
সিরাজুল ইসলাম , শ্যামনগর : সাতক্ষীরা ভৌগোলিক অবস্থান ও গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে সুন্দরবনে জীববৈচিত্র্য সৃষ্টি ও টিকের থাকার এই নিবিড় প্রতিবেশ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সুন্দরবনের প্রধান সৌন্দর্য রয়েল বেঙ্গল টাইগার তথা বাঘের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক কারণে বাঘের সংখ্যা কমছে না, কমছে মনুষ্যসৃষ্ট কারণে। চোরা শিকারিদের বিভিন্ন দল বাঘ হত্যা করছে। এ ছাড়া সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যাও কমে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। খাদ্যের অভাব, চোরা শিকারিদের দাপট ও আবাসস্থল কমে যাওয়ার কারণে সুন্দরবনের সৌন্দর্যের প্রতীক হরিণেরা ভালো নেই।
”
১৪ ফেব্রুয়ারি ‘সুন্দরবন দিবস’। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০০১ খিষ্টাব্দ থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। সুন্দরবনের গুরুত্ব অপরিসীম। সুন্দরবন শুধু জীববৈচিত্র্যের আধারই নয়, এটি রক্ষাকবচও বটে। কেনোনা বিভিন্ন দুর্যোগে সুন্দরবন প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলকে বাঁচিয়ে রেখেছে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা ও সামগ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে সুন্দরবন ব্যাপকভাবে জড়িয়ে আছে। বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে তুলে ধরে বা বাংলাদেশকে চেনে এমন পাঁচটি বিষয়ের তালিকা করলে সুন্দরবন সে তালিকায় প্রথমদিকে থাকবে। বাংলাদেশের গর্ব সুন্দরবন। সম্প্রতি ইউনেসকো সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যকে বিশ্বের জন্য অসামান্য সম্পদ হিসেবে উল্লেখ করেছে। বিশ্বজুড়ে প্রায় বিপন্ন প্রজাতির বহু প্রাণীর আশ্রয়স্থল এখন সুন্দরবন। মেছো বাঘ, ইরাবতী ও গাঙ্গেয় ডলফিন, মদনটাক, রাজগোখরা, উদবিড়াল ইত্যাদি ‘প্রায় বিপন্ন’ প্রজাতির প্রাণীর বিচরণ এখন সুন্দরবনে। তথ্য মতে, প্রতিবছর দেশের অর্থনীতিতে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার অবদান রেখে চলেছে সুন্দরবন।
ভৌগোলিক অবস্থান ও গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে সুন্দরবনে জীববৈচিত্র্য সৃষ্টি ও টিকের থাকার এই নিবিড় প্রতিবেশ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সুন্দরবনের প্রধান সৌন্দর্য রয়েল বেঙ্গল টাইগার তথা বাঘের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক কারণে বাঘের সংখ্যা কমছে না, কমছে মনুষ্যসৃষ্ট কারণে। চোরা শিকারিদের বিভিন্ন দল বাঘ হত্যা করছে। এ ছাড়া সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যাও কমে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। খাদ্যের অভাব, চোরা শিকারিদের দাপট ও আবাসস্থল কমে যাওয়ার কারণে সুন্দরবনের সৌন্দর্যের প্রতীক হরিণেরা ভালো নেই। হরিণের সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে বাঘের খাদ্য সংকট তৈরি হচ্ছে। তথ্য মতে, প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজারের বেশি হরিণ নিধন করা হয়। বন রক্ষার স্বার্থে বাঘ ও হরিণ রক্ষা জরুরি হয়ে পড়েছে। সুন্দরবনে মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে বেড়ে যাচ্ছে লবণাক্ততা। উজানে ফারাক্কা বাঁধের কারণে এবং গঙ্গা-গড়াই-কপোতাক্ষ-মাথাভাঙ্গা-ভৈরবসহ সুন্দরবনের সঙ্গে মিঠাপানির সরবরাহের সংযোগ থাকা নদ-নদীগুলোতে পানি সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে না বা অল্প লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে এমন উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্য সমস্যা তৈরি হয়েছে। কম লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে সুন্দরী ও কেওড়া গাছের জন্য রীতিমতো ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। মূলত হিমালয় থেকে নেমে আসা মিষ্টি পানির প্রবাহ ও বঙ্গোপসাগরের লোনা পানির মিশ্রণে এক বিশেষ প্রতিবেশব্যবস্থা গড়ে ওঠেছে সুন্দরবনে। এক কথায়, লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণে সুন্দরবনের সার্বিক প্রতিবেশব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
সুন্দরবনের প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটারের মধ্যে সোয়া ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার পড়েছে বাংলাদেশে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, বিভিন্ন ধরনের দূষণ, মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন প্রকৃতি-পরিবেশবিনাশী কর্মকাণ্ড সুন্দরবনের জন্য হুমকি তৈরি করছে। সুন্দরবন হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র শ্বাসমূলীয় বন যেখানে পলি পড়ে পড়ে নতুন ভূমির গঠন হচ্ছে। আবার নতুন জেগে ওঠা ভূমিতে একইভাবে হরিণ, বাঘ, সাপসহ অন্যান্য প্রাণীরাও আবাসস্থল গড়ছে। শত শত বছর ধরে সুন্দরবন নিজে নিজেই টিকে আছে। প্রাকৃতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা আবার নিজে নিজেই পূরণ করে চলেছে। এই বন দক্ষিণাঞ্চলের লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকার অবলম্বন। প্রাকৃতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে সুন্দরবন তা পূরণ করতে পারলেও মনুষ্যসৃষ্ট বনবিনাশী কর্মকাণ্ড বনের জন্য মহাবিপদ ডেকে আনছে। সুন্দরবনের পাশে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানা থেকে প্রাপ্ত বর্জ্য সুন্দরবনের দূষণকে ত্বরান্বিত করছে। সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ ধরার সংবাদও এখন শোনা যায়, যা জীববৈচিত্র্য টিকে থাকার জন্য বিরাট অন্তরায়। খালে বা নদীতে বিষ প্রয়োগ করার ফলে শুধু মাছ নয় অন্যান্য জীববৈচিত্র্যও মারা যাচ্ছে। শুঁটকির ব্যবসাকে কেন্দ্র করে সুন্দরবনে উদ্ভিদ ও প্রাণী সম্পদের ক্ষতি করা হচ্ছে। বনের আশপাশে যেকোনো ধরনের শিল্পকারখানা বা উন্নয়ন প্রকল্প নেয়ার পূর্বে অবশ্যই পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষার (ইআইএ) ফলাফলকে বিবেচনায় নেয়া দরকার। সুন্দরবন বিশ্বের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রও। অতিরিক্ত পর্যটকের কারণে সুন্দরবনের দূষণ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি তৈরি হচ্ছে! বনে কোনো ধরনের প্লাস্টিক ও পলিথিন দূষণ যাতে না হয় এ ব্যাপারে আগত পর্যটকদের সতর্কতা বিবেচনায় নিতে হবে।
সম্প্রতি এক গবেষণার তথ্য মতে, সুন্দরবনের শিবসা, পশুর নদসহ অন্যান্য নদ-নদী ও খালে লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ছে। তথ্য মতে, সুন্দরবন এলাকায় প্রতিবছর লবণাক্ততা বাড়ছে প্রায় ২ পিপিটি বা পার্টস পার ট্রিলিয়ন হারে। লবণাক্ততার ফলে বিরূপ প্রভাব পড়েছে মিঠা পানির মাছের ওপর। গবেষণায় বলা হয়েছে, মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে সুন্দরবনের প্রায় ২৭ প্রজাতির মাছ। কেনোনা এই ২৭ প্রজাতির মাছ শূন্য থেকে পাঁচ পিপিটি পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। ইতোমধ্যে খুলনা ও বাগেরহাটের নদী-নালা-খাল-বিল থেকে মিঠা বা স্বাদু পানির অনেক মাছ হারিয়ে গেছে। সুন্দরবন ও চারপাশের এলাকায় লবণাক্ততার পরিমাণ যতো বাড়বে বনের প্রতিবেশ ব্যববস্থার ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়বে। নদ-নদীগুলোর প্রবাহ কমে আসার ফলে ধীরে ধীরে নিম্ন মুখিতার দিকে লবণাক্ততা উঠে আসছে। সুন্দরবনের আশপাশের অঞ্চলে লবণ পানি আটকে চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষ করার ফলেও লবণাক্ততা ক্রমাগতভাবে বেড়ে যাচ্ছে।
সুন্দরবনকে সুন্দরবনের মতো থাকতে দেয়া হচ্ছে না! কারখানার দূষণে শুধু উদ্ভিদ-প্রাণীই ঝুঁকিতে নেই, বিভিন্ন প্রাণীর স্বাভাবিক খাদ্যচক্র নষ্ট হচ্ছে। সুন্দরবনে নদী-খালগুলো নানা প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণীর এক অনন্য ভাণ্ডার। বনের অস্তিত্ব রক্ষার সঙ্গে নদী-খাল আর জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। তথ্য মতে সুন্দরবনে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ, ১২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১২৩ প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৭০ প্রজাতির পাখি, ২০০ প্রজাতির উভচর প্রাণী ও ৩০ প্রজাতির বেশি চিংড়ি রয়েছে। বন প্রাকৃতিক সম্পদের আধার ও জলবায়ু দুর্যোগে উপকূলীয় অঞ্চলের রক্ষাদেয়াল। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ সমগ্র দেশের পরিবেশ-প্রতিবেশসহ উপকূলের লক্ষ-কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা সুন্দরবনের সঙ্গে জড়িত। সুন্দরবন অক্সিজেনেরও বিশাল আধার। বন বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। এখনই উদ্যোগ না নিলে লবণাক্ততার কারণে সুন্দরবনে ডলফিনসহ অনেক জলজ প্রাণী টিকে থাকতে পারবে না। আবাসস্থল ও খাদ্য সংকটসহ চোরা শিকারিদের কারণে বাঘের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জাতীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত শৌর্য, বীর্য আর বীরত্বের প্রতীক বাঘ রক্ষা করতে না পারলে সুন্দরবন বাঁচানো যাবে না।
বনে কোনো প্রকার ক্ষতিকর প্রভাব পড়লে তার প্রভাব পুরো দেশের ওপর পড়বে। কেনোনা বিপন্ন প্রাণীদের আবাস্থলসহ, উপকূলীয় মানুষের জীবন-জীবিকা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে সুরক্ষা ও সর্বোপরি দেশের অর্থনীতিতে সুন্দরবনের অবদান অনস্বীকার্য। সুন্দরবনে লবণাক্ততা যাতে না বাড়ে সেজন্য উজানের মিঠাপানির সরবরাহ ব্যবস্থা বাড়াতে হবে। মনে রাখতে হবে মঙ্গলগ্রহে যাওয়া সম্ভব, আরো শহর বানানো সম্ভব, কিন্তু আর একটি সুন্দরবন বানানো সম্ভব না।