সিরাজুল ইসলাম শ্যামনগর : ঈদুল আজহা মুসলিম উম্মাহর দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব। প্রতি বছর জিলহজ মাসের ১০ তারিখে পালিত হয় এ উৎসব। ঈদুল আজহার অন্যতম অনুষঙ্গ কোরবানি। কোরবানি আরবি ও ফারসি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ ত্যাগ বা নৈকট্য। আত্মত্যাগের দুরূহ ও কঠিন পথ পেরিয়েই মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ সম্ভব।
কোরবানির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইবরাহিম (আ.)-এর স্মৃতি। ইবরাহিম (আ.) ত্যাগের পরীক্ষার চূড়ান্ত পর্বে নিজের সন্তানের গলায় তীক্ষè খঞ্জর চালিয়েছিলেন। তার কাজ আল্লাহর কাছে এতই প্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, কিয়ামত পর্যন্ত সব সামর্থ্যবান মুসলমানের ওপর সেই ইবরাহিম (আ.)-এর স্মৃতির অনুসরণে কোরবানি করা ওয়াজিব। তাই কোরবানি শুধু মোটাতাজা জন্তু জবাইয়ের মহড়া নয়। কোরবানি শুধু উৎসব-আনন্দে, ভোগ-বিলাসিতায় গা ভাসিয়ে দেওয়া নয়। কোরবানি হলো, আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের বিন্ম্র প্রকাশ।
কোরবানি যাদের ওপর ওয়াজিব
কোরবানি মুসলিম উম্মাহর একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি শাআইরে ইসলাম তথা ইসলামের প্রতীকী বিধানাবলির অন্যতম। রাসুল (সা.) প্রতি বছর কোরবানি করতেন। যাদের ওপর জাকাত ওয়াজিব, তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব। এতে গরিব-দুঃখী ও পাড়া-প্রতিবেশীর আপ্যায়নের ব্যবস্থা হয়।
কোরবানিতে আল্লাহ ও তার রাসুলের শর্তহীন আনুগত্যের শিক্ষা রয়েছে। এতে আল্লাহর ভালোবাসায় নিজের সব চাহিদা ও যুক্তি কোরবানি (ত্যাগ) করার শিক্ষা রয়েছে। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে রাসুল! আপনি বলুন, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মরণ বিশ্বজাহানের পালনকর্তা আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত।’ (সুরা আনআম, আয়াত : ১৬২)
প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন মুসলিম নর-নারী, যে কোরবানির দিনগুলোতে সাড়ে সাত ভরি সোনা, সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপা বা ওই পরিমাণ রুপার সমমূল্যের নগদ অর্থ অথবা বর্তমানে বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজনে আসে না এমন জমি, প্রয়োজনাতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও প্রয়োজনাতিরিক্ত অন্য আসবাবপত্রের মালিক হবে, তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। (রদ্দুল মুহতার : ৬/৬৫)
আর সোনা বা রুপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নিসাব পরিমাণ না থাকে, কিন্তু প্রয়োজনাতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার সমমূল্যের হয়ে যায়, তাহলেও তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। যেমন কারও কাছে কিছু স্বর্ণ ও কিছু টাকা আছে, যা সর্বমোট সাড়ে বায়ান্ন ভরি রুপার মূল্যের সমান, তাহলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। (রদ্দুল মুহতার : ৫/২১৯)
কোরবানির নিসাব পূর্ণ হওয়ার জন্য জাকাতের মতো সম্পদের বর্ষ অতিক্রম হওয়া শর্ত নয়, শুধু কোরবানির তিন দিন নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়াই যথেষ্ট। এমনকি ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বক্ষণেও নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়ে গেলে কোরবানি ওয়াজিব হবে। (বাদায়েউস সানায়ে : ৫/৬২)
অনেকের ওপর জাকাত ওয়াজিব নয়, কিন্তু তারা ঋণ করে হলেও কোরবানি করে থাকেন, এমনটি অনুচিত।
এ ধরনের কারও কারও মনের অভিব্যক্তি হলো, ‘কোরবানির দিন আমার সন্তান কার মুখের দিকে চেয়ে থাকবে।’ এমন চিন্তা থেকে কোরবানি করলে কোরবানি হবে না, গোশত খাওয়া হবে।
কোরবানি মূলত ধনীদের ইবাদত, যেভাবে জাকাত ও হজ ধনীদের ইবাদত। ধনীদের মধ্যে পাপাচারের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। হতে পারে, এজন্য তাদের বিশেষ ইবাদতের বিধান দেওয়া হয়েছে, যাতে তারাও পাপমুক্ত জীবনে ফিরে আসতে পারে।
একান্নভুক্ত পরিবারের মধ্যে একাধিক ব্যক্তির কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে তাদের প্রত্যেকের ওপর ভিন্ন ভিন্ন কোরবানি ওয়াজিব। (কিফায়াতুল মুফতি : ৮/১৭৮)
শরিকে কোরবানি করলে গোশত ওজন করে বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েজ নেই। তবে হাড্ডি-মাথা ইত্যাদি যেসব অংশ সাধারণত সমানভাবে ভাগ করা যায় না, সেগুলো অনুমান করে ভাগ করা যাবে। এতে সামান্য কমবেশি হলে সমস্যা নেই। (ফাতাওয়া কাজিখান : ৩/৩৫১)
কোরবানি বিশুদ্ধ হওয়ার শর্তাবলি
কোরবানি একটি ইবাদত। সুতরাং এটি যেন খাঁটি আল্লাহতায়ালার উদ্দেশেই হয়, অন্য কোনো উদ্দেশ্য যেন মুখ্য না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। তা না হলে তা আল্লাহর কাছে কোরবানি গৃহীত হবে না। অংশীদারদের কারও নিয়ত যদি পরিশুদ্ধ না থাকে কিংবা তার অর্থ যদি হালাল না হয়, তাহলে বাকিদের কোরবানিও নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং যাচাই-বাছাই করে অংশীদার নির্বাচন করতে হবে।
ভুলে গেলে চলবে না যে, নিজের ধন প্রদর্শন ও বিত্তের মহড়া দেওয়ার জন্য কোরবানি দিলে কোরবানি হবে না।
দ্বিতীয়ত, অর্থকড়ি হালাল হওয়া। হারাম অর্থের ইবাদত শুদ্ধ হবে না। হারাম অর্থের দ্বারা সওয়াবের আশা করাও গুনাহর কাজ। হালাল অর্থ দিয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী ছোটখাটো পশুর ব্যবস্থা করেও আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায়। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, আল্লাহর কাছে কোরবানির পশুর না গোশত পৌঁছায়, না রক্ত পৌঁছায়; বরং তার কাছে পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া।’ (সুরা হজ, আয়াত : ৩৭)
কোরবানির পশুর বৈশিষ্ট্য
কোরবানির জন্তু : উট, গরু, মহিষ, দুম্বা, ভেড়া ও ছাগল দ্বারা কোরবানি করা জায়েজ। অন্যান্য জন্তু দ্বারা কোরবানি নাজায়েজ। ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার বয়স কমপক্ষে এক বছর পূর্ণ হতে হবে, গরু-মহিষ দুই বছর পূর্ণ হতে হবে, উট পাঁচ বছর পূর্ণ হতে হবে। (হিদায়া, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা : ১০৩)
কোরবানির পশু হতে হবে দোষত্রুটিমুক্ত। পশুর মধ্যে যেসব ত্রুটি থাকলে কোরবানি দেওয়া যাবে না, সেগুলো হচ্ছে : ১. দৃষ্টিশক্তি না থাকা, ২. শ্রবণশক্তি না থাকা, ৩. অত্যন্ত দুর্বল ও জীর্ণ-শীর্ণ হওয়া, ৪. এই পরিমাণ লেংড়া যে জবাই করার স্থান পর্যন্ত হেঁটে যেতে অক্ষম, ৫. লেজের বেশির ভাগ অংশ কাটা, ৬. জন্মগতভাবে কান না থাকা, ৭. কানের বেশির ভাগ কাটা, ৮. গোড়াসহ শিং উপড়ে যাওয়া, ৯. পাগল হওয়ার কারণে ঘাস-পানি ঠিকমতো না খাওয়া, ১০. বেশির ভাগ দাঁত না থাকা, ১১. রোগের কারণে স্তনের দুধ শুকিয়ে যাওয়া, ১২. ছাগলের দুটি দুধের যেকোনো একটি কাটা, ১৩. গরু বা মহিষের চারটি দুধের যেকোনো দুটি কাটা। মোটকথা, কোরবানির পশু বড় ধরনের দোষত্রুটি থেকে মুক্ত হবে। যেমন হাদিসে এসেছে, ‘চার ধরনের পশু, যা দিয়ে কোরবানি জায়েজ হবে না। অন্ধ যার অন্ধত্ব স্পষ্ট, রোগাক্রান্ত– যার রোগ স্পষ্ট, পঙ্গু– যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট ও আহত– যার কোনো অঙ্গ ভেঙে গেছে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩১৪৪)
পশুর মধ্যে যেসব ত্রুটি থাকলেও কোরবানি দেওয়া যাবে, সেগুলো হচ্ছে : ১. পশু পাগল, তবে ঘাস-পানি ঠিকমতো খায়; ২. লেজ বা কানের কিছু অংশ কাটা, তবে বেশির ভাগ অংশ আছে; ৩. জন্মগতভাবে শিং নেই, ৪. শিং আছে, তবে ভাঙা; ৫. কান আছে, তবে ছোট; ৬. পশুর একটি পা ভাঙা, তবে তিন পা দিয়ে সে চলতে পারে; ৭. পশুর গায়ে চর্মরোগ, ৮. কিছু দাঁত নেই, তবে বেশির ভাগ আছে। স্বভাবগত এক অণ্ডকোষের পশু; ৯. পশু বয়োবৃদ্ধ হওয়ার কারণে বাচ্চা জন্মদানে অক্ষম, ১০. পুরুষাঙ্গ কেটে যাওয়ার কারণে সঙ্গমে অক্ষম। তবে উত্তম হচ্ছে ত্রুটিমুক্ত পশু দিয়ে কোরবানি দেওয়া, ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারা কোরবানি দেওয়া অনুচিত।
উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদি পশু দ্বারা কোরবানি দিতে হয়। উট কমপক্ষে পাঁচ বছরের হতে হবে। গরু-মহিষ কমপক্ষে দুই বছরের হতে হবে। ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে এক বছরের হতে হবে। অবশ্য ছয় মাসের ভেড়া যদি দেখতে মোটাতাজা হয় এবং এক বছর বয়সের মতো মনে হয়, তাহলে তা দিয়েই কোরবানি বৈধ। ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ইত্যাদির ক্ষেত্রে একটি পশু শুধু এক ব্যক্তিই কোরবানি দিতে পারবে। গরু, মহিষ, উট সর্বোচ্চ সাত ব্যক্তি মিলে কোরবানি দিতে পারবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘একটি উট ও গরু-মহিষে সাত ব্যক্তি কোরবানির জন্য শরিক হতে পারে।’
কোরবানি যাদের জন্য প্রযোজ্য

Leave a comment