সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুন্দরবনে লবণাক্ততা বাড়ছে। বনের নদী-খালে মিঠা পানির প্রবাহ ক্রমশ কমে যাচ্ছে। এদিকে পলিমাটি জমে বনের বেশকিছু খাল ভরাট হয়ে গেছে। এতে করে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, সুন্দরবনে অতিমাত্রায় লবণাক্ততায় সুন্দরী গাছ মরে যাচ্ছে, বন্যপ্রাণীরাও নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এর ওপর অবাধে বন্যপ্রাণী শিকার ও নদী-খালে কীটনাশক ছিটিয়ে মাছ ধরার তৎপরতা তো রয়েছেই। এসব নানা কারণে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে।
এ অবস্থায় সুন্দরবনকে রক্ষায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দাবি তোলা হয়েছে। জাতীয়ভাবে “সুন্দরবন দিবস” পালনের দাবি ২১ বছরেও সাড়া পায়নি। অনেক দাবির মধ্যে সুন্দরবনের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের দাবিও রয়েছে।
এদিকে (১৪ ফেব্রুয়ারি) “সুন্দরবন দিবস’পালিত হয়। সুন্দরবন সংলগ্ন উপকূলীয় জেলায় গত ২০০২ সাল থেকে “সুন্দরবন দিবস” পালন করা হচ্ছে। করোনাভাইরাসের কারণে বিগত বছরের মতো এবারও বাগেরহাট, খুলনা, পিরোজপুর, সাতক্ষীরা ও বরগুনায় ভার্চুয়ালি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
তবে ২১ বছরেও জাতীয়ভাবে “সুন্দরবন দিবস” পালনের সাড়া মেলেনি। সুন্দরবন দিবস পালনের আয়োজকরা প্রথম থেকেই জাতীয়ভাবে “সুন্দরবন দিবস” পালনের দাবি জানিয়ে আসছে।
দেশের সর্ব দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরের অববাহিকায় গড়ে উঠেছে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন। সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভুমি বলা হয়। সুন্দরবন জীববৈচিত্র্যে ভরপুর, “রয়েল বেঙ্গল টাইগারের” আবাসস্থলও। তাছাড়া দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিক দেয়াল হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে সুন্দরবন। বিভিন্ন সময়ে সুপার সাইক্লোনে নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়ে উপকূলবাসীকে রক্ষা করে চলেছে সুন্দরবন। সুন্দরবন বিশ্বের একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনও বলা চলে।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) নুরুল করিম জানান, সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের আওতাধীন এলাকায় ২০টির ওপর খাল পলিমাটি জমে ভরাট হয়ে গেছে। এছাড়া জয়মনি থেকে দাসের ভারানী পর্যন্ত ভোলা নদী, খড়মা খাল ও আড়ুয়ারবেড় খালের ৩০ কিলোমিটার এলাকা ভরাট হয়ে গেছে। সুন্দরবনের মধ্যে লবণাক্ততাও বৃদ্ধি পেয়েছে।
খুলনার বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রূপান্তরের নির্বাহী পরিচালক মো. রফিকুল ইসলাম খোকন জানান, ২০০১ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারি খুলনায় প্রথম জাতীয় সুন্দরবন সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। রূপান্তর, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাপাসহ ৭০টি সংগঠন যৌথভাবে ওই সম্মেলনের আয়োজন করে। উক্ত সম্মেলনে ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালবাসা দিবসে “সুন্দরবন দিবস” পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং জাতীয়ভাবে “সুন্দরবন দিবস” পালনের দাবি জানানো হয় সরকারের কাছে। তবে এখন পর্যন্ত জাতীয়ভাবে সুন্দরবন দিবস পালনের সাড়া মেলেনি।
তিনি জানান, ২০০২ সাল থেকে সুন্দরবনসংলগ্ন জেলাগুলোতে সুন্দরবন একাডেমি, সুন্দরবন বিভাগ, বিভিন্ন প্রেসক্লাব ও বিভিন্ন সংগঠন ১৪ ফেব্রুয়ারি “সুন্দরবন দিবস” পালন করে আসছে।
নির্বাহী পরিচালক জানান, বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সুন্দরবনকে ভালোবাসুন এই শ্লোগানকে সামনে রেখে এ বছরও ১৪ ফেব্রুয়ারি “সুন্দরবন দিবস” পালন করা হবে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, “সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর বিকল্প কর্মসংস্থান।”
সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল কাদির বলেন, “জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সুন্দরবনে লবণাক্ততা বেড়ে চলেছে। মিঠা পানির উৎস কমে গেছে। বনের বেশকিছু খাল পলিমাটি জমে ভরাট হয়ে আছে এবং বিভিন্ন এলাকায় চড় জেগেছে। বনে লবণ পানির আধিক্য বেশি। অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে সুন্দরীসহ বিভিন্ন গাছ নানা রোগে মারা যাচ্ছে। লবণ পানি খেয়ে বন্যপ্রাণী নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাই সুন্দরবনের জীববৈচিত্র হুমকির মুখে।
তিনি বলেন, “তারা সুন্দরবন সংরক্ষণ ও বনসংলগ্ন মানুষের জীবন জীবিকার মানউন্নয়নের জন্য সুন্দরবন পরিচালনার ক্ষেত্রে পৃথক মন্ত্রণালয় গঠনের দাবি জানিয়ে আসছে। তাদের দাবি পূরণ হলে বন এবং বনসংলগ্ন মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটবে বলে তিনি আশাবাদী।”
প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, “জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নানা ভাবে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জীবিকার জন্য বনের ওপর মানুষের চাপ রয়েছে। বন রক্ষায় বনসংলগ্ন স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সুন্দরবন রক্ষায় সরকার নানা উদ্যোগ নিয়ে বাস্তবায়ন করছে বলে তিনি জানান।”
আমীর হোসাইন আরও জানান, বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে জাতীয়ভাবে সুন্দরবন দিবস পালনের দাবি তোলা হয়েছিল। কিন্তু এখনও এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি।
সুন্দরবনের ইতিহাস:
সুন্দরবনের মোট আয়াতন ছয় হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে স্থল ভাগের পরিমাণ চার হাজার ১৪৩ ও জল ভাগ এক হাজার ৮৭৩ বর্গ কিলোমিটার। অষ্টাদশ শতব্দীতে সুন্দরবনের আয়তন ছিল বর্তমানের চেয়ে প্রায় দ্বিগুন। ১৮৭৮ সালে সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। জাতিসংঘের ইউনেস্কো কমিশন ১৯৯৭ সালে সুন্দরবনের তিনটি অভয়ারণ্যকে বিশ্বঐতিহ্য এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেন। ২০১৭ সালে সরকার সুন্দরবনে অভায়ারণ্য এলাকা সম্প্রসারণ করে। মোট ছয় লাখ এক হাজার ৭০০ হেক্টর বনের মধ্যে এখন তিন লাখ ১৭ হাজার ৯০০ হেক্টর অভয়ারণ্য এলাকা। আগে ছিল মাত্র এক লাখ ৩৯ হাজার ৭০০ হেক্টর।
সুন্দরবন জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ একটি ইকোসিস্টেম। এই বনে অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর উত্তম আবাসস্থল। ২০০১ সালে সুন্দরবনের প্রশাসনিক এলাকা দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। পূর্ব বন বিভাগের কার্যালয় বাগেরহাটে ও পশ্চিম বিভাগের কার্যালয় খুলনায় অবস্থিত।
নামকরণ
সুন্দরবনের প্রধান উদ্ভিদ প্রজাতি “সুন্দরী গাছ”। কারো কারো মতে সুন্দরী গাছের নাম অনুসারে প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে ওঠা বনের নাম হয়েছে সুন্দরবন। আবার সমুদ্রের কাছে অবস্থান হওয়ায় “সমুন্দর” শব্দ হয়ে প্রথমে “সমুন্দবন” ও পরে “সুন্দরবন” নামকরণ হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
লবণাক্ততা
সুন্দরবনের পূর্ব থেকে পশ্চিমে ও উত্তর থেকে দক্ষিণে লবণাক্ততার পরিমাণ পর্যাক্রমে বেশি। সুন্দরবনের সর্বত্র মাটির লবণাক্ততার পরিমাণ ২-৪ দশমিক ৫ ডিএস/এম। তবে শুষ্ক মৌসুমে মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ ছয় ডিএস/এম মধ্যে থাকে। পানির লবণাক্ততার ওপর নির্ভর করে সুন্দরবনকে তিনভাবে ভাগ করা হয়েছে, স্বাদু পানির অঞ্চল, মধ্যম লবণাক্ত পানির অঞ্চল এবং লবণাক্ত পানির অঞ্চল।
জীববৈচিত্র্য
সুন্দরবনে জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। সুন্দরবনে ৩৩৪ প্রজাতির গাছপালা, ১৬৫ প্রজাতির শৈবাল ও ১৩ প্রজাতির অর্কিড রয়েছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।
বনজদ্রব্য
সুন্দরবনের প্রধান বনজদ্রব্য হচ্ছে সুন্দরী, পশুর, গেওয়া, ধুন্দুল ও কাকড়া গাছ। এছাড়া গোলপাতা, হেতাল, ছন, মাছ, মধু ইত্যাদি সুন্দরবনে রয়েছে।
প্রাণী
সুন্দরবনে ৩৭৫ প্রজাতির অধিক বন্যপ্রাণী রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ প্রজাতির সরিসৃপ, ৩১৫ প্রজাতির পাখি ও ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী অর্ন্তভুক্ত। ২১০ প্রজাতির সাদা মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ১৪ প্রজাতির কাঁকড়া এবং ৪৩ প্রজাতির মলাঙ্কা রয়েছে সুন্দরবনে।
বন্যপ্রাণী
সুন্দরবনের প্রধান প্রধান বন্যপ্রাণী হচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ, বন্যশকুর, বানর, কুমির, ডলফিন, কচ্ছপ, উদবিড়াল, মেছো বিড়াল ও বন বিড়াল ইত্যাদি।
বন বিভাগের তথ্য মতে, ২০১৮ সালের সর্বশেষ জরিপ অনুসারে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা ১১৪টি,২০২৪ সালের গনোনায় ১১ টি বাঘ বেড়ে এখন ১২৫ টি বাঘ রয়েছে।
এক থেকে দেড় লাখ হরিণ, ৫০ হাজার বানর, ২৫ হাজার বন্যশকুর ও ২৫ হাজার উদবিড়াল রয়েছে।
নদী-খাল
সুন্দরবনে নদী-খাল জালের মতো জড়িয়ে আছে। সুন্দরবনে ৪৫০টি ছোট বড় নদী-খাল রয়েছে। বনের প্রধান নদীগুলো হচ্ছে পশুর, শিবসা, আড়পাঙ্গাসিয়া, শেলা, মরজাত, ভদ্রা, যমুনা, রায়মঙ্গল ও ভোলা ইত্যাদি।
পর্যটন স্থান
গোটা সুন্দরবন জুড়ে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। এর মধ্যে করমজল, কটকা, কচিখালী, দুবলারচর, হিরণপয়েন্ট, কলাগাছিয়া, মানিকখালী, আন্দারমানিক ও দোবেকী এলাকায় পর্যটকরা বেশি ভ্রমণ করে থাকেন।