
হুমায়ুন কবীর রিন্টু , নড়াইল : নড়াইলের কৃতি সন্তান শিল্পী বিমানেশ বিশ্বাস। যিনি শুধু এলাকায় নয়, সারাদেশে একজন গুণি শিল্পী হিসেবে পরিচিত। তারঁ গুরু বিশ্ব বরেণ্য চিত্র শিল্পী এস এম সুলতান। সুলতানের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজ বাড়িতে তথা নড়াইল শহরের কুড়িগ্রামে ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন গ্রামীন শিশুদের জন্য অবৈতনিক আর্ট স্কুল ‘শিল্পাঞ্জলি’। খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী বিমানেশ বিশ্বাস’র সাথে আলাপকালে তিনি জানান, তাঁর গুরু এসএম সুলতান কে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। তাঁর কাছ থেকে সরাসরি অনেক শিক্ষা পেয়েছেন। তিনি দেখেছেন শিল্পী সুলতান কিভাবে শিশুদেও এবং জীবজন্তুুদের সেবা করেন। তাঁর থেকে পাওয়া শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে তিনি গ্রমীণ শিশু শিক্ষার্থীদের মাঝে চিত্রকলা পৌছে দিতে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
তিনি অনুভব করেছেন গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ প্রাইমারি ও মাধ্যমিক স্কুলগুলিতে চারুকলার কোন শিক্ষক নেই। তাই গ্রামীন শিশুদের জন্য অবৈতনিক আর্ট স্কুল শিল্পাঞ্জলি প্রতিষ্ঠা করেন। শিল্পী সুলতান চাইতেন তাঁর শিশুরা যেন পরিপূর্ণ শিক্ষায় বেড়ে উঠে।
২০১৬ সালে শিল্পাঞ্জলি’র স্থানীয় ও আদীবাসি জনগোষ্ঠীর শিশু-কিশোর চিত্রশিল্পীরা ২,০০০ ফুট কাগজে মোম রং দিয়ে শুরু করে ব্যতিক্রমী এক বৃহৎ চিত্রকর্ম। এই চিত্র ও নকসা শিশু কিশোর শিল্পীরা একটানা ৫ বছর এঁকেছে। চিত্রকর্মটির দৈর্ঘ্য ২,০০০ ফুট, প্রস্থ ৩ ফুট, মোট ৬,০০০ বর্গফুট। তাঁর প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় নড়াইল অঞ্চলের শিশুশিল্পীরা শুধু ছবি আঁকেনি। তারা নিজেদের জীবনের গল্প, গ্রামের অপরূপ দৃশ্য, নকসা, বিভিন্ন খেলাধুলা, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান, ঈদের নামাজ, প্রকৃতি ও সংস্কৃতিকে রঙের ভাষায় প্রকাশ করেছে।
এ চিত্রকলার দীর্ঘ যাত্রায় শিল্পীর সহধর্মিণী মমতা বিশ্বাস আদীবাসি জনগোষ্ঠীর শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য মাঝে মধ্যে আহারের ব্যবস্থা করে কাজটিকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। যা একটি সামাজিক সহমর্মিতার দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। মমতা বিশ্বাস বলেন, এই শিশুরা নিজের সন্তানের মতো। সৃষ্টিকর্তার কৃপা ছিল বলেই, তাদেরকে সেবা দেয়ার চেষ্টা করেছেন মাত্র।
২০১৮ সালে শিল্পাঞ্জলি’র শিশু-কিশোর চিত্রশিল্পীদের অংকিত বিশাল এই চিত্রটির ৪০০ ফুট অংশ ডিজিটাল প্যানা প্রিন্টে রূপ দেয়া হয়। এরপর শুরু হয় নড়াইল ও যশোরের প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের প্রাইমারি ও মাধ্যমিক স্কুলগুলিতে শিল্পাঞ্জলি’র ক্ষুদে শিল্পীদেও অংকিত বড়চিত্রের ভ্রাম্যমাণ প্রদর্শনী। এ পর্যন্ত যেসব প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ভ্রাম্যমাণ শিশুচিত্র প্রদর্শনী হয়েছে সে গুলির মধ্যে রয়েছে আগদিয়া, মালিয়াট, ভবানীপুর, টাবরা, গোবরা, গুয়াখোলা, বাকড়ী, সীতারামপুর, মুশুড়ি, বাহিরগ্রাম, মুলিয়া ও হিজলডাঙ্গা। উল্লেখ্য এসব গ্রামাঞ্চলের প্রাইমারি ও মাধ্যমিক স্কুল মিলে মোট ২৭টি স্কুলে শিল্পাঞ্জলি’র শিশুশিল্পীদের অঙ্কিত বড় চিত্রের ডিজিটাল প্যানা প্রদর্শিত হয়েছে।
শিল্পাঞ্জলি অবৈতনিক আর্ট স্কুলের চিত্রাঙ্কন শিক্ষক ও স্বেচ্ছাসেবক, শিল্পী সৌমিত্র মোস্তবী (খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলায় এম.এফ.এ অধ্যায়নরত) বলেন, ডিজিটাল প্রিন্টিং প্যানেল রোল করা, গ্রামের স্কুলে স্কুলে যাওয়া, এসবই কঠিন কাজ ছিল। কিন্তু আমাদের শিল্পাঞ্জলি’র শিশু চিত্রশিল্পীদের আঁকা এ চিত্র স্কুলের শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক সহ গ্রামের বিভিন্ন শ্রেনী পেশার মানুষ যেভাবে অবাক হয়ে দেখেছেন, তাতে করে সব পরিশ্রমই আমাদের সার্থক মনে হয়েছে।
শিল্পাঞ্জলি স্বেচ্ছাসেবক, সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী মাসুম জব্বারী বলেন, গ্রামের নানা শ্রেনী পেশার মানুষ ও ২৭টি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, অভিভাবক সহ প্রায় ১০ হাজার মানুষ এ ভ্রাম্যমাণ শিশু চিত্রকলা প্রদর্শনী দেখেছে। এ চিত্রকলা গ্রামের শিশুদের মধ্যে শিল্পবোধ জাগানোর পাশাপাশি চারুকলার প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলেছে।
বাংলাদেশে গ্রামীন অবৈতনিক চারুকলা আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস.এম সুলতান। ১৯৫১-৫২ সালে চাচুড়িয়-পুরুলিয়া গ্রামে জঙ্গল পরিষ্কার করে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শিশুদের জন্য অবৈতনিক আর্ট স্কুল “নন্দন কানন” (বর্তমানে চাচুড়িয়া-পুরুলিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়)। শিল্পী এসএম সুলতান ১৯৬৫ সালে নড়াইল জমিদার বাড়ির শিব মন্দিরে গড়ে তুলেছিলেন আরেকটি আর্ট স্কুল। এর ঠিক তিন বছর পরে ১৯৬৮ সালে নড়াইলের কুড়িগ্রামে ইনষ্টিটিউট অফ ফাইন আর্টস্ শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার ডক্টর এনাম আহমেদ চৌধুরী এ ইনষ্টিটিউট অফ ফাইন আর্টস্ উদ্বোধন করেন। এ ইনষ্টিটিউট অফ ফাইন আর্টস্ প্রথম দিকের ছাত্র ছিলেন র্নিমল সাহা, বিনয় সরকার, বিধান রায়, আলী আশরাফ সিদ্দিকী, গোবিন্দ রায়, শিল্পী বিমানেশ বিশ্বাস প্রমুখ। পরবর্তীতে শিল্পী বিমানেশ বিশ্বাস ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত শিল্পী এস.এম সুলতানের ইনষ্টিটিউট অফ ফাইন আর্টস্ নড়াইল ও যশোর অঞ্চলে ড্রইং এর খন্ডকালিন শিক্ষক হিসাবে স্বেচ্ছাশ্রম ক্লাস নিয়েছেন।
২০১৫ সাল থেকে শিল্পী বিমানেশ বিশ্বাস নিয়মিতভাবে গ্রামের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বেসিক আর্ট-টেকনিক, রঙের ব্যবহার, কম্পোজিশন ও কল্পনাধারাকে কেন্দ্র করে স্বেচ্ছাশ্রম ড্রইং ক্লাস নিয়েছেন। তাকে যে স্কুলগুলোতে স্বেচ্ছাশ্রম ক্লাস নিতে দেখা গেছে সেগুলো মধ্যে রয়েছে, আগদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, আরবিএফএম ভবানীপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, গুয়াখোলা মাধ্যমিক স্কুল, গোবরা পার্ব্বতী বিদ্যাপীঠ, শিবশংকর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রয়েল একাডেমি মাছিমদিয়া, প্রবর্তন প্রতিবন্ধী কেন্দ্র, প্রতিবন্ধী স্কুল (খালিশপুর, খুলনা), প্রতিবন্ধী স্কুল (উজিরপুর, নড়াইল), মাতৃসদন (জমিদার বাড়ী, নড়াইল), বিড়গ্রাম, সাতঘরিয়া, বনগ্রাম, নাকসী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এছাড়া কিন্ডারগার্ডেন এর শিক্ষকদের ৪ মাস ব্যাপী ড্রয়িং কোচিং করিয়েছেন।
শিল্পী এস.এম সুলতানের আদর্শিক “কর্ম দর্শন” বিমানেশ বিশ্বাসকে দীর্ঘ-দিন ধরে নাড়া দিয়েছে। সুলতান বিশ্বাস করতেন চারুকলা গ্রামের কৃষক পরিবারের স্কুলেপড়া ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য, চিত্রকলা শহরের দেয়ালের ভেতরে সীমাবদ্ধ নয়। সেই দর্শনকে সামনে রেখেই শিল্পী বিমানেশ বিশ্বাস চারুকলাকে নিয়ে গেছেন মাঠে, নদীর ধারে, আদিবাসী পল্লীর আঙিনায়, গ্রামীন শিশু শিক্ষার্থীদের কাছে। সুলতানের ধারার উত্তরসূরি শিল্পী বিমানেশ বিশ্বাস ২০০৪ সালে নড়াইল শিবশংকর বালিকা বিদ্যালয় মাঠে শুরু করেন দেশের প্রথম অবৈতনিক ভ্রাম্যমাণ আর্ট স্কুল। যেখানে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর শিশুরাই ছিল মূল অংশগ্রহণকারী। ২০১২ সাল থেকে তিনি নড়াইল, যশোর ও খুলনার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে প্রতিষ্ঠা করেন শিল্পাঞ্জলি (অবৈতনিক) ভ্রাম্যমাণ আর্ট স্কুল। যা শিল্পী সুলতানের চারুকলার অবৈতনিক চর্চাকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেয়ার ঐতিহাসিক চারুকলা আন্দোলনের একটি শক্তিশালী পর্ব।
শিল্পী বিমানেশ বিশ্বাস গত দু’যুগেরও বেশি সময় ধরে নড়াইল, যশোর ও খুলনার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে গড়ে তুলেছেন মোট ১৬টি অবৈতনিক ভ্রাম্যমাণ আর্ট স্কুল। যেখানে আঁকা শেখার জন্য কোনো ফি লাগে না। লাগে শুধু জানার আগ্রহ। আর স্বপ্ন দেখার সাহস। বিমানেশ বিশ্বাস গ্রামীন শিশুদের সবচেয়ে কাছে গিয়ে তৈরি করেছেন চিত্রকলা চর্চার ছোট ছোট মঞ্চ। কোনোটি মন্দির চত্বরে, কোনোটি বৃদ্ধা আশ্রমে। কোথাও আবার মন্দিরের বারান্দা বা গ্রামের উঠানে। গ্রামের শিশু শিক্ষার্থীদের কাছে এই অবৈতনিক আর্ট স্কুল যেন তাদের স্বপ্নবাড়ি ।
শিল্পী বিমানেশ বিশ্বাসের প্রতিষ্ঠিত শিল্পাঞ্জলি অবৈতনিক ভ্রাম্যমান আর্ট স্কুলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বেতবাড়িয়া মন্দির আর্ট স্কুল, বড়েন্দার পঞ্চমন্দির আর্ট স্কুল, চন্ডিতলা পালবাড়ী মন্দির আর্ট স্কুল, নড়াইল জেলখানা গেট আর্ট স্কুল, আগদিয়া বৃদ্ধা আশ্রম আর্ট স্কুল, গোবরা শৈলেন সাহা বাড়ি সংলগ্ন মন্দির আর্ট স্কুল, খুলনার বটিয়াঘাটা হাটবাটি আর্ট স্কুল, বাকড়ি আর্ট স্কুল, আগদিয়া মহাশ্মশান আর্ট স্কুল, গার্মেন্টস স্কুল বড়েন্দার, ইচড়বাহা আর্ট স্কুল, পংকবিলা মন্দির আর্ট স্কুল, সর্বমঙ্গলা মন্দির (নড়াইল জমিদার বাড়ী) আর্ট স্কুল, হাটবাড়িয়া মন্দির আর্ট স্কুল, মুলিয়া আনন্দ মার্গ আর্ট স্কুল ও সীতারামপুর মন্দির আর্ট স্কুল। এসব প্রতিষ্ঠানের শিশু শিক্ষার্থীদের আশার আলো দেখিয়েছেন চিত্রশিল্পী বিমানেশ বিশ্বাস।

