সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ, ইউনেস্কোর স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবন বহুমাত্রিক হুমকির মুখে পড়েছে। ২১ নভেম্বরের এই প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এ বনের অন্যতম অনুষঙ্গ সুন্দরী ও গোলপাতা গাছের বিপন্নতার চিত্র। ক্রমেই এ দুই প্রজাতির গাছ সুন্দরবন থেকে বিলীন হতে চলেছে মাত্রাতিরিক্ত লোনাজলের গ্রাসে। উজান থেকে মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় লবণাক্ততার হার ক্রমেই বাড়ছে এবং পানির তলদেশেও জমছে লবণাক্ত পলি। সুন্দরবনের সুন্দরী গাছ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড মিনারেল সায়েন্স অনুষদের অধ্যাপক ড. স্বপন কুমার সরকার। তার সঙ্গে গবেষণা সহকারী হিসেবে যুক্ত আছেন যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. জেসন ম্যাথিওপউলস এবং ড. রিচার্ড লি। তাদের গবেষণায় সুন্দরবনের গুরুত্বপূর্ণ দুই অনুষঙ্গ সুন্দরী ও গোলপাতা গাছের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে চিত্র উঠে এসেছে তা সুখকর নয়।
বহুমাত্রিক বিপদগ্রস্ত সুন্দরবনের লোনা পানির প্রবাহ কমিয়ে মিঠা পানির প্রবাহ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা। তাদের মতে, সমুদ্রের আশপাশের নদী ও খালগুলো খনন করে, মিঠা পানির প্রবাহ বাড়িয়ে এবং শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহের মাত্রা বাড়িয়ে অনেকটাই সুফলের আশা করা যায়। একই সঙ্গে তারা এও বলেছেন, প্রকৃতির প্রভাবের ওপর তেমন কিছুই করার না থাকলেও লোনা পানির আগ্রাসন থেকে সুন্দরবনের ঐতিহ্য দুই প্রজাতির গাছের সুরক্ষায় আপদকালীন কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারত মিলিয়ে সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার এবং এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশে রয়েছে ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে সুন্দরবনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করলেও বিগত সরকারগুলো এ ব্যাপারে কাজের কাজ তেমন কিছুই করেনি। সুন্দরবন আমাদের প্রাকৃতিক সুরক্ষা প্রাচীর হিসেবেও বিবেচিত। যে লবণাক্ততা ও পলি সুন্দরবনের ঐতিহ্যবাহী গাছগুলোর অস্তিত্ব রক্ষার হুমকি হিসেবে দাঁড়িয়েছে এর যে কোনো প্রতিবিধান নেই, তা কিন্তু নয়। গত চার দশকে সুন্দরবনে লবণাক্ততা বেড়েছে ওই অঞ্চলের খালগুলোসহ যথাযথভাবে নদী শাসনের ব্যর্থতার কারণে। এ কারণেই পলি জমার হারও বাড়ছে এবং এই প্রতিবেদককের-অনুসন্ধানে উঠে এসেছে প্রতি বছর প্রায় ৯৬ হাজার টন পলি জমা হচ্ছে।
গবেষকরা সতর্ক করেছেন যদি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বিলম্ব হয়, তাহলে এর নেতিবাচক প্রভাব আরও প্রকট হয়ে উঠবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে হারিয়ে যেতে পারে সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণীয় এবং সবচেয়ে বেশি কার্বন ধারণক্ষম বৃক্ষ সুন্দরী ও গোলপাতা। শুধু লবণাক্ত পানি কিংবা পলি জমার হার বৃদ্ধিই সুন্দরবনের জন্য হুমকি হয়ে ওঠেনি, পাশাপাশি বহুমাত্রিক দূষণও এর সুরক্ষায় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এ সবই সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল পক্ষগুলোর যথাযথ কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে অনেকটাই ঠেকিয়ে রাখা যেত। প্রকৃতির প্রভাবের ওপর আমাদের হাত নেই বটে, কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের প্রভাব ঠেকানো এবং একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের যথাযথ কর্মতৎপরতায় এর সুরক্ষায় করণীয় অনেক কিছুই দুরূহ নয়। আমাদের অর্থনীতিসহ প্রাকৃতিক প্রভাবের ওপর সুন্দরবনের ব্যাপক অবদান থাকা সত্ত্বেও এর সুরক্ষায় দায়িত্বশীলদের উদাসীনতা কিংবা ব্যর্থতার বিষয়গুলো কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার নয়। নিকট অতীতে ভিন্ন এক গবেষণায় জানা গেছে, প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যাপক উপস্থিতির কারণে সুন্দরবনের জলজ ও স্থল বন্য প্রাণী এবং বৃক্ষরাজি যে হুমকির মুখে পড়েছে এর মূলত কারণ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীনতা। আমরা জানি, বিশ্বের সর্ববৃহৎ এই শ্বাসমূলীয় বন শুধু প্রাকৃতিক ঝড়-ঝঞ্ঝায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য শুধু রক্ষাকবচই নয়, সমগ্র দেশেরই ফুসফুস হিসেবে বিবেচিত। বহুমাত্রিক প্রেক্ষাপটে এ বনের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়া মানে সামগ্রিকভাবে দেশের অস্তিত্বই বিপদাপন্ন হওয়ার শামিল।
এই সম্পাদকীয় স্তম্ভেই আমরা ইতঃপূর্বে বলেছিলাম, প্রাকৃতিক সুরক্ষা প্রাচীর সুন্দরবনের সুরক্ষায় ব্যর্থতা নানা ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে। সামগ্রিক পরিস্থিতি যেন সেদিকেই ধাবিত হচ্ছে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা জানি, সুন্দরবনগামী অনেক পর্যটক এবং সেখানকার বনজীবীদের মধ্যে পরিবেশ-সচেতনতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তাদের স্বেচ্ছাচারিতা কিংবা অসচেতনতার কারণে সুন্দরবনে পরিবেশসংক্রান্ত সংকটও ক্রমেই প্রকট হয়ে উঠছে। বন বিভাগ পরিবেশের সুরক্ষায় কিছু নির্দেশনা জারি করেই তাদের দায়িত্ব পালন শেষ বলে মনে করেÑ এমন বার্তাও মিলেছে সংবাদমাধ্যমেই। আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবের কারণে সুন্দরবনে যে বিরূপ অভিঘাত লাগছে। আমরা এর প্রতিবিধান দাবি করি। নৈসর্গিক এ বনের অস্তিত্ব রক্ষায় দায়িত্বশীলদের ব্যর্থতার জবাবদিহি প্রয়োজন। একই সঙ্গে পর্যটকসহ বনজীবীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়াও জরুরি। সুন্দরবনের পশুর নদে জ্বালানিবাহী কয়লা, তেল ও সিমেন্টের কাঁচামাল কিংবা সার বহনকারী কার্গো জাহাজডুবির ঘটনাও ইতোমধ্যে কম ঘটেনি। এরও বিরূপ প্রভাব পড়েছে বনের পরিবেশ-প্রতিবেশে। পরিবেশবাদীসহ গবেষকদের আপত্তি উপেক্ষা করে বনের প্রায় নিকটেই গড়ে উঠেছে রামপাল বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র এবং সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বহুবিধ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে বনের ভেতর। এসবের বিরূপ প্রভাবও বনে কম পড়েনি।
জলবায়ু পরিবর্তন, বহুমাত্রিক দূষণ, বৃক্ষনিধন, সচেতনতার অভাব এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে সুন্দরবনের গাছ-গাছালিসহ মূল্যবান প্রাণিজ সম্পদের জন্য যে হুমকি ক্রমেই প্রকট হচ্ছে, এ ব্যাপারে উদাসীন থাকার কোনো অবকাশ আছে বলে আমরা মনে করি না। সুন্দরবনের বিপদাপন্নতার জন্য কারণগুলো যেহেতু চিহ্নিত, সেহেতু এর প্রতিবিধান নিশ্চিত করা কঠিন কিছু নয় বলে আমরা মনে করি। যে বনটি প্রাকৃতিক দুর্ভোগের সময় ঢাল হিসেবে ভূমিকা পালন করে, যে বনটি বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ, যে বনটির অবদান অর্থনীতিতে রয়েছে ব্যাপক; সেই বনটির সুরক্ষায় কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা কিংবা দায়িত্বহীনতায় আমরা ক্ষুব্ধ না হয়ে পারি না। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা সুন্দরবন ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জীবন-জীবিকার তাড়নায় অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। গত দু দশকে বনে আগুন লেগেছে প্রায় বাইশবার। এর ফলে বনের উল্লেখযোগ্য অংশ পুড়েছে এবং আরও নানা ধরনের ক্ষতির পথও উন্মুক্ত হয়। আমরা জানি, সত্তর দশকে প্রতিবেশী দেশ ভারত আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে বাঁধ দেয় এবং এর ফলে উজান থেকে অভিন্ন নদ-নদীর মিঠা পানি ন্যায্য হিস্যা অনুযায়ী না পাওয়ায় লবণাক্ত পানির পরিমাণ বাড়তে থাকে। আমরা মনে করি, দেশের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে সরকারের তরফে ভারতের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করা জরুরি আমাদের জাতীয় স্বার্থেই। সুন্দরবনের সুরক্ষায় কোনো রকম গাফিলতি মানতে আমরা রাজি নই