এ নদ বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রখালী-খুদিয়া এবং হাতিয়া নদীসহ সংযুক্ত খালসমূহ খননের দাবিতে বাপা’র সংবাদ সম্মেলন
কাজের অগ্রগতি মাত্র ২০ শতাংশ, কাজ শেষ না করেই আংশিক বিল উত্তোলন
নকশা ও দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী নদ খনন হচ্ছে না বলে অভিযোগ
৯ বছর ধরে অপরিকল্পিত খনন করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি
জন্মভূমি রিপোর্ট : অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়ন, জনসংখ্যার আধিক্য ও পরিবেশ বিষয়ে অসচেতনতা, অপর্যাপ্ত পানিপ্রবাহে ময়ূর নদের জীবন এখন যায় যায়। নগরের গুরুত্বপূর্ণ ২২টির বেশি নালার মুখ গিয়ে পড়েছে ময়ূর নদে। ফলে ময়লা-আবর্জনা বিষাক্ত করে তুলছে নদের পানি। প্রায় ৯ বছর ধরে দফায় দফায় প্রকল্প গ্রহণ করে অপরিকল্পিত খনন করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ফলে দখল-দূষণে নদটি মৃত প্রায়। এ অবস্থায় ময়ূর নদ বাঁচাতে সংশ্লিষ্ট উজানের ক্ষেত্রখালী/খুদিয়া এবং ভাটির হাতিয়া নদীসহ সংযুক্ত খালসমূহ খননের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ।
শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় ময়ূর নদের পূর্বপাড়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানান বাপার জাতীয় পরিষদের সদস্য ও খুলনা জেলা সমন্বয়কারী আ্যাডভোকেট মোঃ বাবুল হাওলাদার।
সম্মেলনে বলা হয়, খুলনা সিটি করপোরেশন ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন’ প্রকল্পের আওতায় ময়ূর নদের বয়রা শ্মশানঘাট হতে সাচিবুনিয়া ব্রিজ এবং ক্ষেত্রখালী/খুদিয়া নদীর আড়ংঘাটা কালভার্ট থেকে বয়রা শ্মশানঘাট পর্যন্ত মোট সাড়ে ৫ কিলোমিটার নদী খনন প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যার কাজ চলমান। কিন্তু এ নদটি বিল ডাকাতিয়া থেকে উৎপত্তি হয়ে ক্ষেত্রখালী/খুদিয়া নাম ধারণ করে, বয়রা শ্মশানঘাট এলাকায় এসে নাম পরিবর্তিত হয়ে, ময়ূর নদ নাম ধারণ করে বুড়ো মৌলভীর দরগাহ্ সংলগ্ন ত্রিমোহনীতে এসে পুনরায় নাম পরিবর্তিত হয়ে, হাতিয়া নাম ধারণ করে আলুতলা এলাকায় রূপসা নদীতে পড়েছে। খুলনা সিটি করপোরেশন মূলত খুলনা মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এ প্রকল্পটি গ্রহণ করেছে। কিন্তু ময়ূর নদটি বাঁচাতে খুলনাবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি উপেক্ষিত রয়ে গেছে। একটি নদীর আংশিক খনন করে তার প্রবাহ নিশ্চিত করা বা বাঁচানো সম্পূর্ণ বাস্তবতা পরিপন্থী। শুধু তাই নয়, আংশিক খননের ফলে জলাবদ্ধতা নিরসনের বিষয়টিও যথেষ্ট প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়। সমগ্র নদটি একটি সমন্বিত পরিকল্পনার আওতায় এনে আলুতলাস্থ ১০ গেট থেকে বিল ডাকাতিয়া পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদটি এবং এর সংযুক্ত খালসমূহ খনন করে উজান এবং ভাটিতে সমান প্রবাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে বাপা মনে করে। অন্যথায় এ প্রকল্পের কাজ শুধুমাত্র অর্থ অপচয় হবে বলেই ধারণা, কুরা হচ্ছে। অন্যদিকে গল্লামারী ব্রিজ নির্মাণে নদী শাসনুর নামে নদের এ -নাহ যেন বাঁধাগ্রস্থ বা সংকচিত না হয় সেটিও নিরেষ্কার রালা অতীব জরুরী।
লিখিত বক্তব্যে আরো বলা হয়, ময়ূর নদ খনন প্রকল্পের চলমান খনন কাজ পানি শুকিয়ে ভেকু ও শ্রমিক দিয়ে মাটি কাটার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে পানি না সেচে পানির মধ্যেই খনন কাজ চলায় এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য কতটা বাস্তবায়িত হবে সে বিষয় আমরা যথেষ্ট সন্দিহান। সর্বোপরি খুলনা মহানগরীসহ এ অঞ্চলের পরিবেশ প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা, জলাবদ্ধতা নিরসন, কৃষিতে সেচ, মৎস্য চাষ, নদী নির্ভর মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপন পুনরুদ্ধারে ময়ূর নদের দু’পাড়ের অবৈধ দখল উচ্ছেদ, দূষণ বন্ধ এবং সমগ্র নদটিকে খনন করে একটি সমন্বিত স্বল্প, মধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার আওতায় এনে সমগ্র নদটি জোয়ার-ভাটার আওতায় আনা সময়ের দাবি।
এক প্রশ্নের জবাবে বাবুল হাওলাদার বলেন, দাবি বাস্তবায়নে আমরা পর্যায়ক্রমে জেলা প্রশাসন, নদী কমিশন এবং প্রধানমন্ত্রীর নিকট স্মারকলিপি দেব। এরপর পরবর্তী কর্মসূচি দেওয়া হবে।
খুলনা সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, ৬ মাস আগেই খুলনার ময়ূর নদ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। আরও চার মাস সময় দেওয়া হয়েছে সাড়ে ৭ কোটি টাকার প্রকল্পটি শেষ করার জন্য। তাতেও কাজের অগ্রগতি মাত্র ২০ শতাংশ। অথচ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রথম দফায় ৬৩ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে খুলনা সিটি করপোরেশন।
অন্যদিকে নকশা ও দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী নদ খনন হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। নদের খনন করা অংশের বেশ কিছু স্থানে তলদেশ ভরাট হয়ে উঁচুও হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন অংশে বাঁশ ও বালুর বাঁধ দিয়ে ফের দখলদারি চলছে। ফলে খননের সুফল নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) বৈষয়িক কর্মকর্তা নুরুজ্জামান তালুকদারের দাবি, ময়ূর নদে এখন আর কোনো দখলদার নেই। নতুনভাবে কেউ দখলে নিলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জানতে চাইলে নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক শেখ মো. মাসুদ করিম বলেন, বর্ষার কারণে ছয় মাস কাজ বন্ধ ছিল। এ ছাড়া কৃষকরা বাঁধ কেটে পানি তোলায় কাজে বিলম্ব হয়েছে। তবে এখন কাজ ফের শুরু হচ্ছে।
তিনি বলেন, নদীর জায়গা অনেক মানুষ রেকর্ডের কাগজ দেখিয়ে মালিকানা দাবি করছে। সে কারণে অনেক বাড়ি উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। তবে সীমানা চিহ্নিত করে খননের চেষ্টা করা হচ্ছে। বাঁধের ব্যাপারে শেখ মো. মাসুদ করিম বলেন, নদ শুকিয়ে খনন করতে হবে। সে কারণে কিছু অস্থায়ী বাঁধ দেওয়া হয়েছে। খনন শেষে কেটে দেওয়া হবে।
খননের পর ফের ভরাট সম্পর্কে বলেন, খননের পর পলি এসে ভরাট হচ্ছে। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ফের তা খনন করবে। কারণ বছরে চারবার রক্ষণাবেক্ষণ করবে এমন চুক্তি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রয়েছে।
খুলনা শহরের পশ্চিম পাশ দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত ময়ূর নদ মূলত ভৈরব নদের একটি স্রোতোধারা, যা কাজীবাছা- ভৈরব হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। বটিয়াঘাটার পুঁটিমারী ও তেঁতুলতলা গ্রামের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গল্লামারী সেতু থেকে ময়ূর নদ নামে উত্তর দিকে রায়েরমহল হয়ে ক্ষুদের খাল নামে বিল ডাকাতিয়ায় গিয়ে মিশেছে এটি। এই নদ খুলনা শহরের মিঠাপানির অন্যতম উৎস।
সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, এই নদে শহরের অধিকাংশ পয়ঃনিষ্কাশনব্যবস্থা যুক্ত। বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ ২২টির বেশি নালার মুখ গিয়ে পড়েছে ময়ূর নদে। ফলে তলদেশে ময়লা জমতে জমতে একসময়ের খরস্রোতা নদটি পরিণত হয়েছে মরা খালে। নদের প্রাণ ফেরাতে ২০১৪ সালে প্রায় ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে এক দফা খনন করা হয়েছিল। তবে সে উদ্যোগ কাজে আসেনি। তাই শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ফের খুলনা সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে নদটি খনন করা হচ্ছে। ‘৮২৩ কোটি টাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন প্রকল্প’-এর আওতায় খননকাজ শুরু করতে ২০২২ সালের ৭ জুন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আমিন অ্যান্ড কোং অ্যান্ড শহীদ এন্টারপ্রাইজকে কার্যাদেশ দেয় সিটি করপোরেশন। তাদের চুক্তিমূল্য ৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। প্রকল্পটির মেয়াদ ছিল ২০২৩ সালের ৩০ জুন। এরপর দ্বিতীয় দফায় সময় বাড়ানো হয় ২০২৩ সালের ১৫ অক্টোবর। এ মেয়াদেও কাজ সমাপ্ত না হওয়ায় ফের সময় বাড়াতে আবেদন করা হয়েছে। তবে কাজ শুরুর এই দেড় বছরে অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ২০ ভাগ। এই অগ্রগতিতেই ৬৩ লাখ টাকার বিল পরিশোধ করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফা বিল পরিশোধের জন্য আবেদন করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ডিডিএলসি সূত্রে জানা গেছে, ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই ময়ূর নদের ৫ হাজার ৯১০ মিটার খনন করা হবে। অর্থাৎ বয়রা শ্মশানঘাট থেকে নারকেলবাড়িয়া খালের মুখ পর্যন্ত অংশ খনন করা হবে।
নদ খনন করে এর প্রস্থ ২০ থেকে ৪৩ মিটার এবং গভীরতা ৫ থেকে ৮ মিটার পর্যন্ত করা হবে। বর্তমানেও নদটি প্রায় একই পরিমাণ চওড়া। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী নদের ৮৫ শতাংশ শক্ত মাটি ৫০০ মিটার দূরে এবং ১৫ শতাংশ নরম পেড়িমাটি ৫ কিলোমিটার দূরে রাখার কথা রয়েছে। শক্ত মাটির ৭৫ শতাংশ কাটা হবে ভেকু দিয়ে। আর ২৫ শতাংশ কাটা হবে শ্রমিক দিয়ে।
খনন হওয়া অংশে দেখা গেছে, খননের পরপরই আবার নদের বিভিন্ন অংশে বাঁশ ও বালুর বাঁধ দিয়ে দখল করা হচ্ছে। এ ছাড়া খননকৃত নদী কচুরিপানায় পুরো ঢেকে গেছে।
দেয়ানা এলাকার বাসিন্দা তরিকুল ইসলাম, করিম মোল্লা, জাহিদুর রহমানসহ কয়েকজন জানান, দেয়ানার রমজানের ব্রিজসংলগ্ন নদে পানির মধ্যেই ভেকু (এক্সকাভেটর) দিয়ে খনন করা হয়েছে। ভেকু দিয়ে মাটি ওঠানোর সময় আবার তা পানির সঙ্গে গুলিয়ে নদে পড়েছে। পরে সেই মাটিতে তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। এখন শুকনো মৌসুমে তলদেশে উঁচু টিলার মতো অংশ দেখা যাচ্ছে।
মোস্তফার মোড়সংলগ্ন সøুইসগেট এলাকার বাসিন্দা মেহেদী হাসানসহ কয়েকজন জানান, খননকৃত অংশে পাড়জুড়ে অবৈধ দখলদার রয়েছে। অথচ সেই দখলদার উচ্ছেদ ছাড়াই খনন করা হচ্ছে। শ্মশানঘাটসংলগ্ন ওয়াপদা পাশ ও দেয়ানা সড়কসহ বেশ অনেক স্থানে খননের পর আবার বাঁশ ও বালুর বাঁধ দিয়ে দখল হয়েছে। নদ খনন হওয়া অংশ ঘুরে দেখেছেন খুলনার পরিবেশ সুরক্ষা মঞ্চের সভাপতি ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খুলনা জেলার সাধারণ সম্পাদক কুদরত-ই-খুদা বলেন। তিনি বলেন, আসলে নদীর সীমানা নির্ধারণ করে তারপর খনন করতে হবে। কিন্তু সেটি করা হচ্ছে না। পুজোখোলাসহ অনেক স্থানে নদীর তিন ভাগের এক ভাগ বসতঘর বানিয়ে দখল করা হয়েছে। অথচ তা উচ্ছেদ ছাড়াই খনন হচ্ছে। ময়ূর নদের একটি শাখা খালে মাছ চাষও হচ্ছে। সুতরাং খননের নামে কচুরিপানা তোলা হচ্ছে। নদীর পানি পরিষ্কার করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সীমানা নির্ধারণ করে মাটি উত্তোলন করে পরিপূর্ণ খনন না করলে শুধুই টাকাই খরচ হবে। কোথাও ১২ ফুট আবার ৩০ ফুট খনন হচ্ছে। ময়ূর নদ তো ১২ ও ৩০ ফুট না। এভাবে খননে সুফল পাওয়া যাবে না।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খুলনার সম্পাদক জানান, নদে বেশ কিছু স্থানে বর্তমানে খন্ড খন্ড বাঁধ দেওয়া হয়েছে। ফলে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ ছাড়া রূপসার আলুতলা এলাকায় একটি জলকপাট নির্মাণ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। জলকপাটের মাধ্যমে ভাটায় ময়ূর নদের পানি নামছে। কিন্তু জোয়ারের পানি মধ্য নদ পর্যন্ত আসার আগেই ভাটা শুরু হয়ে যাচ্ছে। তাই জলকপাটও সংস্কার করতে হবে। সেই সঙ্গে ২২টি খাল দিয়ে ময়লা আসে। সেটিও বিবেচনায় আনতে হবে।