রঞ্জন কুমার মল্লিক, মাদারীপুর : মাদারীপুরের কালকিনিতে প্রায় দুইশ বিশ বছরের পুরনো কালিপূজা উপলক্ষে কুন্ডুবাড়ি মেলা আয়োজনে নানা বাঁধা বিপত্তির পরে গত ৩১ অক্টোবর থেকে অনুষ্ঠিত ৩ দিনের মেলা জমে উঠেছে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ক্রেতা দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভীড়।
স্থানীয় আলেম সমাজের আপত্তির মুখে অনিশ্চিত হয়ে পড়া মেলা শেষ পর্যন্ত জেলা প্রশাসক ইজারা প্রথা বাতিল করে ৩ দিনের জন্য আয়োজনের অনুমতি দেয়।
মেলায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ঢাকা বরিশাল মহাসড়কের ভুরঘাটার কুন্ডুবাড়ির মন্দির প্রাঙ্গণ থেকে চারপাশের সরকারী ও বেসরকারি প্রায় তিন একর জমির উপরে মেলার দোকান সাজানো হয়েছে। মেলায় আসা সকল ধরনের জিনিসপত্র এখানে পাওয়া যাচ্ছে। দা, কাচি থেকে শুরু করে চটপটির দোকান। সবই কিনতে পাওয়া যাচ্ছে মেলায়।
বরিশালের গৌরনদী থেকে মেলায় আসা আসমা সুলতানা বলেন, ‘আমার বাড়ি থেকে মেলার দূরত্ব পনের বিশ মিনিটের পথ। তাই প্রতি বছরই এই মেলায় আমি ও আমার পরিবারের লোকজন কেনাকাটা করতে আসি। বিশেষ করে শিশুদের জন্য বেশি খেলনা সামগ্রী কিনি। এবারও অনেক কিনেছি।’
গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার সাদুল্লাপুর থেকে আসা ক্রেতা সুমন বালা বলেন, আমি তো প্রতি বছরই মেলায় আসি। গত চার পাচ বছর ধরে নিয়মিত আসছি। পূজা দেখি। মা কালির মন্দিরে প্রার্থনা করি। ফেরার পথে টুকটাক কেনা কাটা করি। এবারও আমার ভাজিতার জন্য কিছু খেলনা কিনেছি। পুতুল আর গাড়ি।
সোহাগ বেপারী নামের আরেক ক্রেতা মাদারীপুর শহর থেকে কুন্ডুবাড়ির মেলায় এসেছেন। তিনি বললেন, মেলায় ঘুরতে এসেছি। চটপটি ফুসকা খেয়েছি। প্রচুর ভীড় মেলায় ভিতরে ঢুকতে সমস্যা হচ্ছে। তবে ভাল লাগছে এখানে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা মেলায় পাহারা দিচ্ছে।
মেলার ব্যবসায়ী রহমান শেখ বলেন, ঢাকা থেকে আমরা গত বিশ বছর যাবত কুন্ডু বাড়ির মেলায় আসি। ফার্নিচারের আসবাবপত্র বেচার জন্য। এবছর স্টল পেতে কোন বরাদ্দ লাগেনি। আর বিদ্যুৎ সুবিধাও পাচ্ছি বিনামূল্যে। কোন চাঁদাবাজিও নেই। এ জন্য প্রশাসনকে অনেক ধন্যবাদ। তবে মেলার সময় কম হয়ে গেছে। আর দুই দিন বাড়িয়ে দিলে আমাদের জন্য ভাল হতো। একই ধরনের কথা জানালেন আরো বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী।
মন্দির প্রাঙ্গণেই কথা হয় কুন্ডুবাড়ি কালি মন্দির ব্যবস্থাপনা কমিটির অন্যতম সদস্য কালীপদ কুন্ডুর ছেলে স্বপন কুন্ডুর সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, প্রতি বছর কালী পূজার সময় ৭ দিন ব্যাপী কুন্ডুবাড়ির এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। ক্রেতাদের ভীড়ে কোন কোন বছর তা ১৫ দিন পর্যন্ত চলে। দুই’শ বিশ বছর আগে ১৮০৫ সালে শ্রী শ্রী কালী মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়। মন্দির প্রতিষ্ঠার সময় থেকে দিপাবলী ও শ্রী শ্রী কালিপূজা উপলক্ষ্যে দীননাথ কুন্ডু ও মহেশ কুন্ডু এই মন্দির কে ঘিরে কুন্ডু মেলার শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের কুন্ডুদের বংশীয় নামানুসারে কুন্ডুবাড়ির মেলা নাম করণ করা হয়। কুন্ডুবাড়ির মেলাটি আমাদের দেশের (বাংলাদেশের) সর্ববৃহৎ মেলাগুলোর একটি ঐতিহ্যবাহী একটি মেলায় পরিনত হয়েছে। মূলত কালীপূজার সময়কে ঘিরে এই মেলার আয়োজন করা হয়। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বিভিন্ন ধর্মের মতানুসারিরা এই মেলাতে আসেন এবং মেলা উপভোগ করেন। ৩১ অক্টোবর থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রচুর ক্রেতা দর্শনার্থীরা আসছেন। এবার মেলা আয়োজনের সময় কম পাওয়ায় স্টল বেশি বসে নি। এবার মেলায় কোন প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোন ইজারা না থাকায় দোকানিদের কোন ধরনের টাকা পয়সার খরচ নেই। তারা নির্বিঘ্নে ব্যবসা করছে। পুলিশ ও সেনা বাহিনী সার্বক্ষনিক মেলায় ডিউটি দিচ্ছে।
মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মোসা. ইয়াসমিন আক্তার জানিয়েছেন, কালিপূজা উপলক্ষে কালকিনি উপজেলার ভুরঘাটা এলাকার কুন্ডুবাড়িতে মেলার আয়োজন হয়ে আসছিল। মেলাটি কালকিনি পৌরসভা থেকে ইজারা প্রদান করে আয়োজন করা হয়ে থাকত। কিন্তু আমরা এবার ইজারা প্রথা বাতিল করে দিয়েছি। এবং মন্দির কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে ৩১ অক্টোবর থেকে ৩ দিন মেলা আয়োজন করার অনুমতি দিয়েছি। মেলায় যাতে আইন শৃংখলার অবনতি না হয় সেদিক বিবেচনা করে পর্যান্ত আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে। যাতে দর্শনার্থী ও ক্রেতাদের কোন ধরনের অসুবিধা না হয়। এমনকি যারা এখানে দোকানি থাকবেন তারাও যাতে কোন ধরনের হয়রানির শিকার না হয় সেদিকগুলো আমরা নজরে রাখবো।
এই বিষয়ে মাদারীপুর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক প্রাণতোষ মন্ডল বলেন, কুন্ডুবাড়ির কালিপূজা ও মেলায় এখনো পর্যন্ত কোন ধরনের বিশৃংখলার খবর পাইনি। প্রশাসন কঠোর অবস্থানে রয়েছে। মেলায় ক্রেতা দর্শনার্থীদের ভীড় বাড়ছে। এমন সুন্দর পরিবেশই আমাদের দাবী ছিল।