
সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর: সীমান্তবর্তী সাতক্ষীরা, অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি অঞ্চল। ভোমরা স্থলবন্দর ও সুন্দরবনের কারণে এই জেলার বাণিজ্যিক গুরুত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এই সম্ভাবনার সাথে এক মূর্তিমান অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে সাতক্ষীরা শহরের অসহনীয় যানজট। শহরের জনসংখ্যা ও যানবাহনের ক্রমবর্ধমান চাপের তুলনায় সড়কের অপ্রশস্ততা এই সমস্যাকে আরও তীব্র করে তুলেছে। ফলস্বরূপ, শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে এবং অর্থনৈতিক গতি স্থবির হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সাতক্ষীরা শহরের প্রধান সড়কগুলো চার লেনে উন্নীত করার দাবি এখন আর কেবল একটি নাগরিক আকাঙ্ক্ষা নয়, বরং এটি একটি গণদাবিতে পরিণত হয়েছে।সাতক্ষীরা শহরের যানজটের চিত্র প্রতিদিনের এক দুঃসহ বাস্তবতা। শহরের প্রধান সড়ক, যেমন- পাকাপোলের মোড়, নিউ মার্কেট মোড়, সার্কিট হাউস মোড়, তুফান কোম্পানী মোড়, এবং শহরের মধ্য দিয়ে যাওয়া বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা দিনভর যানজটে স্থবির হয়ে থাকে। ১০মিনিটের পথ পাড়ি দিতে ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়, যা শহরবাসীর মূল্যবান কর্মঘণ্টা নষ্ট করার পাশাপাশি সৃষ্টি করে মানসিক চাপ।এই ভয়াবহ যানজটের নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। প্রতিবার কারণ খুঁজতে গিয়ে শহরে ভ্যানও ইজিবাইক চলাচলের অহেতুক ভ্রান্ত কারণকে সামনে নিয়ে আসা হয়। গত ২৫বছরে শহরের জনসংখ্যা বেড়েছে এবং শহরের ব্যাপ্তি বেড়েছে, সেই হিসেবে অবশ্যই শহরে ভ্যান ও ইজিবাইকের সংখ্যা বাড়বে কয়েক গুন এটাই স্বাভাবিক। বর্তমান শহরের যানজটের প্রধান কারণ শহরের প্রধান সড়কগুলো অত্যন্ত সংকীর্ণ। কয়েক দশক আগে নির্মিত এই সড়কগুলো ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ ও যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে তাল মেলাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শহরের প্রধান সড়কগুলো মাত্র ১৮ থেকে ২০ ফুট প্রশস্ত, যা আধুনিক নগর পরিকল্পনার বিবেচনায় একেবারেই অপ্রতুল। এই ১৮ ফুট সড়কের দুই পাশ আবার দখল করে অবৈধ পার্কিং এবং ভাসমান দোকানের পসরা বসানো হয়েছে। এর ফলে সড়ক আরও সংকুচিত হয়ে পড়েছে এবং যান চলাচলের স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সাতক্ষীরার পাশের শহর গুলো যেমন খুলনা, যশোর, নড়াইল, কুষ্টিয়াসহ প্রায় সকল জেলা শহরের প্রধান সড়কগুলো চার-লেন করা হয়েছে। সেখানে সাতক্ষীরার সড়ক গুলো সেই আদিম যুগে পড়ে আছে।সাতক্ষীরা শহরের যানজট নিরসনে বিভিন্ন সময়ে সাময়িক কিছু পদক্ষেপ, যেমন- বাইপাস সড়ক নির্মাণ, গ্রহণ করা হলেও তা মূল শহরের অভ্যন্তরীণ যানজট কমাতে পুরোপুরি সফল হয়নি। বাইপাস সড়ক মূলত আন্তঃজেলা যানবাহনগুলোকে শহরের বাইরে দিয়ে যেতে সাহায্য করে, কিন্তু শহরের অভ্যন্তরীণ যান চলাচল ব্যবস্থাপনার জন্য মূল সড়ক প্রশস্ত করার কোনো বিকল্প নেই।প্রধান সড়কগুলো চার লেনে উন্নীত করা হলে যান চলাচলের জন্য অনেক বেশি জায়গা পাওয়া যাবে। দুটি লেন থাকবে প্রবেশের এবং দুটি লেন থাকবে বাহিরের জন্য, যা যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষের ঝুঁকি কমাবে এবং গাড়ির গতি বাড়াতে সাহায্য করবে। সড়কের মাঝে ডিভাইডার থাকায় পথচারীদের রাস্তা পারাপারও নিরাপদ হবে। প্রশস্ত সড়কের পাশে পরিকল্পিত ফুটপাত এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থা নির্মাণ করা সম্ভব হবে, যা শহরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি জলাবদ্ধতা কমাতেও সাহায্য করবে।ভোমরা স্থলবন্দরের সাথে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের জন্য সাতক্ষীরা শহরের ভেতর দিয়ে যাওয়া সড়কগুলোর আধুনিকীকরণ অপরিহার্য। চার লেনের সড়ক নির্মাণ করা হলে পণ্য পরিবহন দ্রুত ও সহজ হবে, যা জেলার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই অতিদ্রুত সাতক্ষীরা শহরের লাবসা জিরো পয়েন্ট থেকে আলীপুর চেকপোস্ট, নিউ মার্কেট থেকে আলিয়া মাদ্রাসা, খুলনা রোড মোড় থেকে বিনেরপোতা পর্যন্ত সড়ক গুলো চার লেন করা দরকারী।সাতক্ষীরা শহরের যানজট সমস্যা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সোচ্চার রয়েছে জেলার নাগরিক সমাজ। “নিরাপদ সড়ক চাই” এবং “সাতক্ষীরা জেলা নাগরিক কমিটি’র মতো সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ ও স্মারকলিপি প্রদানের মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে। তাদের পক্ষ থেকে সড়ক প্রশস্ত করার দাবি জোরালোভাবে উত্থাপিত হয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায়েও বিষয়টি উপেক্ষিত নয়। ইতোমধ্যে ‘সাতক্ষীরা-ভেটখালী প্রশস্ত সড়ক’ এবং ‘নাভারন-ভোমরা’ মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার প্রকল্প নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে, যা এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে একটি ইতিবাচক দিক। এই বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সাতক্ষীরা শহরের প্রধান সড়কগুলোকেও চার লেন প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত করা এখন সময়ের দাবি।অবশ্যই, শহরের প্রধান সড়কগুলোকে চার লেনে উন্নীত করার পথে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হলো ভূমি অধিগ্রহণ এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ। এই কাজটি নিঃসন্দেহে জটিল, তবে দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য এটি অপরিহার্য। একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। ক্ষতিগ্রস্ত ভূমি মালিকদের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সদর থানা ভবনকে সরিয়ে অন্যত্র নিতে হবে। প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় বিপুল অর্থ বরাদ্দ নিশ্চিত করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে জাতীয় অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় এই প্রকল্পে অর্থায়ন হওয়াটা জরুরি।সাতক্ষীরা শহরের যানজট সমস্যা এখন এক অভিশাপে পরিণত হয়েছে। এর আশু সমাধান না হলে জেলার সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। বিক্ষিপ্ত ও সাময়িক পদক্ষেপের পরিবর্তে একটি সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। সাতক্ষীরা শহরের প্রধান সড়কগুলোকে চার লেনে উন্নীতকরণই হতে পারে এই সংকট থেকে উত্তরণের সবচেয়ে কার্যকর এবং টেকসই সমাধান। এটি কেবল যানজটই কমাবে না, বরং একটি আধুনিক ও পরিকল্পিত নগরী হিসেবে সাতক্ষীরার ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করবে এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করবে। তাই, শহরবাসীর এই গণদাবি পূরণে কর্তৃপক্ষের দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।