শেখ মাহতাব হোসেন, ডুমুরিয়া : খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নের ৩ লক্ষাধিক অধিবাসী ১৯৮০ দশক থেকে জলাবদ্ধ কবলিত।
উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত নদ-নদীগুলো একের পর এক মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। মূল কারণ পলি সমস্যা। পোল্ডার ব্যবস্থার পূর্বে জোয়ারে আগত পলি সব বিলের মধ্যে অবক্ষেপিত হতো, এখন তা নদীবক্ষে অবক্ষেপিত হয়ে নদ-নদীগুলোর মৃত্যু ঘটাচ্ছে যার কারণে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা ও পরিবেশ সমস্যা।
ইতোমধ্যে হামকুড়া, শৈলমারী, পূর্ব শালতা, ভদ্রা ও আমতলী নদী মারা গেছে এবং মৃত্যুর প্রহর গুণছে গুয়াচাপা ও জয়খালী নদী। তেলিগাতী- ঘ্যাংরাইল ও পশ্চিম শালতা নদীও ভুগছে প্রচন্ড নাব্যতা সংকটে। ফলে সমগ্র উপজেলা জলাবদ্ধতা সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এখন এটি বড় ধরণের প্রশ্ন যে, এসব নদ-নদী যদি না বাঁচে তাহলে এলাকার অবস্থা কি হবে? নদ-নদীগুলো রক্ষা করার উপায় কি?
টিআরএম বা জোয়ারাধার ব্যবস্থা বিল ডাকাতিয়া, ভবদহ এলাকার বিল ভায়না, খুকশিয়া ও কেদারিয়া বিলে টিআরএম বাস্তবায়ন করে দেখা গেছে এ পদ্ধতির মাধ্যমে জলাবদ্ধতা দূর করা এবং নদী বাঁচানো সম্ভব। কিন্তু ভবদহ এলাকায় বিগত ১০ বৎসর যাবত টিআরএম বন্ধ থাকায় এর নিম্নে তেলিগাতী-ঘ্যাংরাইল অববাহিকায় দেখা দিয়েছে নাব্যতা সংকট এবং জলাবদ্ধতার প্রাদুর্ভাব।
হামকুড়া অববাহিকায় টিআরএম বাস্তবায়নে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সরকারের বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান আইডব্লিউএম (IWM) সমীক্ষার ভিত্তিতে একটি প্রকল্প প্রণয়ন করে যেখানে অববাহিকার মধুগ্রাম বা মাধবকাটি বিলে টিআরএম বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ তে হামকুড়া ও ঘ্যাংরাইল অববাহিকায় টিআরএম বাস্তবায়নের উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো বাংলাদেশ পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় বা বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করছে না। তাদের আগ্রহ নদী-খাল খনন ও সেচ কার্যক্রমের মাধ্যমে। সমাধান দেওয়া।
এটি বহুবার প্রমাণিত হয়েছে যে, নদী-খাল খননের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা সমস্যা দূর করা বা নদী বাঁচানো সম্ভব নয়। অতীতে হরি, ভদ্রা, হামকুড়া, শৈলমারী, পূর্ব শালতা প্রভৃতি নদী একাধিকবার খনন করা হয়েছে, পলি দ্বারা তা আবারও ভরাট হয়ে গেছে। সম্প্রতি জয়খালি ও ডুমুরিয়া সদর মুখী ভদ্রা নদী ও মাগুরখালীর পশ্চিম শালতা নদী খনন করা হয়েছে। তার ফলাফল কি? ২-১ বৎসরের মধ্যে নদী ভরাট হয়ে গেছে। ভবদহের হরি নদী প্রতি বৎসর খনন করা হয় এক বৎসরের মধ্যে তা আবার ভরাট হয়। সুতরাং এটি প্রমাণিত যে, নদী খননের মাধ্যমে নদী বাঁচানো সম্ভব নয় বরং নদী এতে খালে পরিণত হয় এবং পাড় উঁচু হওয়ার কারণে দু’পাশের প্লাবন ভূমি সংকুচিত হয়ে পড়ে।
টিআরএম বা জোয়ারাধার বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা জলাবদ্ধতা সমস্যা মোকাবেলা ছাড়াও আমাদের এ এলাকায় আরও কিছু সমস্যা আছে। আমাদের এ এলাকার ভূমি প্রতি বৎসর ভূ-পৃষ্ঠের চাপে বসে যায়, পোল্ডারের পূর্বে এসব বসে যাওয়া জায়গা জোয়ারে আগত পলিদ্বারা পূরণ হতো এবং ভূমি আরও উঁচু হতো, এখন সে সুযোগ নেই, এখন ভূমি একতরফা বসে যাচ্ছে। ফলে অধিক এলাকা জলমগ্ন হচ্ছে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে ঘন ঘন উঁচু মাত্রায় জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে জোয়ারের উচ্চতাও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।
টিআরএম বাস্তবায়িত হলে বসে যাওয়া ভূমি উঁচু করা যেমন সম্ভব হবে তেমনি এর দ্বারা নদী নাব্য হলে জলোচ্ছ্বাস ও উচ্চ জোয়ারের চাপ যথেষ্ট পরিমাণ মোকাবেলা করা যাবে। সুন্দরবনের নদী-খাল আর পলি দ্বারা ভরাট হবে না। ফলে দুর্যোগ মোকাবেলায় সুন্দরবনের সক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে ।
মূল কথা- নদী বাঁচলে আমরা বাঁচবো, রক্ষা পাবে এই এলাকার জনপদ ও সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য। আসুন আমরা সবাই নদী বাঁচাতে, এলাকা বাঁচাতে, জীববৈচিত্র্য বাঁচাতে, সুন্দরবন বাঁচাতে টিআরএম বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করি।
ডুমুরিয়া উপজেলার নদ-নদীগুলো একের পর এক মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে

Leave a comment