বাংলাদেশের পরমাণু যুগে প্রবেশ
এক গ্রাম পরমাণু জ্বালানিতে ২৪ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ
রূপপুরে সর্বোচ্চ সতর্কতায় ইউরেনিয়াম সংরক্ষণ
জন্মভূমি ডেস্ক : রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ‘ইউরেনিয়াম’ আসার মাধ্যমে পরমাণু যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। সর্বোচ্চ সতর্কতায় প্রকল্প এলাকায় সংরক্ষিত করা হয়েছে এই জ্বালানি। জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এই ইউরেনিয়াম-২৩৫ জ্বালানি যাতে দেশ এবং পরিবেশের জন্য কোনো হুমকির কারণ না হয়ে দাঁড়ায় সেজন্য নিশ্চিত করা হয়েছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা। এজন্য ইতোমধ্যে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ভিভিইআর-১২০০ শ্রেণির জেনারেশন ৩ প্লাস রিঅ্যাক্টর স্থাপন করা হয়েছে। অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৩-৪ গুণ বেশি সার্ভিস লাইফের এই কেন্দ্রে মাত্র ১ গ্রাম ইউরেনিয়াম দিয়ে ২৪ হাজার ইউনিট (কিলোওয়াট পার আওয়ার) বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
॥ কী এই পারমাণবিক জ্বালানি ॥
পরমাণু বিশেষজ্ঞদের মতে, পারমাণবিক জ্বালানির মূল উপাদান হলো ক্ষুদ্র আকৃতির ইউরেনিয়াম প্যালেট। এ রকম কয়েকশ’ প্যালেট একটি নিñিদ্র ধাতব টিউবে ঢোকানো থাকে। এই ধাতব টিউবই ফুয়েল রড হিসেবে পরিচিত। অনেকগুলো ফুয়েল রড একসঙ্গে যুক্ত করে তৈরি হয় ফুয়েল অ্যাসেম্বলি। একটি ফুয়েল অ্যাসেম্বলি লম্বায় সাড়ে তিন থেকে সাড়ে চার মিটার পর্যন্ত হয়। আর এ রকম ফুয়েল অ্যাসেম্বলি জ্বালানি হিসেবে রিঅ্যাক্টরে লোড করা হয়। বাংলাদেশে ১২শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি চুল্লিতে এমন ১৬৩ টিফুয়েল অ্যাসেম্বলি লোড করা হবে।
গ্যাস, কয়লা বা তেল পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হলেও এই পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় পারমাণবিক চুল্লিতে ফিউশান বিক্রিয়ার মাধ্যমে। যেখানে ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াস বিভাজন ঘটে। এর ফলে প্রচুর তাপ শক্তি উৎপন্ন হয়। এই তাপ শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পানিকে বাষ্পে পরিণত করে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করে। পারমাণবিক চুল্লিতে এটি এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত চেইন রিয়্যাকশন। ব্যবহৃত পারমাণবিক জ্বালানি থেকে আবার ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি পাওয়া যায় বলে এই জ্বালানিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি হিসেবেও বিবেচনা করা হয়।
॥ কিভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে কেন্দ্রে ॥
বিদ্যুৎকেন্দ্রে পৌঁছানোর পর এই পারমাণবিক জ্বালানিকে নিউক্লিয়ার ফ্রেশ ফুয়েল পুল স্টোরেজে রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক পরমাণু সংস্থার সেফ গার্ড ডিভিশনের তদারকিতে এই জ্বালানি সংরক্ষণ করা হচ্ছে জানিয়ে প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি চালুর জন্য এরই মধ্যে টেকনিক্যাল ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রস্তুত করা হয়েছে। ইউরেনিয়াম রাখার স্থাপনায় ইরেনিয়াম সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। সার্বিকভাবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যখন পুরোপুরি প্রস্তুত হয়েছে, তখনই আমরা জ্বালানি আনতে সক্ষম হয়েছি। এভাবে ৭ বার জ্বালানি আসার পর আমরা বলতে পারব পূর্ণ জ্বালানি পেয়েছি।
॥ বিদ্যুতের সর্বোচ্চ মূল্য ॥
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি খরচ জীবাশ্ম জ্বালানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় অনেক কম এবং প্ল্যান্ট রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা ব্যয় যে কোনো জীবাশ্ম জ্বালানির বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় কম হওয়ায় এই কেন্দ্রের বিদ্যুতের মূল্য সর্বোচ্চ ৪-৫ টাকার মধ্যে থাকবে। যা সাধারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতার থাকবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
॥ নিশ্চিত করা হচ্ছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ॥
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে পারমাণবিক নিরাপত্তার বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক সব বাধ্যবাধকতা বিবেচনা করে এবং আন্তর্জাতিক মানদ- অনুসরণ করেই বাস্তবায়িত হচ্ছে জানিয়ে প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, বিগত ১০০ বছরের বন্যার ইতিহাস পর্যালোচনা করে এর রিঅ্যাক্টর স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রশাসনিক কর্মকর্তা অলোক চক্রবর্তী বলেন, এ রিঅ্যাক্টর পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যাতে কোনোভাবেই তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়বে না। এছাড়া ঘণ্টায় প্রায় ৪৫০ মাইল বেগে ধাবমান ৫.৭ টন ওজনের একটি বিমান এটির ওপর আছড়ে পড়লেও কনটেনমেন্টের কোনো ক্ষতি হবে না। এটি ঘণ্টায় প্রায় ১২৫ মাইল গতিবেগের শক্তিশালী টর্নেডোও এর কোনো ক্ষতি করতে পারবে না এবং রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্প সহনীয়।
॥ তৈরি করা হয়েছে দক্ষ জনবল ॥
দেশের সবচেয়ে বড় এই প্রকল্পটি রক্ষণাবেক্ষণ তথা পরিচালনের জন্য তৈরি করা হয়েছে এক ঝাঁক দক্ষ জনবল। এর জন্য দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তুলতে প্রায় দেড় হাজার প্রকৌশলী বিজ্ঞানী এবং বিভিন্ন শ্রেণির লোকবলসহ মোট তিন হাজার জনবলকে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। রুশ ফেডারেশন মস্কো ইঞ্জিনিয়ারিং ফিজিক্স ইনস্টিটিউটে (মেফি) নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং উচ্চতর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
॥ রক্ষা হবে পরিবেশও ॥
এ বিদ্যুৎকেন্দ্রে পারমাণবিক জ্বালানি ইউরেনিয়াম ২৩৫ ব্যবহার করা হবে। যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কার্বন, সালফার ও নাইট্রোজেন যৌগ নিঃসরণ করে না। তাই এ বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রত্যক্ষভাবে পরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর সৃষ্ট ক্ষতিকর প্রভাব প্রশমনে ভূমিকা রাখবে।
॥ অবদান রাখবে অর্থনীতিতে ॥
এসডিজি ২০৩০ এবং ভিশন ২০৪১-এর লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখে সরকারের নেওয়া বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির পরিকল্পনায় সবচেয়ে বড় এবং ব্যয়বহুল প্রকল্প এই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, এই কেন্দ্রে উৎপাদন শুরু হলে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসবে। এর মধ্যে জিডিপির বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পাবে ২ শতাংশের বেশি। সরকারের শতভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়িত হয়েছে তাতে যে পরিমাণ ঘাটতি রয়েছে তা পূরণে সহায়ক হবে। দেশের বিদ্যুতের বাজার উন্মুক্ত হবে। যা অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখবে।
॥ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩৩তম দেশ ॥
বিশ্বের অনেক দেশেই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকলেও গত ৩০ বছরে কোনো নতুন দেশ এ রকম বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করতে পারেনি। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ৩৩তম দেশ হিসেবে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণ করছে। যা বাংলাদেশকে বিশ্বে অত্যন্ত মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
॥ রয়েছে প্রতিবন্ধকতা ॥
আগামী ৫ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশরীরে উপস্থিতি এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের ভার্চুয়াল উপস্থিতির মাধ্যমে হস্তান্তর হবে এই কেন্দ্র। এতকিছু প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও এখনো পিছিয়ে রয়েছে এর এই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহের জন্য সঞ্চালন লাইন তৈরির কাজ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের তত্ত্বাবধানে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) এটি নির্মাণ করলেও এর গতি খুবই ধীর। রিভারক্রসিংসহ অন্যান্য সঞ্চালন লাইনের এখনো অনেক কাজ বাকি। যা শেষ হতে অপেক্ষা করতে হবে ২০২৫ সাল পর্যন্ত। কিন্তু জ্বালানি আসা বা হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও দুই বছর উৎপাদন না করেই বসিয়ে রাখতে হবে কেন্দ্রটিকে। যার কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্যমতে এর নদী শাসনের আদতে কোনো অগ্রগতিই হয়নি। রূপপুরের বিদ্যুৎ আনতে সঞ্চালন লাইনের মধ্যে পদ্মা নদীতে ২ কিলোমিটার ৪০০ কেভি রিভারক্রসিং লাইনের কাজ শেষ হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। কাজ পুরোপুরি শেষ হতে সময় লাগবে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত। একইভাবে যমুনা নদীতে ৭ কিলোমিটার ৪০০ কেভি রিভারক্রসিং লাইনের কাজও শেষ হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। এটির সম্পূর্ণ কাজ শেষ হতে সময় লাগবে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। যমুনা নদীতে ৭ কিলোমিটার ২৩০ কেভির রিভারক্রসিংয়ের কাজের ভৌত অগ্রগতিও হয়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। যা শেষ হবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে।
এমন পরিস্থিতিতে সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত না হলে পারমাণবিক জ্বালানি আসা বা হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া কোনো কিছুই কাজে আসবে না বলেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম।