একশ চল্লিশ এক, একশ চল্লিশ দুই। একশ পঞ্চাশ এক, একশ পঞ্চাশ দুই, একশ পঞ্চাশ তিন। এভাবে নিলাম প্রক্রিয়া শেষ হলো। একশ পঞ্চাশ টাকা কেজি দরে স্থানীয় মাছ উৎপাদনকারী আলমগীর তাঁর ঘেরের ৬৬ কেজি গ্রাসকার্প আজ ডুমুরিয়া ভিলেজ মার্কেটে নিলামের মাধ্যমে বিক্রি করলেন। সুন্দর পরিবেশ আর সঠিক ওজনে মাছ বিক্রি করতে পেরে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করলেন।
যুগ যুগ ধরে কৃষকের ফসল ফলানো স্বপ্নগুলো হোঁচট খেয়েছে বাজারের কাছে এসে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য আর বঞ্চনার এই পথে দাঁড়িয়ে সবসময় কৃষক চেয়েছে একটি বাজার। যেখানে তাঁর সিদ্ধান্তের মূল্য থাকবে। থাকবে না দফায় দফায় হাত বদলের রীতি। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সলিডারিডাডের প্রকল্প ‘সফল’ দেখিয়েছে কৃষকের সেই স্বপ্নপূরণ। ডুমুরিয়া ভিলেজ মার্কেট (ভিএসএম) উপক‚লীয় এলাকার জেলাগুলোর কৃষকের বঞ্চনা দূর করে সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে।
এই ভিলেজ মার্কেট এলাকার কৃষক, যাঁরা ফুল, ফল, ফসল, দুধ আর মাছ উৎপাদন করেন তাঁরা মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে না গিয়ে সরাসরি তাঁদের উৎপাদিত পণ্যটি বিক্রির সুযোগ পাবেন। এখানে তাঁর পণ্যের নিলাম হবে। পরে এসব মালামাল দেশের বিভিন্ন বাজার, সুপারশপ অথবা খোলাবাজারে চলে যাবে। পৃথিবীর আধুনিকতম কৃষিপণ্যের বাজারগুলোকে সামনে রেখে গড়ে তোলা হয়েছে এই বাজার।
উন্নত বিশ্বের কৃষি বাজারের ধারণা নিয়ে খুলনার ডুমুরিয়ায় গড়ে উঠেছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও সুবিধা সম্বলিত কৃষিপণ্যের বাজার ভিলেজ সুপার মার্কেট (ভিএসএম)। দেশে প্রথমবারের মতো চালু হওয়া এই বাজারে পণ্যের গুণগত মান সুরক্ষা, বাছাই, সংরক্ষণ, উন্নত প্যাকেজিং ও বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা পরিকল্পিতভাবে রাখা হয়েছে। ভিলেজ সুপার মার্কেটে পণ্যের ন্যায্য দামও পাচ্ছেন চাষীরা।
মার্কেটটিতে সুযোগ সুবিধার মধ্যে রয়েছে ডিপো, ১০ হাজার লিটার উৎপাদন ক্ষমতার চিলার, আইস ফ্যাক্টরি, মসজিদ, ইলেকট্রিক্যাল ম্যাকানিক্যাল রুম, হর্টি কালচার প্রসেসিং জোন, হর্টি প্যাকেজিং জোন, এ্যাকোয়া প্রসেসিং জোন, একোয়া প্যাকেজিং জোন, একোয়া আড়ৎ, হর্টি আড়ৎ, ব্যাংকিং সুবিধা, চাইল্ড কেয়ার সেন্টার, ফার্মার ট্রেনিং সেন্টার, অফিস সিকিউরিটি রুম, টয়লেট জোন। দুগ্ধ খামারীদের নিয়মিত পরামর্শ দেয়ার জন্য রয়েছে ভেটেরিনারি সার্জন। ব্যাংক এশিয়ার একটি ছোট্ট শাখা নিয়মিত লেনদেনে সহযোগিতা করছে।
২০১৫ সালে খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার টিপনা গ্রামে ভিলেজ সুপার মার্কেট নামের এ মার্কেটটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয় ইন্টারন্যাশনাল এনজিও সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়া। উদ্যোগটি বাস্তবায়নে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে মার্কেটির আনুষ্ঠানিক কাজ শুরু হয়। ২০১৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বর তারিখে মার্কেটটি পরীক্ষামূলকভাবে যাত্রা শুরু করে।
মার্কেটের ভবনের গম্বুজাকৃতি ছাদটিতে অর্ধ স্বচ্ছ বিশেষ উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে। যার ফলে প্রাকৃতিকভাবে আলোর সরবরাহ থাকে । সেইসাথে তাপও বিকিরণ করে না। এর ফলে স্বাভাবিক তাপমাত্রা বজায় থাকে এবং শাকসবজি দীর্ঘ সময় তাজা থাকে । এর যে কোন জায়গায় দাঁড়ালে প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর বাতাসের প্রবাহ অনুভ‚ত হবে অর্থাৎ পণ্যের গুণগত মান বজায় থাকবে প্রাকৃতিকভাবেই। বাছাই, সংরক্ষণ, উন্নত প্যাকেজিং আর বাজারজাতকরণের সব রকম সুবিধা কৃষকরা এখানে পাবেন। এখানে ডিজিটাল পরিমাপের ব্যবস্থা থাকায় কৃষক তাঁর পণ্যের প্রকৃত ওজন পাচ্ছেন। যেটা খোলা বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে বিক্রি করলে কৃষকরা ওজনে বঞ্চিত হতেন। কারণ খোলা বাজারে এখনও সেকেলে দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করে ওজনে কারচুপির আশঙ্কা থাকে।
কৃষকরা তাঁদের দুধের কোয়ালিটি অনুযায়ী মূল্য পেয়ে থাকেন। দুধ কত দামে বিক্রি করতে পারবেন তা নির্ধারণ করা হয় দুধের গুণগত মান অনুযায়ী। অর্থাৎ দুধে কতটা পানি মিশ্রিত আছে, ল্যাকটোজের পরিমাণ এবং ক্রিমের ওপর। ভিএসএম চিলিং পয়েন্টে দুধ নিয়ে আসার জন্য দুধ প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানি কৃষকদেরকে কেজি প্রতি অতিরিক্ত এক টাকা ৭০ পয়সা কমিশন দিয়ে থাকেন যাতে কৃষক তাঁর পরিবহন খরচ বহন করতে পারেন।
মৎস্য ব্যবসায়ীরা তাঁদের মাছের উন্নতমানের প্যাকেজিংয়ের সুবিধার সাথে নিরাপদ পানি দিয়ে তৈরি বরফ ব্যবহার করতে পারেন । যার ফলে মাছ থাকবে জীবাণুমুক্ত। উন্নত প্যাকেজিং ও পরিবহনের সুবিধা পাবেন সবজি ক্রেতা-বিক্রেতারাও।
সুপারশপের মালিকরা এই কেন্দ্র থেকে একই সাথে বহু রকম পণ্য হাত বদল ব্যতিরেকে কেনার সুযোগ পাবেন বলে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। দক্ষিণ এশিয়ায় মধ্যস্বত্বভোগী ছাড়া একটি প্রাতিষ্ঠানিক বাজার গড়ে উঠলো ডুমুরিয়ার টিপনায়। এই বাজার স¤প্রসারিত হবে দেশব্যাপী এমনটা আশা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
খুলনা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, একটি সুষ্টু ব্যবস্থাপনার জন্য কৃষি বিভাগ, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসন, ভিলেজ সুপার মার্কেট সর্বোপরি কৃষকদের সাথে নিয়ে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে। এর ফলে এই বাজারটি ব্যবহারে কৃষকরা আরও আগ্রহ দেখাবেন।
খুলনা জেলার বাজার কর্মকর্তা আব্দুস সালাম তরফদার জানান, কৃষকরা এখনও বিচ্ছিন্নভাবে তাঁদের পণ্য খোলা বাজারে বিক্রি করে নানাভাবে প্রতারিত হচ্ছেন। কৃষকরা যাতে প্রতারিত না হয়ে উপযুক্ত মূল্য এবং সঠিক ওজনে তাঁদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির সুযোগ পান তার প্রচার অব্যাহত রেখেছি।
কৃষক হানিফ মোড়ল ও বিকাশ মন্ডলসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা জানান, মার্কেটটির কারণে কৃষকদের সরাসরি পণ্য বিক্রির অবাধ সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ অঞ্চলের কৃষকদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে এবং জীবন-যাত্রার মান উন্নত হবে। স্থানীয় অর্থনীতিতেও বড় ধরনের ভ‚মিকা রাখবে।
‘সফল’ প্রকল্পের কমোডিটি ম্যানেজার ড. নাজমুন নাহার বলেন, মার্কেটটি থেকে খুলনা ও সাতক্ষীরা এলাকার তৃণমূল কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে সরাসরি কৃষি পণ্য (ফল-মূল, শাক-সবজি, দুধ, মাছ ইত্যাদি) ক্রয় করে দেশের বিভাগীয় শহরগুলোয় এবং আগোরাসহ অন্যান্য সুপার শপে বিক্রির উদ্দেশ্য রয়েছে। পর্যায়ক্রমে বিদেশেও রপ্তানি করা হবে।
তিনি আরো বলেন, এই মার্কেটকে কেন্দ্র করে কৃষকদেরকে আধুনিক উৎপাদন পদ্ধতির কলাকৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করে এখানকার উৎপাদন ব্যবস্থা আরো সক্রিয় এবং জোরদার করা হবে। ফলে প্রকৃতপক্ষে কৃষকরাই লাভবান হবেন এমন প্রত্যাশা রয়েছে। কৃষকরা যাতে কোনোভাবেই প্রতারিত ও ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত না হন এবং ভিএসএম ভালোভাবে পরিচালিত হয় সেজন্য বিভিন্ন এনজিও প্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী ও কৃষক প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এই ট্রাস্টি বোর্ডের মাধ্যমে একটি দক্ষ কর্মী বাহিনী দিয়ে ভিএসএম এর দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এছাড়া এ মার্কেটে মধ্যস্বত্বভোগীদের কোনো স্থান নেই।
ভিলেজ মার্কেটের অস্থায়ী মৎস্য আড়ৎ কমিটির আহŸায়ক মাহমুদুর রহমান বলেন, আমরা এখানে সুন্দর পরিবেশে ব্যবসা করতে চাই। তবে ক্রেতারা বেশি সুযোগের আশায় যেখানে পুরনো ওজন পদ্ধতিতে মালামাল বিক্রি হয় সেখানে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। আমাদের দাবি, ঐ সকল এলাকায় ডিজিটাল পরিমাপ ব্যবস্থা চালু করা হোক। আমরা আমাদের ৪০ কেজি পণ্য ৪০ কেজি হিসেবেই বিক্রি করতে চাই। বাজারটি সম্পর্কে আরও প্রচারণা বাড়াতে পারলে কৃষকরা এখানে তাঁদের পণ্য বিক্রিতে আগ্রহ দেখাবেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের আনাচে-কানাচে এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদী না রাখার আহŸান জানিয়েছেন। কৃষকরা সেই কাজটি তাঁদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে প্রতিনিয়ত করে যাচ্ছেন। ডুমুরিয়া ভিলেজ সুপার মার্কেটের মতো বাজারের স¤প্রসারণ ঘটাতে পারলে কৃষকরা তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের ভাল মূল্য পাবেন এবং কৃষিকাজে অন্যদেরও আগ্রহ তৈরি হবে। এরফলে আমাদের কৃষিঅর্থনীতি আরও চাঙ্গা হবে।
লেখক: উপপ্রধান তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, খুলনা।