রঞ্জন কুমার মল্লিক, মাদারীপুর : ‘শিরক ও বিদআত’সহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে মাদারীপুর সদর উপজেলার শিরখাড়া ইউনিয়নের আলম মীরের কান্দি গ্রামের কুমার নদের খেয়াঘাটে শতবর্ষী একটি বটবৃক্ষ কেটে ফেলেছেন স্থানীয় কিছু মুসুল্লীরা। স্থানীয়দের কেউ কেউ বিশ^াস করতেন এই বটবৃক্ষটি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।
গতকাল সোমবার (৫ মে) সকাল ৯টার দিকে তারা সেখানে গিয়ে বৃক্ষটি কাটা শুরু করেন। এরপর একে একে ডালপালা থেকে শুরু করে মূল বৃক্ষটির মাটি থেকে দন্ডায়মান কান্ডগুলো কেটে ফেলা হয়।
বটবৃক্ষটি কর্তনের দৃশ্যর একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। অনেক স্থানীয় বাসিন্দা বিষয়টি নিয়ে চরম অসন্তোষ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
সরেজমিন ও স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিরখাড়া ইউনিয়নের কুমার নদের আলম মীরের কান্দি গ্রামের খেয়াঘাটে প্রকৃতির নিয়মে জন্ম নেওয়া বটবৃক্ষটি ‘অলৌকিক ক্ষমতার’ রয়েছে বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। সেই বিশ^াসের ধারনা থেকে নদীর পাড়ের এই বটবৃক্ষের গায়ে লাল শাড়ি ও কাপড় বাঁধা, মোমবাতি ও আগরবাতি জ¦ালিয়ে অনেকেই মানত করেন। এই ‘মানত’ করা ধর্মীয় দৃষ্টিতে ‘শিরক ও বিদআত’ বলে আখ্যা দিয়ে এই গ্রামের কিছু মুসুল্লী ৫ মে সকালে করাত ব্যবহার করে পুরো গাছটি কেটে ফেলেন। এতে পরিবেশ কর্মীরা মনে করছেন, বটবৃক্ষ থেকে এই এলাকার প্রচুর মানুষ অক্সিজেন গ্রহণ করতেন। তাছাড়া বট গাছের ফল খেয়ে প্রচুর পাখি বেঁচে থাকত। নিরাপরাধ এই বটবৃক্ষটি কর্তনের সাথে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবীও করেন।
শিরখাড়া ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের সদস্য বাবুল হোসেন বলেন, স্থানীয় কিছু মুসুল্লীরা বটগাছটি কাটার বিষয়ে আমাদের কিছু জানায়নি। তবে লোকমুখে শুনেছি, অভিযুক্তরা দাবী করেছেন-এই বটগাছটিতে এসে মানুষ পূজা করে। মানত করে। অনেকে মনে করত গাছটির অলৌকিক ক্ষমতা আছে। এই বিষয়টিই এক শ্রেণীর লোকজন মনে করেছে- এসব বেদআত, শিরিক। এই অভিযোগ নিয়ে তারা গাছটি কেটে ফেলেছে। তাদের হাত থেকে এখন গাছও বাঁচতে পারতেছে না। এই হলো অবস্থা। এখন প্রশাসনের কাছে দাবী করছি, এই ঘটনা একটি সুষ্ঠু বিচার তারা করুক।’
স্থানীয় বাসিন্দা সোহেল আহমেদ বলেন, এই গাছটি তো মানুষের কোন ক্ষতি করেনি। তবুও এক শ্রেণীর লোক মানুষ এখান মানত করে তা মেনে নিতে না পেরে পুরো গাছইকে হত্যা করলো। যা অত্যন্ত খারাপ একটি উদাহরণ হয়ে রইল। এই ঘটনা যাতে আবারো না ঘটে তার জন্য সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।
এই ঘটনায় তোলপাড়া সৃষ্টি হলে ৬ মে সকালে মাদারীপুর সদর উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা ও বন বিভাগের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে যান।
এই বিষয়ে মাদারীপুরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমি সকালেই আলম মীরের কান্দি গিয়ে বট গাছটিকে দেখে এসেছি। গাছটির ৯০ শতাংশই কেটে ফেলা হয়েছে। মাটির সাথে দশ ফুট উচ্চতার দুটো মূলকান্ড তার ডালাপালা বিহীন দাঁড়িয়ে আছে। বাকী সকল মূলকান্ড ও ডালাপাল কেটে ফেলা হয়েছে। আমি গাছটির মালিক হান্নান হাওলাদারের সাথে কথা বলেছি, তিনি বলেছেন মাত্র ১৫’শ টাকায় গাছটি বিক্রি করেছেন। অথচ গাছটির আর্থিক মূল্য এরচেয়ে অনেক বেশি হওয়ার কথা। আমরা তদন্ত করছি, তদন্ত প্রতিবেদন আমাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিত ভাবে অবহিত করব। পরে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
মাদারীপুর উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি এ্যাডভোকেট মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘এই বটগাছটি তো কারো কোন ক্ষতি করেনি। এই গাছ আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন দেয়। গাছে পাখিরা বাসা বেঁধে থাকে। ফল খেয়ে থাকে। কিন্তু এই পুরনো বটগাছটির কাছে বিভিন্ন ধরনের মানুষ নানা রকমের মানত করে এটা কিছু লোকজন ভালো চোখে দেখে না। তাই তারা পুরো গাছটিই কেটে ফেলে নির্মম ভাবে হত্যা করল। গাছের উপরের ডালপালাসহ নিজের গোড়ার অংশগুলোও কেটে ফেলা হয়েছে। এই ঘটনা সাথে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে সরকারের ব্যবস্থা নেওয়ার দাবী করছি।’
এই বিষয়ে মাদারীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়াদিয়া শাবাব বলেন, ‘শিরখাড়ায় যে বটগাছটি স্থানীয়রা কেটে ফেলেছে। আমরা সেখানে প্রশাসনের লোক পাঠিয়েছি। যারা অভিযুক্ত তারা এখন গা ঢাকা দিয়েছে। আমরা তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’