সিরাজুল ইসলাম (শ্যামনগর) সাতক্ষীরা : দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে অবস্থিত দুবলারচর, যার অবস্থান বাগেরহাটের মোংলা থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দূরে। এর এক পাশে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন এবং অন্য পাশে সমুদ্রের নোনাজল। এই চরে প্রতিবছর কার্তিক মাসের মাঝামাঝি থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত শুঁটকি মৌসুম চলে। এ সময় এখানে জেলেদের অস্থায়ী বসতিও গড়ে ওঠে। মাছ ধরা, কাটা, বাছাই ও শুকানোর কাজে দিনরাত সরগরম থাকে চরাঞ্চলের আলোরকুল, নারকেলবাড়িয়া, শেওলারচর ও মাছের-কেল্লার মতো শুঁটকি উৎপাদনকেন্দ্রগুলো।
এখানে মাছ ধরা, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয় আধুনিক পদ্ধতি। দেশে যত শুঁটকি উৎপাদিত হয়, তার প্রায় ৮৫ শতাংশই সরবরাহ হয়ে থাকে এই চরাঞ্চল থেকে। স্থানীয় বাজারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এখানকার শুঁটকি আন্তর্জাতিক বাজারেও জায়গা করে নিয়েছে। কারণ, এখানকার কোনো শুঁটকিতেই ক্ষতিকর রাসায়নিক বা কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় না। শুধু লবণ দিয়ে মাছ সংরক্ষণ করা হয়। তাই দুবলারচরের শুঁটকি স্বাস্থ্যসম্মত ও পরিবেশবান্ধব, যা বাংলাদেশের শুঁটকিশিল্পকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনন্য করে তুলেছে।
দুবলারচরের শুঁটকিশিল্প কেবল একটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও অর্থনীতির মেরুদণ্ড। চরাঞ্চলের এই শুঁটকির বাজারে বছরে ৫০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকার লেনদেন হয়। মাছ ধরার মৌসুমে এখানে ১৫-১৬ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ হাজার ৫০০ টন শুঁটকি থেকে ৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫ হাজার ১০০ টন শুঁটকি থেকে ৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। প্রতি কেজি শুঁটকিতে ১০ টাকা রাজস্ব নেওয়া হয়।
দুবলারচরের পাইকার আলাউদ্দিন বলেন, প্রতিবছর মাছের দাম নির্ধারিত হয় চট্টগ্রাম ও সৈয়দপুর এলাকা থেকে। চলতি বছরের দাম এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। খুব শিগগির দুই অঞ্চলের বাজার দেখে দাম নির্ধারণ করা হবে। পাইকারদের মাধ্যমে এখানকার শুঁটকি চলে যায় চট্টগ্রাম ও সৈয়দপুরের মোকামে। লইট্টা, রুপচাঁদা, ছুরি মাছের শুঁটকি এখানে সবচেয়ে জনপ্রিয়। পাইকারি বাজারে লইট্টা ৩৭৫ থেকে ৬২৫ টাকা, রুপচাঁদা ৭০০ থেকে ১ হাজার ও ছুরি ১ হাজার থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। বিদেশেও এখানকার শুঁটকির একটি অংশ রপ্তানি করা হয়।
মৌসুমে জেলেরা নিজেদের পরিবার-পরিজন ছেড়ে পাঁচ মাসের জন্য এই অস্থায়ী বসতি দুবলারচরে বসবাস গড়েন। এ সময় তাঁদের প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণে একটি ক্ষুদ্র বাজারও বসে। সরেজমিন দুবলারচর ঘুরে এবং জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে চাল-ডালের দোকান, ওষুধের ফার্মেসি ও নাট-বোল্টের দোকান রয়েছে। এখানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা এখানকার মানুষের জীবনে বারবার বিপর্যয় ডেকে আনে। চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা এবং সুপেয় পানির অভাবও বড় সমস্যা। অনেকের ইন্টারনেটযুক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেখা গেলেও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন টেলিটক ছাড়া অন্য কোনো ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুযায়ী এখানে সবার বেতন নির্ধারণ হয়। যেসব জেলে বেশি মাছ ধরায় পারদর্শী, তাঁদের বেতন মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা। তবে সাধারণ শ্রমিক কিংবা কুলি-মজুরও মাসে ১৫ হাজার টাকার বেশি আয় করেন। তবে এখানে কাজের জন্য আগে থেকে চুক্তি করতে হয় এবং অগ্রিম অর্থ দিতে হয়।
দুবলারচরের শ্রমিক বোরহান উদ্দিন বলেন, তাঁরা কার্তিক থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত নিজের বাড়িঘর, স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে এখানে মাছের কাজে আসেন। জীবন-জীবিকার তাগিদে তাঁরা পাঁচ মাস কাজ করেন। কাজ শেষে বাড়িতে ফিরে কেউ দিনমজুরি, কেউবা ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করেন।
উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা
দুবলারচরের শুঁটকিশিল্প স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবিকা এবং দেশের অর্থনীতিতে অসামান্য ভূমিকা রাখছে। চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও এখানকার মানুষ যেভাবে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে নিজেদের জীবন চালিয়ে যাচ্ছেন, তা অনুকরণীয়। দুবলারচর ফিশারম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এই শিল্প আন্তর্জাতিক বাজারে আরও এগিয়ে যাবে। এর জন্য এখানকার শুঁটকিশিল্পের টেকসই উন্নয়নে দরকার সরকারি সহায়তা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সুরক্ষার ব্যবস্থা, উন্নত চিকিৎসা ও সুপেয় পানির সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে এই অঞ্চলের জেলেদের পাঁচ মাসের জীবনযাত্রা একটু হলেও সহজ হবে।