জন্মভূমি রিপোর্ট : খুলনার কয়রা উপজেলার ভাগবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জি এম অদুদ হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড় জমেছে। বিগত সরকারের আমলে এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি। এলাকার লোকজনের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, মারপিট, হয়রানি, নির্যাতন করেছেন গত ১৫ বছর ধরে। ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি করায় কোনো কিছু করাকে তিনি অপরাধ মনে করেননি। ধার ধারেননি আইন কানুনের। যে কারণে স্কুলের পরিত্যক্ত ভবনের ইট, গ্রিল, জানালা ও দরজা খুলে বিক্রি করেছেন ইচ্ছে মতো। তার এসব কাজে সহযোগিতা করেছেন মহেশ্বরীপুর ক্লাস্টারের এটিও ইসলামুল হক মিঠু। কেবল তাই না, এই মিঠুকে সন্তুষ্ট রাখতে অদুদ মাস্টার বিভিন্ন শিক্ষকের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা তুলে দিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অদুদ মাস্টারের বিরুদ্ধে ভাগবা গ্রামের একাধিক নির্যাতিত ব্যক্তি বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। মনিরুজ্জামান নামে এক ব্যক্তি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারসহ বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। যার তদন্তের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন খুলনা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার অহিদুল আলম।
অদুদ মাস্টারের নির্যাতনের শিকার ভাগবা গ্রামের মনিরুজ্জামান ও জিয়াদ আলী আ’লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ করেছেন। এর আগেও তারা অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু সেই সময় ক্ষমতার দাপটে তদন্ত বন্ধ করান অদুদ।
এলাকাবাসীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে সরেজমিনে দেখা গেছে, অদুদ মাস্টার টেন্ডার ছাড়াই বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত ভবনের দেয়াল ও মেঝের ইট, দরজা, জানালা, ২০ বছর বয়সী একটি মেহগনি ও একটি শিরিষ গাছ বিক্রির করে সমুদয় টাকা আত্মসাৎ করেছেন। সরেজমিনে বিদ্যালয়ে গেলে এলাকাবাসী জানান, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জিএম অদুদ হোসেন বিদ্যালয়ের পুরান ভবনের মালামাল টেন্ডার ছাড়াই বিক্রি করেছেন। তিনি সরকারি চাকুরিজীবী হয়ে বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আ’লীগ প্রার্থীর পক্ষে এবং সংসদ নির্বাচনে সরাসরি নির্বাচনী কার্যক্রম চালান। তিনি স্থানীয় আ’লীগের প্রভাবশালী নেতা। দীর্ঘ ১৬ বছর তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি। তিনি ছিলেন বিএনপি-জামায়াতের কর্মী-সমর্থকদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক। তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললে হামলা-মামলার শিকার হতে হয়েছে। যিনি তার বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন তাকে পুলিশ দিয়ে উঠিয়ে নিয়ে টাকা আদায় করেছেন, দিয়েছেন মামলাও। এভাবে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের ফাঁদে ফেলে লাখ লাখ টাকা বাণিজ্য করেছেন।
অভিযোগ রয়েছে, অদুদ মাস্টার বিগত সংসদ নির্বাচনের সময় বিএনপি-জামায়াতের ২০-২৫ নেতা-কর্মীর একটি তালিকা তৈরি করে থানায় জমা দিয়ে ওসির নাম করে তাদের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা আদায় করেন। তার এই চাঁদাবাজির বিষয়টি ওসি জানতে পেরে অদুদ মাস্টারকে আটক করেন। তখন মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ দেনদরবার করে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে তাকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনেন।
অভিযোগকারী মনিরুজ্জামান বলেন, পহেলা সেপ্টেম্বর আমি আমার ছেলেকে টিফিন দিতে বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখতে পাই পুরানো ভবনের ইট, দরজা, জানালা কিছুই নেই। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি মালামাল ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জিএম অদুদ হোসেন বিক্রি করে নিজেই টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এবং কিছু ইট ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের সহযোগিতায় নব্য আ’লীগ নেতা স্থানীয় ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলাম রাস্তার সোলিংয়ের কাজে লাগিয়েছেন। ঘটনাটি জানার পর আমি উপজেলা শিক্ষা অফিসার বরাবর অভিযোগ দিয়েছি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ইউপি সদস্য শফিকুল ইসলাম বলেন, আমি অদুদ মাস্টারের কাছ থেকে ইট কিনিনি। আমি ইট কিনেছি মনি ও অমলের কাছ থেকে।
ভাগবা গ্রামের কুদ্দুস সানার ছেলে কবির হোসেন বলেন, আমি অদুদ মাস্টারের কাছ থেকে ৩০০ ইট এক হাজার ৮০০ টাকা দিয়ে কিনেছি। একই গ্রামের সুবোল চন্দ্র মন্ডলের ছেলে প্রবীর চন্দ্র মন্ডল বলেন, অদুদ মাস্টারের কাছ থেকে এক হাজার ৫০০ ইট কিনেছেন এক হাজার ৪০০ টাকা দিয়ে। আনিচ গাজীর ছেলে ভ্যানচালক মুজাহিদ বলেন, বিদ্যালয়ের বিক্রি করা দু’টি গাছের ডালপালা তিনি অদুদ মাস্টারের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার একাধিক ব্যক্তি জানান, আ’লীগ আমলে বিরোধী মতের মানুষকে বাড়ি ছাড়া করে রাখেন অদুদ মাস্টার। তিনি ছিলেন এলাকার মুকুটহীন সম্রাট। এতদিন তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারো ছিল না। পুলিশের সাথে যোগাযোগ রেখে প্রতিপক্ষ ও বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের নামে মামলা ও পুলিশের ভয় দেখিয়ে অর্থ বাণিজ্য করাই ছিল তার প্রধান কাজ।
গত ৫ আগস্ট আ’লীগ সরকারের পতনের পর পলাতক রয়েছেন। গণরোষের হাত থেকে রক্ষা পেতে নানা অজুহাত দেখিয়ে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে ছুটি নিয়ে পলাতক থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর আগেও তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ করা হলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি কর্তৃপক্ষ। এ কারণে এলাকাবাসীর প্রশ্ন-এবারও কি অবৈধ অর্থের জোরে পার পেয়ে যাবেন অদুদ মাস্টার?
এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, অদুদ মাস্টার ভাগবা রেজিস্ট্রার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকুরি করা কালীন রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এরপর ৭ নম্বর ওয়ার্ড আ’লীগের সভাপতি হন। ওয়ার্ডের সভাপতি হওয়ার পর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১৩ সালে স্কুলটি সরকারি হলে তিনি সভাপতির পদে না থাকলেও ক্ষমতা ছিল তার হাতে। সরকারি চাকুরিজীবী হয়েও দলীয় কর্মকান্ডেও ছিলেন সক্রিয়। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক জি এম অদুদ হোসেন বলেন, আমি শুনেছি আমার কাছ থেকে দু’জন ইট কিনেছেন বলে অভিযোগ করেছেন। ওখানে যে মানুষ উপস্থিত ছিল তার মধ্যে অর্ধেক আমার লোক।
গাছ বিক্রির বিষয়ে তিনি বলেন, উপজেলা শিক্ষা অফিসের অনুমতি নিয়ে গাছ বিক্রি করা হয়েছে। উপজেলা শিক্ষা অফিসার তপন কুমার কর্মকার বলেন, বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে পরিত্যক্ত ভবনের মালামাল বিক্রির অভিযোগ পেয়েছি এবং জানার চেষ্টা করেছি। আমি যোগদান করার আগের ঘটনা। তিনি বিদ্যালয়ে কেন আসেন না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সম্ভবত চলতি সেপ্টেম্বর মাসের ৩ তারিখ হতে শিক্ষক অদুদ হোসেন ছুটিতে আছেন। কতদিনের ছুটিতে আছেন এ ব্যাপারে তিনি বলেন, রেজিস্ট্রার দেখে বলতে হবে।