সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : একসময় গণ্ডার ছিল দেশে। সেটি ব্রিটিশ আমলের কথা। আর সে সময় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের তথ্যভান্ডার করা হয়েছিল বলেই তথ্যটি জানা সম্ভব হয়েছে। -বলছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমএ আজিজ। সুন্দরবনের প্রাণী নিয়ে জাতীয় জরিপের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, বিভিন্ন সময় গবেষক ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে বাঘ-হরিণ নিয়ে জরিপ হলেও নতুন করে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীর তথ্যভান্ডার করা হয়নি। বর্তমানে অনেক প্রাণী বিলুপ্তির মুখে। তাই এখনই জীববৈচিত্র্যের তথ্যভান্ডার জানতে জরিপ করা না হলে আগামীতে কোনও প্রাণী বা উদ্ভিদ বিলুপ্ত হলে তা অজানাই থেকে যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততা বৃদ্ধিসহ একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামাল দিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। নানা প্রতিকূলতার কারণে এরইমধ্যে এই বন থেকে হারিয়ে গেছে গণ্ডার, মিঠাপানির কুমির ও বুনো মহিষসহ নানা প্রজাতির প্রাণী। আরও কয়েক প্রজাতির প্রাণী এখন সংকটাপন্ন। কিন্তু সুন্দরবনে কত প্রজাতির কী কী প্রাণী ও উদ্ভিদ আছে, তা কখনও জানার চেষ্টাই করেনি বাংলাদেশ।
গবেষকরা বলছেন, গত একশ বছরে বন্যপ্রাণীর পাশাপাশি এই বন থেকে নীরবে হারিয়ে গেছে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ, গাছ এবং নানা প্রজাতির সরীসৃপ ও প্রাণী। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও আজও সুন্দরবনের পূর্ণাঙ্গ জীববৈচিত্র্যের জরিপ করতে পারেনি বনবিভাগ। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু-বিষয়ক মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে উদাসীন।
প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ নিরবচ্ছিন্ন জোয়ার-ভাটার ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল সুন্দরবন। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। সুন্দরবন শুধু পৃথিবীর মৌলিক বাস্তুসংস্থানই নয়, একই সঙ্গে বিশাল জীববৈচিত্র্যের ভান্ডার। জীববৈচিত্র্যে ভরপুর থাকায় ১৯৯২ সালে সুন্দরবনকে রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৯৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে ইউনেস্কো।
পরিবেশবিদরা বলছেন, ঝড়ঝঞ্ঝা, ঘূর্ণিঝড় আম্ফান, সিডর ও আইলার মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে উপকূলকে শক্তিশালী ঢাল হিসেবে রক্ষা করে আসছে সুন্দরবন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, প্রতিকূল ও নেতিবাচক পরিস্থিতির কারণে বনের সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য এখন সংকটাপন্ন। বনের ভেতর মিষ্টিপানির জলাশয়গুলোতে বেড়েছে লবণাক্ততা। এতে মিষ্টিপানি পানে অভ্যস্ত বাঘসহ বন্যপ্রাণীরা নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায়ই অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। রক্ষা পাচ্ছে না জলজপ্রাণী ডলফিনও।
২০১৯ সালে সুন্দরবনের জন্য ১০টি হুমকি চিহ্নিত করে ইউনেস্কো। এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়া, দূষণ, অবৈধ তৎপরতা ও পশুর নদের খননকে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। গবেষকরা বলছেন, বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণীর আবাস, বিচরণ ও খাদ্যশৃঙ্খল সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল। ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের শ্বাসমূলের কারণে তা মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর কাছে এক আকর্ষণীয় আশ্রয়ও। এই বনে আছে লতাগুল্ম থেকে শুরু করে মাঝারি ও উঁচু- সব ধরণের বৃক্ষ। একসময় প্রচুর ফলদ বৃক্ষ থাকলেও লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় সেগুলো কমে গেছে। সরীসৃপের মধ্যে শঙ্খচূড় বা রাজগোখরা বিশ্বজুড়ে মহাবিপন্ন প্রজাতির তালিকায় রয়েছে। স্তন্যপায়ী প্রাণী ভোঁদড়ও এখন শুধু সুন্দরবনেই দেখা যায়। তবে এই প্রাণীগুলো কয়টি বা কী অবস্থায় রয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই।
২০১৬ সালের ইউনেস্কোর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামীতে ম্যানগ্রোভ অরণ্যের আরও ক্ষতি করবে রামপাল কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র।
গবেষকদের মতে, গত একশ বছরে সুন্দরবন থেকে বহু প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বুনো মহিষ, পারা হরিণ, বুনো ষাঁড়, ছোট ও বড় এক শৃঙ্গি গণ্ডার, বার শিঙ্গা, চিতা বাঘ। বিলুপ্ত হয়েছে সাদা মানিক জোড়া কান ঠুনি, বোঁচা হাঁস, গগন বেড়, জলার তিতিরসহ বিভিন্ন পাখি। এ ছাড়া দুই প্রজাতির উভচর, ১৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৫ প্রজাতির পাখি এবং পাঁচ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী এখন সংকটাপন্ন। কিন্তু সুন্দরবনের কোন প্রজাতি কী অবস্থায় আছে, তা ব্রিটিশ আমলের পর আর পূর্ণাঙ্গ জরিপ করে জানার চেষ্টা করা হয়নি।
বাগেরহাট জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, ১৭৫৭ সালে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীরের কাছ থেকে স্বত্বাধিকার পাওয়ার পরপরই সুন্দরবন এলাকার মানচিত্র তৈরি করেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ওই সময় সুন্দরবনের আয়তন ছিল এখনকার দ্বিগুণ। ১৮২৮ সালে ব্রিটিশ সরকার সুন্দরবনের স্বত্বাধিকারিত্ব অর্জন করে। এলটি হজেয ১৮২৯ সালে সুন্দরবনের প্রথম জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সুন্দরবনের জন্য ১৮৯৩-৯৮ সময়কালে প্রথম বন ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণীত হয়।
বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীর সংখ্যা ও আবাসস্থল, রোগবালাই এবং সংরক্ষিত এলাকার বৈশিষ্ট্য ও প্রতিবেশ নিয়ে জরিপের জন্য ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ১৫৭ কোটি ৮৭ লাখ টাকার ‘সুন্দরবন সুরক্ষা প্রকল্প’ অনুমোদন করে সরকার। এ প্রকল্পের আওতায়ও জীববৈচিত্র্যের পূর্ণাঙ্গ জরিপ করা সম্ভব নয়, বলছেন বন কর্মকর্তারা। তবে বাঘ ও বাঘের শিকার প্রাণীÑ হরিণ ও শূকরের মতো প্রাণীর সংখ্যা নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বনবিভাগের কর্মকর্তা কাজী নুরুল করিম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ জরিপ তো কখনও করা হয় না। তবে সুন্দরবনের ইতিহাসে এ বছরই প্রথম আমরা ইকোলজিক্যাল মনিটরিং করতে যাচ্ছি। এ প্রকল্পের আওতায় নির্দিষ্ট কিছু স্থল ও জলজপ্রাণী, উদ্ভিদের জরিপ করা হবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বনবিভাগের একজন পদস্থ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, সুন্দরবনে পূর্ণাঙ্গ জীববৈচিত্র্যের জরিপ করতে আন্তরিকতা ও অর্থÑ দুই-ই প্রয়োজন। এত ব্ড় বনে জরিপ চালাতে বড় ধরনের আর্থিক বরাদ্দ লাগবে। কিন্তু সরকার বরাদ্দ দেয় না তাই সম্ভব হচ্ছে না।
পূর্ণাঙ্গ জরিপ না হওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সুন্দরবনে বাঘ, হরিণ বা কুমিরের মতো যে মূল প্রাণী আছে, তা নিয়ে বিভিন্ন গবেষণা হয়েছে এবং সেগুলোর তথ্য-উপাত্ত আছে। তবে প্রতিটা প্রাণী ধরে ধরে জরিপ করার প্রয়োজন হয় না এবং নানা কারণে সম্ভবও হয় না।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ও বন্যপ্রাণীবিদ প্রফেসর মনিরুল হাসান খান বলেন, সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা এখন প্রকল্পনির্ভর। তাই জরিপগুলো বিক্ষিপ্তভাবে হচ্ছে। প্রকল্পনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী, গবেষক ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানকে সম্পৃক্ত করলে সুন্দরবনের পূর্ণাঙ্গ জরিপ সম্ভব।
ব্রিটিশ আমলে সুন্দরবনের উদ্ভিদের ওপর জরিপ করেন স্কটিস উদ্ভিদবিদ ডেভিট প্রেইন। ১৯০৩ সালে প্রকাশিত প্রেইনের প্রতিবেদনে সুন্দরবনে মোট ২৪৫টি শ্রেণি এবং ৩৩৪টি প্রজাতির উদ্ভিদ নথিভুক্ত করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রেইনের প্রতিবেদনের পর গত একশ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। এতে সুন্দরবনের বিভিন্ন ম্যানগ্রোভ প্রজাতি ও তাদের শ্রেণীকরণের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়ে গেছে। ব্যক্তিপর্যায়ে কয়েকটি প্রজাতি ছাড়া এত বছর ধরে বনজ প্রকৃতিতে কী ধরনের পরিবর্তন হয়েছে, তা নিয়ে গবেষণা বা জরিপ করা হয়নি এবং এখনও হচ্ছে না।
প্রকৃতি ও উদ্ভিদ-বিষয়ক গবেষক মোকারম হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সুন্দরবনে প্রাণী নিয়ে আংশিক কিছু জরিপ হলেও ব্রিটিশ আমলের পর উদ্ভিদ নিয়ে কোনো গবেষণা ও জরিপ হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উদ্ভিদ ও প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে। সারা বিশ্ব এখন জীববৈচিত্র্য রক্ষায় উদ্ভিদ সংরক্ষণে জোর দিচ্ছে। কারণ উদ্ভিদের উপস্থিতি না থাকলে বাস্তুতন্ত্রে ব্যাঘাত ঘটবে। সুন্দরবনের প্রাণবৈচিত্র্যের স্থিতিশীলতা রক্ষায় উদ্ভিদের জরিপে জোর দিতে হবে।’