
সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : একটা সময় গরুর দুধ বিক্রি করে ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতাম, এখন সেই গরু নেই, ঘাস নেই, খাবার কিনে খাওয়ানোরও সামর্থ্য নেই” সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের খামারি আব্দুল খালেকের এই কথাগুলো যেন গোটা উপকূলীয় জনপদের কৃষি ও গবাদিপশু খাতের করুণ
“একটা সময় গরুর দুধ বিক্রি করে ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতাম, এখন সেই গরু নেই, ঘাস নেই, খাবার কিনে খাওয়ানোরও সামর্থ্য নেই” সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের খামারি আব্দুল খালেকের এই কথাগুলো যেন গোটা উপকূলীয় জনপদের কৃষি ও গবাদিপশু খাতের করুণ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। একসময় ছয়টি গরু নিয়ে একটি ছোট খামার চালালেও, আজ তার গোয়ালঘর ফাঁকা পড়ে আছে। শুধু আব্দুল খালেক নন, সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালীসহ দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলজুড়ে হাজারো খামারির মুখে এখন একই দীর্ঘশ্বাস।
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চল বহুদিন ধরেই কৃষি ও প্রাণিসম্পদের নির্ভরযোগ্য কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের অব্যাহত অভিঘাত এই অঞ্চলের প্রাণিসম্পদ খাতকে চরম সংকটে ফেলে দিয়েছে। ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, বেড়িবাঁধ ভেঙে লবণাক্ত পানি প্রবেশ—এসবই মাটির উর্বরতা ও তাজা পানির উৎস নষ্ট করে দিয়েছে। ফলে গো-খাদ্য উৎপাদনের পরিবেশ একরকম বিলীন হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (ইঅজঈ) গবেষণা বলছে, সাতক্ষীরার শ্যামনগর, খুলনার দাকোপ ও কয়রা, বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ, পাথরঘাটা, বরগুনা ও পটুয়াখালীর বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে মাটির লবণাক্ততা ৮ থেকে ১২ ডিএস/মি-তে পৌঁছেছে, যা পশু খাদ্য চাষের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। আগে যেখানে আঙিনা বা মাঠে ঘাস জন্মাতো, এখন সেখানে লবণাক্ত মাটিতে ঘাসের বীজও টেকে না। বিকল্প হিসেবে খামারিদের বাইরে থেকে কিনে আনতে হচ্ছে খড়, কুঁড়া, ভুসি। অথচ এসব খাবারের দাম গত কয়েক বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। একসময় যে খড় প্রতি হাজার ৮০০ থেকে ১০০০ টাকায় মিলত, এখন সেটি ৫০০০ টাকাতেও দুষ্প্রাপ্য। ফলে আয় না বাড়লেও খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ, খামার চালানো হয়ে উঠেছে অসম্ভব।
শুধু খাদ্য সংকটই নয়, পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে গবাদিপশুর স্বাস্থ্যেও মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। অতিরিক্ত আর্দ্রতা, তাপমাত্রার চরমতা, বিশুদ্ধ পানির সংকট ইত্যাদি কারণে গরু-মহিষে নিউমোনিয়া, চর্মরোগ, ডায়েরিয়া, হাড়ক্ষয়সহ নানা রোগের প্রকোপ বেড়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, উপকূলীয় জেলাগুলোতে গত পাঁচ বছরে গবাদিপশুর রোগবালাই ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। অথচ একজন ভেটেরিনারি কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকে তিন-চারটি ইউনিয়ন, যা দিয়ে পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা দেওয়া কার্যত অসম্ভব।
এই সংকট শুধুমাত্র অর্থনৈতিক নয়, এটি সামাজিক এবং সাংস্কৃতিকভাবেও এক গভীর ক্ষয়িষ্ণুতা ডেকে আনছে। গরু ও মহিষ একসময় শুধু কৃষিকাজের সহায়ক ছিল না, তারা ছিল গ্রামের পরিবারেরই অংশ। দুধ বিক্রি করে চলত সন্তানদের লেখাপড়া, খাল-বিলের পাড়ে চরে বেড়ানো গরুর পাল ছিল গ্রামের চিরচেনা দৃশ্য। আজ অনেকেই গবাদিপশু বিক্রি করে ক্ষুদ্র ব্যবসা, দিনমজুরি কিংবা শহরমুখী পেশায় ঝুঁকছেন। কেউ কেউ এনজিওর সহায়তায় হাঁস-মুরগি পালনের দিকে আগ্রহী হচ্ছেন, কিন্তু সেটিও দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না।
দৈনিক ইনকিলাবের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, উপকূলের প্রায় ৪০ শতাংশ জমিতে বছরে মাত্র একটি চাষ হয়। মাটির লবণাক্ততা বাড়তে থাকলে কৃষি ও প্রাণিসম্পদের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠবে। পরিবেশবিজ্ঞানী ড. নাসির উদ্দিন এই সংকট থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে পরামর্শ দিয়েছেন লবণাক্ততা সহনশীল ঘাস ও উন্নত জাতের পশুর বিস্তার এবং বৈজ্ঞানিক খামার ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের। তিনি বলেন, “লবণাক্ত অঞ্চলে পুরনো পদ্ধতিতে পশু পালন করলে চলবে না, বিজ্ঞানভিত্তিক উপায় ছাড়া গবাদিপশু খাত রক্ষা সম্ভব নয়।”
যদিও গণমাধ্যমে উপকূলীয় সংকট এখন প্রায়শই উঠে আসছে, তবু জাতীয় পর্যায়ে এর দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে এখনো দৃশ্যমান কোনো সুপরিকল্পিত উদ্যোগ নেই। কয়েকটি ক্ষুদ্র প্রকল্প, কিছু এনজিওর কার্যক্রম বা সামান্য ভ্যাকসিন বিতরণ দিয়ে এই সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয়। প্রয়োজন স্থানীয় পর্যায়ে খামারিদের জন্য প্রণোদনা, ক্ষতিপূরণ, পশু চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্প্রসারণ এবং লবণাক্ততা সহনশীল খাদ্য ও খামার ব্যবস্থাপনার বাস্তবায়ন।
গবাদিপশু খাত কেবল মাংস বা দুধ উৎপাদনের উৎস নয় এটি লাখো মানুষের জীবিকা, গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণ এবং আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। জলবায়ু পরিবর্তনের ঢেউ আমরা থামাতে পারব না, কিন্তু এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিতে পারি। আজ যদি আমরা এই উদ্যোগ না নেই, তাহলে কাল হয়তো হারিয়ে যাবে উপকূলের গরুর হালের ঘণ্টাধ্বনি, বিলের ধারে চরতে থাকা মহিষের পাল, কিংবা গ্রামের শিশুর মুখের সেই দুধের হাসি।