সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১৪ উপজেলায় উৎপাদিত কাঁকড়া বিশ্বের ১৮টি দেশে রফতানি করা হয়। বছরে ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে ২শ’ ৫৩ কোটি টাকা মূল্যের ৫ হাজার ৮শ’ মেট্রিক টন কাঁকড়া উৎপাদিত হচ্ছে। অথচ এ অঞ্চলের কাঁকড়া পোনা উৎপাদনের কোন হ্যাচারি এবং তৃর্ণমূলের চাষিরা ব্যাংক ঋণের সুবিধা পাচ্ছেনা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে ১৫ প্রজাতির কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে ১১ প্রকারের নোনা পানিতে বাকি ৪ ধরণের কাঁকড়া মিঠা পানিতে উৎপাদিত হচ্ছে।
চিংড়ির চাষের পাশাপাশি পৃথক ঘেরে এ কাঁকড়ার চাষ করা হচ্ছে। স্বল্প বিনিয়োগ এবং কয়েক দফা ভাইরাস ও আইলা নামক প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিকল্প হিসেবে এ অঞ্চলে কাঁকড়া চাষের চাহিদা বেড়েছে।
খুলনা জেলায় ৩ হাজার ৯৯৫টি ঘেরে বছরে ৩ হাজার ৬৩২ মেট্রিক টন, সাতক্ষীরা জেলায় ৩০৭টি ঘেরে ১ হাজার ৯৮৬ মেট্রিক টন এবং বাগেরহাট জেলায় ৩৩৩টি ঘেরে ২৫০ মেট্রিক টন কাঁকড়া উৎপাদিত হচ্ছে। উৎপাদিত কাঁকড়ার মূল্য ২৫৩ কোটি ৪৯ লাখ ৭৬ হাজার টাকা।
এছাড়া ভোলার চরফ্যাশন, মনপুরা, বাগেরহাট জেলা সদর, ফকিরহাট, কচুয়া, রামপাল, মংলা, মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা, খুলনা জেলার পাইকগাছা, কয়রা, সাতক্ষীরা জেলার দেবহাটা, কালিগঞ্জ, শ্যামনগর, আশাশুনি ও তালা উপজেলায় কাঁকড়া ফ্যাটেনিং (মোটা তাজা করণ) হচ্ছে।
এ অঞ্চলের কাঁকড়ার চাহিদা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান হংকং মালেশিয়া, তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, জাপান, সৌদি আরব, সিংগাপুর, থাইল্যান্ড, মিশর, আমেরিকায় এ অঞ্চলের কাঁকড়া রফতানি হচ্ছে।
চলতি অর্থ বছরে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চীন, হংকং, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড এ ২৯ লাখ ৪৩ হাজার ৮০৯ ডলার মূল্যের কাঁকড়া রফতানি হয়েছে। গত অর্থ বছরে এ সব দেশে এক কোটি ৩৭ লাখ ৫৯ হাজার ৮৩৪ ডলার এবং ২০১০-২০১১ অর্থ বছরে এক কোটি ৩৫ লাখ ৩০ হাজার ৪০৯ ডলার মূল্যের কাঁকড়া রফতানি হয়েছে।২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে নয় কোটি ৪৪ লক্ষ ডলার মূল্যের।কাকড়া বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। শ্যামনগর উপজেলার নয়াবে কি বাজারের কাকড়া ব্যবসায়ী উত্তম কুমার রায় এই প্রতিবেদককে জানান অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে তেইশ চব্বিশ অর্থ বছরে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ কাঁকড়া আমরা করাই করেছি এবং রপ্তানাও করেছে কাকড়া হয় না শুধু সুন্দরবন থেকে আহরণ করা হয় না উপকূলীয় অঞ্চল থেকে ও কাকড়া আহরণ করা হয় সুন্দরবন ও উপকূলীয় অঞ্চলের কাকড়া যেগুলো গ্রেড সেগুলোপ্রতিদিন নিয়মিত বিক্রয় করা হয় যেগুলো ছোট কাঁকড়া বা নরম কাকড়া সেগুলো খাচায় বা খামারে বড় করে বিক্রয় করা হয় তিনি আরো জানান বছর পার হলেই বাগদা চিংড়ি মাছের চাষ তুলনামূলক কমিয়ে যাচ্ছে বাড়ছে কাকড়া আহারণ ও কাঁকড়া চাষ সেজন্য চাষিরা চিংড়ি চাষ বাদ দিয়ে কাকড়া চাষে ঝুকছে। শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগাল ইউনিয় নের দাতি নাখালী গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমান জানান চিংড়ি চাষের চেয়ে বর্তমান খাগড়া চাষষে চাষীরা স্বাবলম্বী হচ্ছে সে কারণে দাসীদের হযোগিতা করতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে চাষীদের কে দিতে হবে সরকারিভাবে ট্রেনিং এবং সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা করতে হবে। তাহলে এই কাকড়ার ব্যবসা বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও উন্নতমানের ব্যবসা হিসেবে চিহ্নিত হবে । মোস্তাফিজুর আরো বলেন জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি কাকড়ার প্রজনন মৌসুমে সুন্দরবন থেকে কাকড়া আহরণ ও পরিবহন বন্ধ করতে হবে সেজন্য শুধু বনবিভাগ নয় সংশ্লিষ্ট সকল প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে কারণ প্রজনন মৌসুমে যদি খাগড়া আহারণ বন্ধ থাকে তাহলে কাকার বন্ধু বন্ধ থাকে তাহলে কাঁকড়ার বংশবৃদ্ধি হবে সারা বছর কাকড়া আহরণকারীরা আহরণ করতে পারবে।
শ্যামনগর উপজেলার হরিনগর বাজারে কাকড়া ব্যবসায়ী কামরুল ইসলাম বলেন এই এলাকার প্রধান ব্যবসা ও আয় এর উৎস কাকড়া আহরণ বেচা বিক্রি ও খাগড়া চাষ। তিনি আরো বলেন বর্তমান চিংড়ি তে যে মোরক দেখা দিয়েছে কাঁকড়াতেকোন মোরকের ভয় নেই সে কারণে উপকূলীয় মানুষ কেউ কাঁকড়া আহারণ কেউ কাঁকড়া বিক্রয় কেউ কাঁকড়া চাষে ঝুঁকে পড়েছে এটাই আমাদের এই অঞ্চলের প্রধান ব্যবসায়ী হিসেবে বিবেচিত হয়েছে
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো খুলনা পরিচালক মনোরঞ্জন মন্ডল এই ০প্ৰতিবেদকে জানান, চিংড়িতে লোকসান হওয়ায় অনেক চাষি বিকল্প হিসেবে কাঁকড়া চাষ বেছে নিয়েছে। চিংড়ি ঘেরের পাশেই খন্ড-খন্ড জমিতে কাঁকড়া চাষ হচ্ছে। নিত্য খাবার দেয়ার প্রয়োজন হয় না। সেই কারণে কাঁকড়া উৎপাদন খরচ কম। পাশাপাশি এ অঞ্চলের কাকড়ার চাহিদা বিভিন্ন দেশে বৃদ্ধি পেয়েছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান শুভাশীষ বসু বলেন, ন্যাচারাল পণ্যের রফতানির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য উপকূলীয় এলাকায় নোনা পানিতে কাঁকড়া উৎপাদন বাড়াতে হবে। এজন্য আগামীতে কাঁকড়া চাষের নীতিমালা তৈরী করা ও ব্যাংকিং সুবিধা দেয়ার চেষ্টা করতে হবে।
তিনি বলেন, কাঁকড়া উৎপাদন করে চীন ও তাইওয়ান থেকে বড় ধরনের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। সূত্র জানায়, বিমান যোগে প্রতিদিন গড়ে ১০ মেট্রিকটন কাঁকড়া চিনে রফতানি হচ্ছে।
মংলা উপজেলা মৎস কর্মকর্তা মো. লিয়াকাত আলী জানান, উপজেলার চিলা, চাঁদপাই, বুড়িরডাঙ্গা, সুন্দরবন ইউনিয়নে ব্যাপক ভিক্তিতে এবং মিঠেখালী ও সোনাইলতলা ইউনিয়নে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ জমিতে কাঁকড়ার চাষ হচ্ছে।
তিনি বলেন, উপজেলার প্রায় দেড়শটি ঘেরে পৃথকভাবে শুধু কাঁকড়াই মোটা-তাজাকরণের প্রক্রিয়া চলছে।
মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, মাংসের গুড়ো, ছোট মাছ, খৈল ও কুড়ো কাঁকড়ার খাদ্য হওয়ার উৎপাদন খরচ অনেক কম এবং চিংড়ির চেয়ে বেশি লাভজনক। রোগবালাই নেই ফলে ঝুঁকি কম। তিনি বলেন, প্রায় দু’ হাজার লোক এই সেক্টরে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে।
বাগেরহাট সদর উপজেলার দক্ষিণ খানপুর কালীবাড়ি এলাকায় চিংড়ি চাষি সুভাষ চন্দ্র মন্ডল বলেন, এ অঞ্চলের চাষিরা শামুক ও ঝিনুক খাদ্য হিসেবে কাঁকড়ার ঘেরে ব্যবহার করছে। উপজেলার এক স্থান থেকে আন্যস্থানে কাঁকড়া পরিবহনে পুলিশী হয়রানী হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
২৭ বছর এ চাষের অভিজ্ঞতার আলোকে এই চাষি বলেন, এক বিঘা জমিতে ১৬০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন করে ৮০ হাজার টাকা আয় হয়। সেক্ষেত্রে ওই সমপরিমাণ জমিতে ৪শ’ থেকে ৫শ’ কেজি উৎপাদন করে ৪ লাখ টাকা আয় হচ্ছে।
খুলনা বিভাগীয় কাঁকড়া ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. আনিসুজ্জামান বলেন, বৃহত্তর খুলনা জেলায় পাঁচ হাজার চিংড়ি চাষি, দুই হাজার ডিপো মালিক এবং পাঁচ হাজার ফঁড়িয়া কাঁকড়া উৎপাদন ও বিক্রির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখানে ব্যাংক ঋণের কোন সুবিধা নেই। এক জেলা থেকে অন্য জেলায় পরিবহণের ক্ষেত্রে ফেরিঘাটে বিড়াম্বনা পোহাতে হয়।
এছাড়া রফতানির ক্ষেত্রে বিমানে গার্মেন্টস পণ্য প্রাধান্য পাওয়ায় কাঁকড়া পরিবহনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রায়ই অনীহা দেখা যায়। একদিন রফতানিতে বিলম্ব হলে খরচ বাড়ে এবং মরে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য কাঁকড়ার পোনা তৈরির হ্যাচারি এবং সহজ শর্তে ঋণ দানের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন তিনি।