
ডেস্ক রিপোর্ট : জাতীয় সংসদের সব আসনের প্রার্থী ঠিক করে নির্বাচনী প্রস্তুতি এবং আসনভিত্তিক তৎপরতা শুরু করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটির এবারের প্রার্থী তালিকার ৮০ শতাংশই নতুন, যাঁরা এর আগে কখনো নির্বাচন করেননি। আর অতীতে নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা রয়েছে, এমন প্রার্থী রয়েছেন ৫৯ জন। দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যমে এমন তথ্য উঠে আসে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, অতীতে জামায়াতে প্রবীণ নেতৃত্বের আধিপত্য ছিল। কিন্তু এবার পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে। ৩৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সী তরুণ নেতৃত্ব সামনে আনার চেষ্টা করছে দলটি।
জামায়াত সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের শুরু থেকে ধাপে ধাপে দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে দলটি। দুটি আসন গাজীপুর-৬ ও নরসিংদী-৫ বাকি ছিল; সেগুলোতেও মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। জেলা-উপজেলার নেতাদের ভোট এবং কেন্দ্রীয় মনোনয়ন বোর্ডের মাধ্যমে প্রার্থী ঠিক করা হয়। দলীয়ভাবে এটাকে প্রাথমিক মনোনয়ন বলা হলেও, এসব প্রার্থী নির্বাচনী এলাকায় কাজ শুরু করেছেন।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে একটা সমঝোতার বিষয়ে আলোচনা চলমান রয়েছে। নির্বাচনী সমঝোতা বা জোটের বিষয়টি চূড়ান্ত হলে কিছু আসন থেকে প্রার্থী সরিয়ে নেওয়া হবে।
দলীয় সূত্রগুলো আরও বলছে, প্রার্থী ঘোষণার আগে জামায়াত অনেক কিছু যাচাই-বাছাই করে, এরপর প্রার্থীর মাঠের অবস্থান বিবেচনা করে। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ বা কেলেঙ্কারির মতো কোনো ঘটনা না থাকলে সাধারণত মনোনয়ন প্রত্যাহার করা হয় না। তাই প্রাথমিক তালিকা থেকে খুব বেশি বাদ পড়ার সম্ভাবনা কম।
প্রার্থীদের ৮০ ভাগের এর আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা নেই। তবে জামায়াতের নেতাদের দাবি, প্রার্থী নতুন হলেও যোগ্যতা ও প্রচারের মাধ্যমে জনসমর্থন আদায় করা সম্ভব।
এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আমরা প্রাথমিক তালিকা দিয়েছি। এরা তরুণ এবং শিক্ষিত। নির্বাচনের যে সময়টা আছে, এর মধ্যে তারা মানুষের মন জয় করতে পারবে বলে আমি আশাবাদী।’
এসব প্রার্থীর অধিকাংশই যোগ্য দাবি করে সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের বলেন, ‘জামায়াতের প্রতি মানুষের একটা সিম্প্যাথি (সহানুভূতি) তৈরি হয়েছে। মানুষ এটা বলছে, দুই বড় দলকে দেখেছি, এখন তৃতীয় বড় দলটাকে দেখি। একবার জামায়াতকে দেখি। এগুলো তো ইতিবাচক সিগন্যাল (সাড়া)। আশা করি, নির্বাচনে আমরা ভালোই করব।’
নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আছে যাঁদের
জামায়াত ঘোষিত প্রার্থীদের মধ্যে বিগত সময়ে নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদ সদস্য হয়েছেন ৯ জন। প্রার্থীদের মধ্যে আগে নির্বাচনের অভিজ্ঞতা রয়েছে ৫৯ জনের। এর মধ্যে ৯ জনের দুইয়ের অধিক সংসদ নির্বাচনে, ১৫ জনের দুটি সংসদ নির্বাচনে এবং বাকিদের একটি সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
১৯৯১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত জামায়াত যে কটি নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, সব কটি নির্বাচনে দলটির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন মাওলানা আবদুল হাকিম। তাঁকে এবারও ঠাকুরগাঁও-২ আসনের প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
রংপুর-২ আসনে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন এ টি এম আজহারুল ইসলাম। কারামুক্তির পর তাঁকে এবারও একই আসন থেকে প্রার্থী করার ঘোষণা দিয়েছে জামায়াত।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার খুলনা-৫ থেকে নির্বাচন করতে পারেন। তিনি ২০০১ সালে এ আসন থেকে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন।
পঞ্চম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা–১২ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সংসদ সদস্য হন সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের। এবারও তিনি কুমিল্লা-১১ থেকে নির্বাচন করবেন।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কক্সবাজার-২ আসন থেকে নির্বাচিত হন। এবারও একই আসনে প্রার্থী হবেন।
২০০১ সালে চট্টগ্রাম–১৪ আসন থেকে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য হন শাহজাহান চৌধুরী। এবার তাঁকে চট্টগ্রাম–১৫ আসন থেকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। আর চট্টগ্রাম-১৪ আসনে এবার শাহাদাত হোসাইনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে।
কেন নতুন প্রার্থী
দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী এককভাবে সবচেয়ে বেশি আসন পায় পঞ্চম (১৯৯১) ও অষ্টম (২০০১) সংসদ নির্বাচনে, যথাক্রমে ১৮ ও ১৭টি। বেশির ভাগ সময় বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ নির্বাচন করা এই দলের শীর্ষস্থানীয় পাঁচ নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায়। সাজা ভোগরত অবস্থায় মারা যান আরও কয়েকজন নেতা। আবার অনেক জ্যেষ্ঠ নেতার স্বাভাবিক মৃত্যুও হয়েছে। এসব কারণে আগামী নির্বাচনে জামায়াতের প্রাথমিক প্রার্থী তালিকায় নতুন অনেক মুখ রয়েছে।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয়েছে। সমঝোতা যাদের সঙ্গে হবে, তাদের জন্য কিছু আসন ছাড়তে হবে। আর সমঝোতা না হলেও বিশেষ কোনো কারণ সংগঠনের সামনে আসলে হয়তো প্রার্থী পরিবর্তনের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।
তরুণ প্রার্থীদের ব্যাপারে আশাবাদী মিয়া গোলাম পরওয়ার। তিনি বলেন, ‘তরুণ প্রজন্মের চার কোটির মতো ভোটার এবার ভোট দেবেন, যাঁরা বিগত সময়ে ভোট দিতে পারেননি। আমাদের নতুন প্রার্থী, যারা বাংলাদেশের জন্য কাজ করছে, তরুণেরা এমন প্রার্থীদের নিশ্চয়ই চাইবে।’
আলোচিত নতুন প্রার্থী
বিগত সময়ে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে বিভিন্নভাবে আলোচিত ছিলেন, এমন অনেককেই এবার প্রার্থী করছে জামায়াত। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদ (পটুয়াখালী-২)।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আসামিপক্ষের তরুণ আইনজীবী হিসেবে আলোচিত শিশির মনির (সুনামগঞ্জ-২)।
ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি (বর্তমানে জামায়াতের ঢাকা মহানগর উত্তরের সেক্রেটারি) মুহাম্মদ রেজাউল করিম (লক্ষ্মীপুর-৩)।
ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি দেলাওয়ার হোসেইন সাঈদী (ঠাকুরগাঁও-১) ও আলোচিত ইসলামি বক্তা আমির হামযা (কুষ্টিয়া-৩)।
ফেনী–৩ আসনে প্রার্থী হচ্ছেন ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি ফখরুদ্দিন মানিক।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় দণ্ডিত নেতাদের সন্তানদের মধ্য থেকেও এবার প্রার্থী করা হচ্ছে:
সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে নাজিবুর রহমান মোমিন (পাবনা-১)।
দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছোট ছেলে মাসুদ সাঈদী (পিরোজপুর-১) ও বড় ছেলে শামীম সাঈদী (পিরোজপুর-২)।
মীর কাসেম আলীর ছেলে আইনজীবী মীর আহমদ বিন আরমান (ঢাকা-১৪)।
সমঝোতার জোটের উদ্যোগ
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে একটি সমঝোতা জোট করতে চাইছে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো। এ ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকায় রয়েছে জামায়াতে ইসলামী ও চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
এই দল দুটিসহ মোট আটটি দল জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়ন আদেশ জারি, ওই আদেশের ওপর আগামী নভেম্বর মাসের মধ্যে গণভোট আয়োজন, পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি চালু করাসহ বিভিন্ন দাবিতে অভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে।
অন্য দলগুলো হলো খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) এবং বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি।
তবে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জামায়াতের বোঝাপড়া ভালো বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারা।

