
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : বিস্তীর্ণ সুন্দরবনের নদ-নদীর সংখ্যা নির্ণয়ে এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো জরিপ হয়নি। অন্যদিকে সুন্দরবনের নদীগুলো কোথাও কোথাও সরু খালের মতো প্রবাহিত হওয়ায় বন বিভাগ এগুলোকে তালিকাভুক্ত করেছে খাল হিসেবে।
বিস্তীর্ণ সুন্দরবনের নদ-নদীর সংখ্যা নির্ণয়ে এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো জরিপ হয়নি। অন্যদিকে সুন্দরবনের নদীগুলো কোথাও কোথাও সরু খালের মতো প্রবাহিত হওয়ায় বন বিভাগ এগুলোকে তালিকাভুক্ত করেছে খাল হিসেবে। কিন্তু গভীর বনে প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত এসব পানির উৎসকে নদী হিসেবেই সংজ্ঞায়িত করতে চান অনেক গবেষক। এ হিসাবে সুন্দরবনে এখন পর্যন্ত ২২৭টি নদীর অস্তিত্বের কথা জানিয়েছেন তারা। তবে সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিতব্য নদ-নদীর তালিকায় স্থান পেতে যাচ্ছে ৮০টির মতো নদীর নাম। বাকিগুলো আরো জরিপ শেষে পরবর্তী সময়ে অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সুন্দরবনের নদ-নদীর তালিকা অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সুন্দরবনের অনেক এলাকায় এখনো ল্যান্ড সার্ভে (জরিপ) হয়নি। আমরা সেইসব নদীর নামই তালিকাভুক্ত করছি, যেগুলো কোনো না কোনো রেকর্ডে এসেছে। রেকর্ডের বাইরের নদী সার্ভে ছাড়া তালিকায় দেয়ার সুযোগ আমাদের নেই।’
খুলনা বিভাগের নদ-নদীর তালিকা প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা ও বেসরকারি নদীকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেয়েছে, সুন্দরবনের নদ-নদী ও খালের সংজ্ঞা নিয়ে মতভেদ আছে। অন্যদিকে এর আগে সরকারিভাবে সুন্দরবনের নদ-নদীর সংখ্যা নির্ণয়েও কোনো জরিপ হয়নি। ফলে এ বনের নদীর প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
সুন্দরবনের নদ-নদীর সংখ্যা নির্ণয় সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) খুলনা জেলার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘নদীকর্মীরা আমাদের সুন্দরবনের নদ-নদীর তালিকা দিয়েছেন। সেগুলোর মধ্যে যাচাই-বাছাই করে আমরা খুলনা অংশে ২৯টি নদী অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অনেক নদীর নাম দুবার এসেছে। কোথাও স্থানীয় নাম আবার কোথাও কেতাবি নামও এসেছে। এক্ষেত্রে আমরা স্থানীয় নাম তালিকাভুক্ত করেছি। তাছাড়া বন বিভাগ আমাদের একটি তালিকা দিয়েছে, যে তালিকায় অধিকাংশ নদীর নাম খাল হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো আমরা খালের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাস্তবিকই যদি কোনো নদীর নাম বাদ পড়ে থাকে পরে সেটা অন্তর্ভুক্ত করা হবে।’
অন্তর্বর্তী সরকার শপথ গ্রহণের পর সারা দেশের নদ-নদীর তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। গত বছরের ডিসেম্বরে ১ হাজার ১৫৬টি নদীর একটি খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে। এরপর আরো যাচাই-বাছাই শেষে ২৭ মার্চ ১ হাজার ২৯৪টি নদীর নাম প্রকাশিত হয়। আগামীকাল পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী দেশের নদ-নদীর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের কথা রয়েছে।
পাউবো সূত্র জানিয়েছে, সুন্দরবনের নদ-নদীর একটি তালিকা বন অধিদপ্তর করেছিল ব্রিটিশ আমলে। সে তালিকায় বেশির ভাগ নদীই খাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে খুলনা অঞ্চলের নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকি দাবি করেছেন, সুন্দরবনে কোনো খাল থাকার সম্ভাবনা নেই। সেখানে অনেক নদীকে খাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে মাহবুব সিদ্দিকি বলেন, ‘অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে সুন্দরবনে বন বিভাগের কার্যক্রম বিস্তৃত আকারে চালু হয়। তখন ওই এলাকার মৌয়াল, বাওয়াল ও মৎস্যজীবীদের সঙ্গে কথা বলে নদীর তালিকা করেন ব্রিটিশ সরকারের বন বিভাগের কর্মকর্তারা। স্থানীয়রা দুটি নদীর সংযোগ নদীকে ভারানী বা খাল হিসেবে উল্লেখ করে তাদের বোঝার স্বার্থে। কিন্তু এগুলো প্রকৃতপক্ষে খাল নয়; বরং নদীই। আবহমানকাল থেকে এগুলো নদী।’ মাহবুব সিদ্দিকি কর্মসূত্রে সাতক্ষীরার শ্যামনগর, ডুমুরিয়া ও দাকোপ থানায় পাঁচ বছর অফিসার ইনচার্জের দায়িত্ব পালন করেছেন। এ সময় তিনি সুন্দরবনের নদ-নদী নিয়ে কাজ শুরু করেন।
সুন্দরবনের বড় নদীর মধ্যে শিবসা, পশুর, হরিণঘাটা, মালঞ্চ, কুঙ্গা, বাংড়া, আড়পাঙ্গাশিয়া, খোলপেটুয়া, রায়মঙ্গল, হাড়িয়াভাঙ্গা, যমুনা ও মেঘনা উল্লেখযোগ্য। স্থানীয় ভূগোলবিদ ও পেশাজীবীরা এগুলোকে নদী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তবে নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকি বলেন, ‘হাড়িয়াভাঙ্গা, রায়মঙ্গল, ইছামতি, ভদ্রা, হরিণঘাটা, কুঙ্গা, মরজাদ, বাংড়া, মালঞ্চ, পশুর, শিবসা, আড়পাঙ্গাসিয়া, চুনার, ভোলা, আরুয়া শিবসা, শেলাসহ মোট ৫০টি বড় নদীর বেশির ভাগই বন বিভাগ খাল হিসেবে চিহ্নিত করেছে। মূলত এ কারণেই বর্তমানে সরকারের নদীর সংখ্যা নির্ধারণে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নদীকে খাল বিবেচনা করে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। অথচ আমেরিকার সার্ভেসহ আন্তর্জাতিক সব সার্ভে ও ম্যাপে এগুলোর বেশির ভাগকে নদী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে বন বিভাগ এগুলো কীভাবে খাল বলে।’
মাহবুব সিদ্দিকি ২০২৩ সালে সুন্দরবন ও গাঙ্গেয় বদ্বীপের মোহনা শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করেন। ওই বইতে তিনি সুন্দরবনের ২২৭টি নদী নামসহ উল্লেখ করেন। নিজের তৈরি করা নদীর তালিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সরকারি উদ্যোগে এখনো সুন্দরবনের নদী নিয়ে সার্ভে হয়নি। এবারই প্রথম সুন্দরবনের নদী সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত হতে যাচ্ছে। অনেক আগে বাংলাপিডিয়া, ন্যাশনাল এনসাইক্লোপিডিয়া অব বাংলাদেশ ও এশিয়াটিক সোসাইটি যৌথভাবে সুন্দরবনের নদী নিয়ে একটি কাজ করেছিল। সেখানে ১৭৭টি নদীর নাম উল্লেখ করা হয়। এর বাইরে আমি আরো ৫০টি নদীর নাম পেয়েছি। মোট ২২৭টি নদীর নাম আমার বইয়ে উল্লেখ করেছি। এগুলো কোনোভাবেই খাল হিসেবে উল্লেখ করার সুযোগ নেই।’
খুলনা ও বরিশাল বিভাগের সাতটি জেলায় সুন্দরবনের বিস্তৃতি। এর মধ্যে খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলা এবং বরিশাল বিভাগের পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বরগুনা, পটুয়াখালী জেলাজুড়ে বিস্তৃত সুন্দরবন। এছাড়া নোয়াখালীর দক্ষিণে নতুন নতুন দ্বীপ জাগছে। এ অঞ্চলে সুন্দরবন নতুন করে গঠিত হচ্ছে।
রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মনির হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি অনেকবার সুন্দরবনে গিয়েছি। আমরা যখন খুলনা জেলখানা ঘাট থেকে নৌযানে উঠি তখন আঠারোবাঁকি নদী, তারপর ভৈরব নদ, রূপসা নদী, কাজবাছা নদী, মোংলা, পশুর ও শেলা নদী হয়ে আমরা সুন্দরবনের ঢুকি। এখানে কিন্তু অনেক খাল আছে, স্থানীয়রা এগুলোকে খাল বলেন। যেমন ঢাংমারী খাল, হোমরা খাল, কটকা খাল, সিটি কটকা খাল, বেতমোড়া খাল—স্থানীয়রা খাল বললেও বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে সবই নদীর মতো। ঢাকার খিদির খাল যদি রাষ্ট্র কনাই নদ হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে পারে, তাহলে এ খালগুলোকেও রাষ্ট্র চাইলে নদী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। এতে এগুলো নদী হিসেবে বিশেষ মনোযোগ পাবে। আমরা নদীকর্মীরাও এটাই বলব, স্থানীয়রা তাদের বোঝার সুবিধার্থে ছোট নদীকে খাল হিসেবে উল্লেখ করলেও এগুলো মূলত নদী। কেননা নদীর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, প্রাকৃতিক উৎস থেকে প্রবাহিত হতে হবে। আর খাল হলো মানুষের কাটা পানির প্রবাহ। সুন্দরবন তো পুরোটাই প্রাকৃতিক। এখানে যা আছে সবই প্রাকৃতিক। বিষয়টি এখন রাষ্ট্রের সদিচ্ছার ওপর নির্ভর করছে।’
গত ২৭ মার্চ ১ হাজার ২৯৪টি নদ-নদীর খসড়া তালিকা প্রকাশের পর তা বিভিন্ন অঞ্চলের নদী গবেষকদের সমালোচনার মুখে পড়ে। বিশেষ করে সুন্দরবন এলাকার নদ-নদী এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি বলে অভিযোগ করেন ওই অঞ্চলের নদীকর্মীরা। এ নিয়ে গত ৩১ মার্চ বণিক বার্তায় ‘দেশে নদ-নদীর নতুন সংখ্যা ১ হাজার ২৯৪, বাদ পড়েছে সুন্দরবন, বরেন্দ্র অঞ্চল ও পার্বত্য তিন জেলার পাঁচ শতাধিক নদী’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হয়। ওই সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে সুন্দরবনের খুলনা অংশের ২৯টি নদী তালিকাভুক্তির জন্য সুপারিশ করেছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের খুলনা অফিস। এর বাইরেও আরো বেশ কয়েকটি নদী অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। গতকাল পর্যন্ত তালিকায় সুন্দরবনের প্রায় ৮০টি নদী অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নদীর সংখ্যা নির্ধারণের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা-১ পরিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর) ড. রবীন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘খুলনা অঞ্চলের ২৯টি নদীসহ সুন্দরবনের মোট ৭০-৮০টি নদী আমরা তালিকাভুক্ত করেছি। পরবর্তী সময়ে সার্ভে সাপেক্ষে আরো নদ-নদী তালিকাভুক্ত করা হবে।’

