
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : দেশের দক্ষিণে সুন্দরবন ঘেঁষে অবস্থিত সাতক্ষীরা জেলার উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগরে লবণাক্ত জমিতে পরিকল্পিত কৃষি স্বপ্ন দেখাচ্ছে কৃষকদের মধ্যে।
শ্যামনগর উপজেলার আটুলিয়া ইউনিয়নের কৃষক রেখা রানীর জমিতে চলছে দুই ধরনের চাষÑএক পাশে চিংড়ির ঘের, আরেক পাশে ধানচাষ। কয়েক দশক ধরে নদী থেকে লোনা পানি তুলে চিংড়ি চাষের ফলে কৃষিজমির লবণাক্ত মাটিতে নতুন করে ফসল উৎপাদনের চেষ্টা সফল হতে চলেছে। এক জমিতে বিপরীত চিত্র; ঘেরের লবণাক্ত পানির আশঙ্কা আর ধান-সবজি চাষের সাফল্য।
কৃষক রেখা রানী বলেন, ‘আমার দুই বিঘা জমির এক পাশে চিংড়ির ঘের, অন্য পাশে ধান চাষ। ঘেরের দিকটা লবণাক্ত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ধানের ফলন বেশ ভালো। বর্ষায় লবণ কিছুটা কমলে ঘেরের পাড়ে ঢেঁড়স, লাউ, বাঁধাকপিও করি; উৎপাদনও ভালো লাভ হয়।’
তিনি বলেন, ‘জানি লবণ পানি মাটির শক্তি নষ্ট করে, কিন্তু পেটের দায়ে মানুষ ঘের করে। কেউ যদি বুঝিয়ে দিত কোথায় ঘের করলে ক্ষতি কম, আর কোথায় ধান বা সবজি ভালো হবে; তাহলে সবাই পরিকল্পিতভাবে চাষ করতে পারত।’
একসময় চিংড়ি ঘেরে শ্রমিকের কাজ করতেন রেখা রানী। পরে স্থানীয় কৃষি অফিসের পরামর্শে লবণ সহনশীল ধান ও সবজি চাষ শুরু করেন। শিখেছেন জৈব সার ব্যবহারে লবণমাত্রা কমানো যায়। এখন নিজের জমিতেই ফলছে ধান, হচ্ছে সবজিও।
উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নে কৃষিজমি কমে গেছে। এখানে রয়েছে দুটি নদী, ২০টি খাল, ১১টি বিল, ৫০টি মিষ্টি পানির ঘের এবং ২ হাজার ৮০০টি লোনা পানির ঘের।
স্থানীয় কৃষক অনন্ত জোয়ার্দার বলেন, তার ১০ বিঘা ঘের রয়েছে। এলাকায় ধান চাষের জমি নেই বললেই চলে। গরমে শ্যালো মেশিনে পানি তুলে কিছু ধান হয়। কিন্তু জমিতে লোনা পানি ঢুকলে জমি এক বছর নষ্ট থাকে।’ তার মতে, আটুলিয়া এলাকার জমিতে ধান চাষ এখন সম্ভব। কারণ নদীর পানিতে লবণাক্ততা তুলনামূলক কমেছে।
পাশের পদ্মপুকুর ইউনিয়নেও একই অবস্থা। এখানে দুটি নদী, ২০টি খাল, ২টি বিল, ৫টি মিষ্টি পানির ঘের এবং দুই হাজার লোনা পানির ঘের রয়েছে।
স্থানীয় কৃষক অরবিন্দ সরকার বলেন, নদী থেকে পানি তুলে ঘের করি, মাছ হয়। কিন্তু জমিতে ধান চাষ করা যায় না। গরমের সময় পানি কমে গেলে কিছু জায়গায় আবার ধান করি। তবে আগের মতো ফলন নেই।
এদিকে, ২০০৯ সালের ঘূর্ণিঝড় আইলার পর শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নে কৃষির চেহারাই পাল্টে গেছে। এখন মূলত চিংড়ি চাষই প্রধান জীবিকা।
৩০ বছর ধরে চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত কৃষক আবদুল জলিল বলেন, ঘূর্ণিঝড় আইলার আগে আমাদের এলাকায় ধান, পাট, গাছপালা সবই হতো। এখন নদীর পানি তুলে ঘের করি। বর্ষায় লবণ কমলে ঘেরের পাড়ে সবজি করি, তাতে কিছুটা লাভ হয়। তার মতে, আটুলিয়ায় মাছও হচ্ছে, ধানও হচ্ছে।
শ্যামনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজমুল হুদা জানান, কৃষকদের ঘেরের পাড়ে সবজি চাষে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। এতে একদিকে পরিবারের পুষ্টি নিশ্চিত হয়, অন্যদিকে বাড়তি আয় হয়। তিনি বলেন, লবণাক্ত মাটিতে জৈব সার দিলে লবণমাত্রা কিছুটা কমে। বর্ষাকালে মাটি সবচেয়ে উর্বর থাকে, তখন লবণ সহনশীল ধান যেমন ভিত্তি-১০ বা প্রত্যয়-১০ চাষ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়।
সাতক্ষীরা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলার মোট ১ লাখ ৮৮ হাজার ৬২৬ হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে ৮১ শতাংশ, অর্থাৎ ১ লাখ ৫৩ হাজার ১১০ হেক্টর জমি লবণাক্ততার কারণে অকৃষি জমিতে পরিণত হয়েছে। পতিত জমির পরিমাণ ৪০ হাজার ১০১ হেক্টর। উপকূলীয় সুন্দরবনসংলগ্ন অঞ্চলে ৩৭ হাজার ১৪৬ হেক্টর জমির প্রায় ৯৯ শতাংশই লবণাক্ত।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ মাটির গঠন নষ্ট করছে। লবণ সহনশীল ধান ও সবজির চাষ বাড়ানো হচ্ছে। নদীসংলগ্ন বাঁধ উঁচু করার প্রকল্প চলছে। পরিকল্পনা ছাড়া এগুলো উপকূলীয় কৃষি বিপর্যস্ত হবে। শ্যামনগর উপজেলায় ১৭ হাজার ৭৮০ হেক্টর জমিতে কৃষি ফসল হচ্ছে। এর মধ্যে ঘেরের পাশে ৪৮০ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়। বর্ষায় ফলন ভালো হলেও শীতে লবণাক্ততা বাড়ে, ফলে ফসল কম হয়।’
বিশেষজ্ঞ ও কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, পরিকল্পিতভাবে ধান ও ঘেরের ব্যবস্থাপনা করা গেলে মাটি, মানুষ ও জীবিকা; সবই টিকে থাকবে। লবণ সহনশীল ফসল, বর্ষার পানি সংরক্ষণ এবং ঘেরের অবস্থান অনুযায়ী ধান ও সবজি চাষÑএই তিন কৌশলেই উপকূলীয় কৃষি রক্ষা করা সম্ভব।

