
সিরাজুল ইসলাম শ্যামনগর : সুন্দরবন বলতেই মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে এক বিস্তীর্ণ সবুজ বনভূমি । রয়েল বেঙ্গল টাইগার এর বাসভূমি । চিতল হরিনের ছোটাছুটি, বানর দলের এ গাছ থেকে ও গাছে লাফিয়ে লাফিয়ে চলা । অসংখ্য পাখপাখালির কলরব, আর জলে নরখাদক কুমির । বাংলায় একটা প্রবাদই আছে “জলে কুমির ডাঙায় বাঘ” অর্থাৎ “উভয় সংকট ” । এই প্রবাদটির উৎপত্তি হয়েছেই সুন্দরবনের বিপদসঙ্কুল জঙ্গল ও জলাভূমির কথা মাথায় রেখে । সত্যি ভয়ঙ্কর সুন্দর এই সুন্দরবন । এশিয়ার সর্ববৃহৎ Mangrove Forest । সুন্দরী গাছের আধিক্যের কারণে এই জঙ্গলের নাম হয়েছে “সুন্দরবন” । কিন্তু আমাদের চিরচেনা সুন্দরবন কিন্তু আগে এইরূপ ছিল না । তখন বর্ধিষ্ণু জনপদ ছিল এই বনভূমির জায়গায় । কাল ক্রমে সেই জনপদ ধ্বংস হয়ে জঙ্গলে ঢেকে গেলো । এখনকার সুন্দরবনে যে সকল প্রাণী আছে আগে কিন্তু এর থেকে বহু প্রজাতির প্রাণী ছিল যে গুলোর অনেকেই এখন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত । মানুষের লোভের বশে, প্রকৃতির প্রতিকূলতায় আর খাদ্য সংকটে তারা পুরোপুরি মুছে গেছে সুন্দরবন থেকে । আজ সেই সকল বিলুপ্ত প্রাণীবর্গ নিয়েই বলবো ।
১. জাভার গন্ডার (Javan rhinoceros) : বৈজ্ঞানিক নাম – Rhinoceros sondaicus । এই ধরণের গন্ডার জাভা তে পাওয়া যায় । এরা এক শৃঙ্গি, আফ্রিকার গন্ডারের তুলনায় আকারে কিছুটা ছোট । বর্তমানে সারা বিশ্বে “অতি বিপন্ন প্রজাতি” লিস্টে এদের নাম উঠে গেছে । অদূর ভবিষ্যতে এদের আর হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না ।
২. ভারতীয় গন্ডার (Indian rhinoceros): বৈজ্ঞানিক নাম – Rhinoceros unicornis । ভারতের শুধুমাত্র আসামের কাজিরাঙা অভয়ারণ্যে এখন এরা টিকে আছে । আগে সুন্দরবনেও ছিল । চোরাশিকারিদের দৌরাত্ম আর তীব্র খাদ্য সংকট জাভা আর ভারতীয় গন্ডারদের বিলুপ্তির প্রধান কারণ ।
৩. ভারতীয় হাতি (Indian elephant) : বৈজ্ঞানিক নাম – Elephas maximus । অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে এক সময় সুন্দরবনে হাতি ছিল । সুন্দরবনের অপেক্ষাকৃত উচ্চভূমিতে এরা বিচরণ করত । কিন্তু সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পরিবেশ হাতিদের জন্য মোটেও অনুকূল ছিল না । এছাড়া গন্ডার আর বুনো মহিষদের সাথে খাদ্য প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে খুব শীঘ্র এরা সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় ।
৪. বুনো মহিষ (Indian Wild water buffalo) : বৈজ্ঞানিক নাম – Bubalus arnee । সুন্দরবনে এক সময় প্রচুর ভারতীয় বুনো মহিষ পাওয়া যেত । এদের ওয়াটার বাফেলো -ও বলা হয়, কারণ এরা দীর্ঘক্ষণ জলে নিজেদের জিইয়ে রাখে, এটাই এদের স্বভাব । হাতি, গন্ডার ও মহিষ পারস্পরিক খাদ্য প্রতিযোগিতায় আর প্রচুর লবনাক্ত জলাভূমির কারণে বিলুপ্ত হয়ে যায় ।
৫. চিতা বাঘ (Indian leopard) : বৈজ্ঞানিক নাম – Panthera pardus fusca । সুন্দরবনে সর্বশেষ চিতাটির দেখা পাওয়া গেছে ১৯৩১ সালে । এর পরে এদের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি । ধারণা করা হয় অতি উচ্চ মাত্রায় লবনাক্ত জলাভূমি এদের বংশবৃদ্ধিতে বাধা প্রদান করে । এছাড়া চোরা শিকারীরা তো আছেই ।
৬. ভারতীয় সিংহ (Asiatic lion) : বৈজ্ঞানিক নাম – Panthera leo । সিংহ । হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন । এক সময় সত্যি সিংহ ছিল সুন্দরবনে, ভারতীয় সিংহ । এখন এই এশীয় সিংহদের একমাত্র ঠিকানা ভারতে গুজরাটের গির অরণ্যে । এই সিংহ আকারে আফ্রিকার সিংহদের তুলনায় ছোট, কেশর অপেক্ষাকৃত কম ঘন । সুন্দরবনে এদের বিলুপ্তির সব চাইতে বড় কারণ হলো প্রতিযোগিতায় বাঘের সাথে হেরে যাওয়া । সুন্দরবনের বাঘ আসলেই সিংহের চাইতে অধিক হিংস্র আর শক্তিতেও অনেক বেশি বলবান । তাই অতি অল্প সময়ের মধ্যে সিংহরা হেরে ভূত হয়ে গেলো ।
৭. ময়ূর (Indian peacock) : বৈজ্ঞানিক নাম – Pavo cristatus । সুন্দরবনে এক সময় ময়ূর ছিল । অতিরিক্ত জোয়ার প্লাবনের কারণে আর অত্যধিক শক্তিশালী সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কারণে এরা খুব দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যায় ।
৮. বারশিঙ্গা (Barasingha/Swamp Deer) : বৈজ্ঞানিক নাম – Rucervus duvaucelii । শম্বর জাতীয় এই হরিণ এক সময় সারা সুন্দরবন জুড়ে ছিল । আকারে চিতল হরিনের তুলনায় অনেক বড়। মাথায় ১০-১৪ টি শাঁখাযুক্ত শিং থাকার কারণে এর নাম বারশিঙ্গা, অর্থাৎ বারোটি শিং । চোরাশিকারিদের দাপটে স্রেফ এরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে সুন্দরবন থেকে ।
৯. মগর বা ভারতীয় কুমীর (Mugger crocodile) : বৈজ্ঞানিক নাম – Crocodylus palustris । সুন্দরবনে এখন যে salt water crocodile আছে তার তুলনায় এই মগর কুমির অনেকটাই ছোট ছিল । ব্রিটিশ ভারতে শুধুমাত্র অত্যধিক শিকারের কারণে কুমিরের এই প্রজাতিতে বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সুন্দরবন থেকে পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায় । মানুষের সীমাহীন লোভের কারণেই শুধু আপাত নিরীহ এই কুমির প্রজাতি সুন্দরবন থেকে সম্পূর্ণ মুছে গেলো, খুবই দুঃখের ব্যাপার এটা ।
১০. গাঙ্গেয় শুশুক (Gangetic Dolphin) : বৈজ্ঞানিক নাম – Platanista gangetica । এই শ্রেণীর শুশুক আমরা ছোটবেলায় অনেকেই দেখে থাকবো বড় কোনো নদীতে নৌকায় বেড়ানোর সময় ।এরা ধূসর রঙের অপেক্ষাকৃত ছোট (একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের সমান আকৃতি এদের) নদীর শুশুক । গাঙ অর্থাৎ নদীতে এদের পাওয়া যায় তাই নাম গাঙ্গেয় শুশুক । খুবই নিরীহ এরা, শুধুই মাছ খায় এরা । সুন্দরবনের বড় নদী গুলোতে অত্যধিক জলদূষণের কারণে এরা সুন্দরবন থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে ।
এছাড়াও আরো বহু প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে , তাদের মধ্যে আছে বেশ কয়েক প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপ, জলাশয়ের কচ্ছপ, ঘড়িয়াল, গোসাপ, কাঁকড়া দুই তিন রকমের ভোঁদড়, হনুমান, বেশ কয়েক প্রজাতির বন বেড়াল, অসংখ্য প্রজাতির পাখি ও মাছ । সত্যি অতীব দুঃখের ব্যাপার । আমাদের গর্ব যে বাঘ, সেও আজ বিলুপ্তির পথে । মানুষের লোভ যদি এভাবে দিন দিন বাড়ে তাহলে সে দিন আর বেশি দূরে নেই যে দিন আমাদের গর্বের “Royal Bengal Tiger” শুধু মাত্র বইয়ের পাতাতে ছবি হিসাবে ঠাঁই পাবে ।

