জন্মভূমি ডেস্ক : গত কয়েক মাসে মার্কিন শ্রমবাজারে পূর্বাভাসের তুলনায় বেশি কর্মসংস্থান যোগ হয়েছে। অর্থনীতিতে শক্তিশালী ধারায় ফেরার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও মূল্যস্ফীতি ও উচ্চ সুদহারের কারণে মার্কিন পরিবারগুলোর ওপর বেড়েছে আর্থিক চাপ। এর ধারাবাহিকতায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে ক্রেডিট কার্ডনির্ভরতা। সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২৩ সালের শেষে মার্কিন গ্রাহকদের ক্রেডিট কার্ড ঋণের পরিমাণ রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কের গৃহস্থালি ঋণবিষয়ক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। সেখানে বলা হচ্ছে, গৃহস্থালি ঋণ আগের প্রান্তিকের তুলনায় ২০২৩ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে ১ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে, যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। এতে ক্রেডিট কার্ডের ঋণের বড় অবদান রয়েছে।
গৃহস্থালি ঋণের অগ্রবর্তী অংশে রয়েছে হাউজিং লোন। তবে এবার বিশেষভাবে মনোযোগ কেড়েছে ক্রেডিট কার্ডের ঋণ। আগের প্রান্তিকের তুলনায় এ খাতে ব্যালান্সের পরিমাণ প্রায় ৪ দশমিক ৬ শতাংশ বা ৫ হাজার কোটি ডলার বেড়েছে। বছরওয়ারি হিসাবে প্রায় ১৫ শতাংশ। ২০২৩ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে ক্রেডিট কার্ড ঋণ ছিল রেকর্ড সর্বোচ্চ ১ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন অর্থনীতি সামগ্রিকভাবে ভালো করলেও খাদ্য, গ্যাস ও আবাসনের উচ্চ মূল্য ক্রেডিট কার্ডের ঋণে অবদান রাখছে। এ সময় ৩০ থেকে ৩৯ বছর বয়সীদের মধ্যে ঋণ নেয়ার পরিমাণ বেড়েছে।
গত বছরের শেষ প্রান্তিকে ক্রেডিট কার্ডের অর্থ পরিশোধে পিছিয়ে পড়ার পরিমাণও বেড়েছে। ৯০ দিন বা তার বেশি সময়ও ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি এমন গ্রহীতার সংখ্যা বছরওয়ারি বেড়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। এ হার ২০২২ সালে ছিল ৪ শতাংশ।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কের অর্থনৈতিক গবেষণা উপদেষ্টা উইলবার্ট ভ্যান ডার ক্লাউ জানান, ক্রেডিট কার্ড ও স্বয়ংক্রিয় অর্থায়নের ডিফল্ট হার এখনো প্রাক-মহামারী স্তরের ওপরে বাড়ছে। বিশেষ করে তরুণ ও নিম্ন আয়ের পরিবারের মধ্যে আর্থিক চাপ বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে এ প্রবণতা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আর্থিক পরিষেবা সংস্থা ব্যাংকরেটের জ্যেষ্ঠ শিল্প বিশ্লেষক টেড রসম্যান জানান, ২০২১ সালের শুরুর তুলনায় ক্রেডিট কার্ডের ঋণ ৪৬ শতাংশ বেড়েছে। উচ্চ সুদহার ও মূল্যস্ফীতির কারণে কয়েক বছরে ক্রেডিট কার্ডের ব্যালেন্স ক্রমেই বেড়েছে।
সাম্প্রতিক শক্তিশালী ভোক্তা ব্যয় ও চাকরির বাজার আগের চেয়ে দৃঢ় হওয়ায় ক্রেডিট কার্ডের দেনায় কিছু প্রভাব পড়তে পারে বলেও জানান তিনি।
ক্রেডিট কার্ডধারীরা প্রতি মাসে তাদের ঋণ সম্পূর্ণভাবে পরিশোধ করেন কিনা তা গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি সামনে এনে টেড রসম্যান বলেন, ‘উল্লেখ্য প্রায় অর্ধেক কার্ডধারী ঋণ পরিশোধ করেন। তাদের জন্য সুদহার গুরুতর বিষয় নয়। কিন্তু বাকিরা ঋণ পরিশোধ না করায় খরুচে ঋণ চক্রের মাঝে আটকা পড়তে পারেন।’
তিনি বলেন, ‘প্রতি ১০ জনে ছয়জন কমপক্ষে এক বছর ধরে ক্রেডিট কার্ডের ঋণে আটকা পড়েছেন। দীর্ঘমেয়াদে ২০ শতাংশের বেশি সুদ পরিশোধ তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাকে উল্লেখযোগ্য প্রভাবিত করে।’
গত দুই বছরে ক্রেডিট কার্ডের ঋণের পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এ প্রক্রিয়া টেকসই নয় উল্লেখ করে রসম্যান বলেন, ‘নগদ ব্যবহার হ্রাস অব্যাহত থাকলেও ক্রেডিট কার্ডের ব্যালান্স সময়ের সঙ্গে বাড়বে। এর পেছনে রয়েছে ভোক্তা ব্যয়ে, অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ও জনসংখ্যার বৃদ্ধি। দিন শেষে এটি গৃহস্থালি পর্যায়ে প্রভাবিত করে।’
নিয়ন্ত্রণে না আসা ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক চাপের কারণে অনেক আমেরিকানদের আর্থিক সক্ষমতা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে। তাই অনেককে বাধ্য হয়ে ক্রেডিট কার্ডের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে বলে জানান যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ঋণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান লেন্ডিংট্রির প্রধান ক্রেডিট বিশ্লেষক ম্যাট শুলজ।
তিনি বলেন, ‘ক্রেডিট কার্ডের ঋণ সবসময় জীবন সংগ্রামের চিহ্ন নয়, এটি আত্মবিশ্বাসের প্রতীকও হতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি সাম্প্রতিক ক্রেডিট কার্ড ঋণ বৃদ্ধির প্রাথমিক চালক হলো টিকে থাকার চেষ্টা।’
ক্রেডিট কার্ড ঋণ অর্থনীতিতে একটি গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করেন শুলজ। কারণ কার্ডের ঋণ নেয়ার অনেক অর্থ হতে পারে। যার মানে নাগরিকদের কাছে জরুরি মুহূর্ত বা অবসরের জন্য সঞ্চয় নেই। কলেজের খরচ জোগানো ও বন্ধকের কিস্তি পরিশোধের সামর্থ্য নেই। এমনকি ছোট ব্যবসা শুরু করা বা ভ্রমণে যাওয়ার মতো অতিরিক্ত অর্থ তার কাছে নেই। এসব বিষয় মানুষের ব্যক্তিগত আর্থিক পরিকল্পনার ওপর প্রভাব ফেলে। একই সঙ্গে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির সম্ভাবনার ওপরও প্রভাব ফেলে।
তবে ২০২৪ সাল ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারীদের জন্য আশাবাদী হওয়ার কারণ রয়েছে। শুলজের মতে, কয়েক বছরের তুলনায় বছরটি ভালো যাবে। কারণ মূল্যস্ফীতি এখন শীর্ষে এবং ছয় মাসের মধ্যে সুদহার কমতে শুরু করবে।
তবে এসব শুধুই সম্ভাবনা। কারণ এর বিপরীত পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে আগামী কয়েক মাসে ক্রেডিট কার্ডের ঋণ পরিশোধ না করার পরিমাণ বাড়তে পারে, যা পরবর্তী মাসকে প্রভাবিত করতে পারে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি চূড়া স্পর্শ করেছে বলা হলেও এ অবস্থা অনড় থাকতে পারে। সুদহার হ্রাসের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে বলেও মনে করেন ম্যাট শুলজ।