ চাষির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১ হাজার ২২৮ জন। বর্তমানে লবণ মাঠ পর্যায়ে মণপ্রতি ক্রুড লবণের গড় মূল্য ৩১২ টাকা, যা গত বছর ছিল ৪২০ টাকা।
শিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজার জেলার চৌফলদন্ডী এলাকায় লবণ মাঠ পরিদর্শন করেন এবং লবণ চাষিদের সাথে মতবিনিময় করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতি সংরক্ষণ ও দেশে লবণ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজরিত স্থানে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লবণ গবেষণা ইনস্টিটিটিউট’ স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

