
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের পর ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। বাংলাদেশে তীব্র হয়েছে ভারত-বিরোধী মনোভাব। তবুও বাণিজ্য বাড়ছে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে।
বাংলাদেশের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারতে পণ্য রপ্তানির পরিমাণ ১২.৪ শতাংশ বেড়ে মোট ১.৭৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এর আগের অর্থবছর, অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের মূল্য ছিল ১.৫৭ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারত থেকে ৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে।
২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশের জুতা রপ্তানি ৪৩ শতাংশ এবং তৈরি পোশাক (আরএমজি) রপ্তানি ১৭.৩৮ শতাংশ বেড়েছে। মাছ রপ্তানিও আগের অর্থবছরের তুলনায় ৪২.০৪ শতাংশ বেড়েছে।
এই বছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ভারতে ১৪৯.৪ মিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ শতাংশ বেশি। তদুপরি, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের রপ্তানি ছিল ৪৪১ মিলিয়ন ডলার, যা এই বছরের একই সময়ে ৯.৫২ শতাংশ বেড়ে ৪৮৩.৭১ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে।
এই তথ্যগুলো রাজনৈতিক উত্তেজনা সত্ত্বেও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত জুড়ে পণ্য সরবরাহ চেইনের দৃঢ়তা তুলে ধরছে।
চলতি বছরের এপ্রিল-মে মাসে বাংলাদেশ এবং ভারত কিছু পণ্যের ব্যবসায় সীমিত বিধিনিষেধ এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তবুও, এটি সামগ্রিক বাণিজ্যের উপর বড় কোনো প্রভাব ফেলেনি বলে মনে হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারত স্থলপথ দিয়ে বাংলাদেশ থেকে সব ধরনের আরএমজি আমদানি নিষিদ্ধ করেছিল। কেবল কলকাতা এবং মুম্বাই সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে বাণিজ্যের অনুমতি দেয়া হয়েছে। তা সত্ত্বেও, এই খাতে বাংলাদেশের রপ্তানি আগস্ট ২০২৪ এর তুলনায় আগস্ট ২০২৫-এ ১৬.৫ শতাংশ বেড়েছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ভারত থেকে চাল এবং সুতা আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। চাল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য তেমন কোনো বড় সমস্যা তৈরি করেনি, কারণ দেশটি ইতিমধ্যেই তার প্রয়োজনের চেয়ে বেশি চাল উৎপাদন করে। কিন্তু স্থলপথ দিয়ে সুতা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞার ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারে সুতার দাম ৮ থেকে ১২ শতাংশ বেড়েছে। একইভাবে, যখন ভারত স্থলপথ দিয়ে পাটজাত পণ্য আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করে, তখন এই খাতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় জুলাই মাসে মাত্র ৩.৪ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, যা ২০২৪ সালের একই মাসে ছিল ১২.৯ মিলিয়ন ডলার।
ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যের এই বৃদ্ধি একটি রাজনৈতিকভাবে উত্তপ্ত সময়ে এসেছে। হাসিনার পদত্যাগ এবং আগস্ট ২০২৪ এ ভারতে চলে যাওয়ার পরে, বাংলাদেশে জনমত জাতীয়তাবাদী এবং ভারত-বিরোধী মনোভাব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বেশ কয়েকটি ভারত-সম্পর্কিত প্রকল্প বাতিল করে এবং জ্বালানি ও ট্রানজিট চুক্তিগুলো পর্যালোচনার চেষ্টা করে। তবুও, বাণিজ্যের পরিমাণ বাড়তে থাকে, যা রাজনৈতিক পালাবদল অতিক্রমকারী কাঠামোগত আন্তঃনির্ভরতার গভীরতা প্রতিফলিত করে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে এবং পরে উভয় সময়েই ভারতের সাথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট গভীরভাবে সম্পর্কিত ছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি দেশটির সমর্থন ঢাকায় দীর্ঘমেয়াদী ভারত-পন্থী মনোভাব তৈরি করেছিল। একই সাথে, বাংলাদেশে ইসলামপন্থী এবং ভারত-বিরোধী পাকিস্তান-পন্থী অংশের সাথে ভারত-বিরোধী রাজনীতিও দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
গত কয়েক দশক ধরে, সীমান্ত হত্যা, পানি ভাগাভাগি এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতীয় আধিপত্য বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী মনোভাব তৈরিতে অবদান রেখেছে। এই সমস্যাগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও তিক্ততা তৈরি বাড়িয়েছে। ফলে ‘‘দিল্লি না ঢাকা?’’ এর মতো প্রতিবাদী স্লোগানের ঢেউ ওঠে। অর্থাৎ ‘‘আপনি কি আপনার দেশকে দিল্লির দ্বারা প্রভাবিত হতে দেবেন, নাকি এটি শক্তিশালী এবং স্বাধীন থাকবে?’’
কৃতজ্ঞতা এবং অভিযোগের এক জটিল মিশ্রণ এখনও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিকে রূপ দিচ্ছে। বিশেষ করে যখন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশকে স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে আসে, তখন সরকারের ‘ভারত-ঘনিষ্ঠ’ পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে জনমনে সন্দেহ বাড়ে। সমালোচকরা ঢাকাকে জ্বালানি, ট্রানজিট এবং প্রতিরক্ষার মতো ক্ষেত্রে নয়াদিল্লির উপর অত্যধিক নির্ভরশীলতার অভিযোগ আনেন।
ভারতের সাথে বাণিজ্য কেন শক্তিশালী রয়েছে তার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, ভৌগোলিক অবস্থান এবং পরিবহন ব্যবস্থা ভারতকে বাংলাদেশের জন্য একটি অপরিহার্য বাণিজ্য অংশীদার করে তুলেছে। বাংলাদেশ তিন দিক থেকে ভারত দ্বারা পরিবেষ্টিত এবং দুই দেশের মধ্যে প্রায় ৪,০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে।
বেনাপোল-পেট্রাপোলের মতো সীমান্ত বন্দরগুলোতে পণ্য এবং কাঁচামালের পরিবহন খরচ বেশ কম। তৈরি পোশাক, চামড়া এবং কৃষি-প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের উত্পাদনের জন্য অনেক বাংলাদেশি কারখানার ভারতীয় মধ্যবর্তী পণ্য যেমন যন্ত্রপাতি, প্যাকেজিং সামগ্রী এবং রাসায়নিক আমদানি করতে হয়। এছাড়া, ব্যবসায়ী নেতারা উল্লেখ করেন, এমনকি স্থলপথে আরএমজি পণ্যের বাণিজ্যের উপর নিষেধাজ্ঞা সামান্য প্রভাব ফেলেছে। যদিও সমুদ্র পথে পরিবহন খরচ কিছুটা বাড়িয়েছে, তবে ভারতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার বাংলাদেশি পোশাককে বাজারে প্রতিযোগিতামূলক করেছে।
দ্বিতীয়ত, জ্বালানি এবং অবকাঠামো সংযোগ দ্বারা দুই অর্থনীতির মধ্যে সংযোগ আরও শক্তিশালী হয়েছে। মৌসুমী ঘাটতির সময় ভারত বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ করে, অন্যদিকে ভারতীয় তৈরি নির্মাণ সামগ্রী এবং মূলধনী পণ্য শিল্প সম্প্রসারণে সহায়তা করে। তদুপরি, বাংলাদেশ সম্প্রতি ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি বাড়িয়েছে। তাই, ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চেষ্টা করলে বাংলাদেশি কারখানাগুলোতে উৎপাদন ব্যাহত হবে।
তৃতীয়ত, ভারত বাংলাদেশের অ-আরএমজি পণ্য যেমন কৃষি পণ্য, জুতা এবং পাটের জন্য একটি বড় বাজার। এটি গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত যেহেতু বাংলাদেশের অন্য প্রতিবেশী মিয়ানমারের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক শক্তিশালী নয়। মিয়ানমারের চলমান অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে মূলত এমনটি ঘটেছে, যা পণ্য আমদানির ক্ষমতাকে সীমিত করেছে।
যদিও ভারত বাংলাদেশের বৃহত্তম স্থলপথের বাণিজ্য অংশীদার হিসাবে রয়ে গেছে, অন্যান্য প্রধান খেলোয়াড়দের সাথে বাণিজ্য একটি বিপরীত চিত্র উপস্থাপন করছে। অন্তর্বর্তী সরকার চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেওয়া সত্ত্বেও ২০২৪-২৫ সালে চীনে বাংলাদেশি রপ্তানি ৭১৫ মিলিয়ন ডলার থেকে কমে ৬৯৪ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যে, গত অর্থবছরে চীনের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে ১৬.৪৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে রপ্তানি, যা বাংলাদেশের আরএমজির বৃহত্তম বাজার, চাপের মুখে রয়েছে। সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানির মূল্য ছিল ৩.৬২ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের তুলনায় ৪.৬ শতাংশ কম। আরএমজি চালান, যা ৫.৬৬ শতাংশ কমেছে, ট্রাম্প প্রশাসন কর্তৃক আরোপিত পারস্পরিক শুল্ক পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত রপ্তানিগুলোর মধ্যে ছিল। এই ধরনের পরিবর্তনগুলো আঞ্চলিকভাবে ভারতকে একটি বিকল্প বাজার হিসাবে গুরুত্ব দেয়, বিশেষত পশ্চিমা চাহিদা হ্রাসের ধাক্কা মোকাবেলা করতে চাওয়া নির্মাতাদের জন্য।
যদিও হাসিনার পতনের পর ঢাকা পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলছে, ভৌগোলিক কারণে ভারত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কের কেন্দ্রে রয়েছে। ভারতের সাথে সাধারণ সীমান্ত, পরিবহন সংযোগ এবং আঞ্চলিক সংযোগ নয়াদিল্লিকে বাংলাদেশের শিল্প ভিত্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে একটি অপরিহার্য মিত্র করে তুলেছে।

