লিপিকা পাত্র দেশের বিভিন্ন জেলার দশটি অনলাইন স্কুলে একদিনে দশটি পাঠ দিয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। তিনি পেশায় একজন শিক্ষক। শিক্ষকতা করেন খুলনার তেরখাদা উপজেলার ইখড়ি কাটেঙ্গা মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ২০১৮ সালে তিনি জেলা পর্যায়ে সেরা শিক্ষক নির্বাচিত হন। করোনাকালে অনলাইন স্কুলের মাধ্যমে তিনি ইতোমধ্যে একশ’র অধিক ক্লাস সম্পন্ন করে রেকর্ড গড়েছেন। দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কিছু দিন পর অর্থাৎ ৬ এপ্রিল থেকে লিপিকা পাত্র অনলাইনে শিক্ষাদান শুরু করেন। করোনাকালে তাঁর উদ্যোগে তৈরি ‘সুন্দরবন অনলাইন স্কুল’ খুলনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হেলাল হোসেন উদ্বোধন করেন। এই অনলাইন স্কুলে তিনি নিয়মিত পাঠদান করে আসছেন।
লিপিকা পাত্র করোনাকালীন শিক্ষার্থীদের লেখাপড়াকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর এটুআই কর্মসূচির সহযোগিতায় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ‘ঘরে বসে শিখি’ ফেসবুকপেইজ এবং জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস ও জেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে ‘ডিজিটাল প্রাইমারী এডুকেশন, খুলনা’ পেইজসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা পর্যায়ের অনলাইন স্কুলগুলির মধ্যে বিশটিরও বেশি স্কুলে পাঠদান অব্যাহত রেখেছেন। তিনি মূলত ইংরেজি বিষয়ে পাঠদান করেন। এছাড়াও বাংলা, গণিত এবং বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বিষয়েও তিনি পাঠ দেন। এ পর্যন্ত তিনি অনলাইনে ১৩০টি লাইভ ক্লাস সম্পন্ন করেছেন। ৬ই এপ্রিল তিনি প্রথম অনলাইন ক্লাস শুরু করে গত ২৫ আগস্ট শততম লাইভ ক্লাসের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন। তাঁর প্রথম লাইভ ক্লাস প্রচারিত হয় বাংলাদেশের অন্যতম শিক্ষামূলক পেইজ ‘বাংলাদেশ আলোকিত প্রাথমিক শিক্ষক’ পেইজে। তিনি সুন্দরবন অনলাইন স্কুল, বাংলাদেশ আলোকিত প্রাথমিক শিক্ষক পেইজ, খুলনা অনলাইন স্কুল, ময়মনসিংহ অনলাইন স্কুল, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক গ্রæপ পেইজসহ বাইশটিরও বেশি অনলাইন স্কুলে পাঠদান অব্যাহত রেখেছেন। গত ১৪ আগস্টে তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার দশটি অনলাইন স্কুলে একদিনে পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজি বিষয়ে দশটি পাঠ দিয়ে বাংলাদেশে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন।
অনলাইন পাঠদানের সাথে নিজেকে যুক্ত হওয়ার কারণ হিসেবে লিপিকা পাত্র বলেন, ‘করোনাকালীন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকে সামনে এগিয়ে নিতে চাই। শিক্ষকতার পাশাপাশি নিজ উদ্যোগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভিশন-২০২১ এবং রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নে নিজেকে সক্রিয় রেখে ডিজিটাল বাংলাদেশ বির্নিমাণ এবং প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য পূরণে নিজেকে সবসময় নিয়োজিত রাখতে চাই।
করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে একটি বছরের অর্ধেক সময় অর্থাৎ ছয় মাসের অধিক সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ আছে। ১৬ মার্চ হতে বন্ধ হওয়া এবং ধাপে ধাপে ছুটি বর্ধিত করে আগামী ৩ অক্টোবর পর্যন্ত বন্ধ থাকবে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। করোনাভাইরাসের গতি-প্রকৃতি দেখে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কবে খুলবে। শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সরকারের ডিজিটাল প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে অনলাইন স্কুল কার্যক্রম শুরু করা হয়। এর উদ্দেশ্য করোনাকালে শিক্ষার্থীরা যেন পাঠ্যবই বিমুখ না হয়। অভিজ্ঞ শিক্ষকরা ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি করে অনলাইন স্কুল প্লাটফরমে তাঁদের ক্লাসগুলো ্আপলোড করছেন। এর সাথে চালু আছে অনলাইনে সরাসরি বা লাইভ ক্লাস। শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে ল্যাপটপ অথবা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে এসব ক্লাসের মাধ্যমে তাদের লেখাপড়ার কাজটা অব্যাহত রাখতে পারছে।
অনলাইন স্কুল কার্যক্রমে পিছিয়ে নেই খুলনা জেলাও। গত ১১ মে আনুষ্ঠানিকভাবে খুলনাতে ‘ডিজিটাল প্রাইমারী এডুকেশন খুলনা’ এবং ‘ডিজিটাল সেকেন্ডারী এডুকেশন খুলনা’ নামের দু’টি ইউটিউব চ্যানেল ও একই নামের দু’টি ফেসবুক পেইজ চালু হয়েছে। এই অনলাইন স্কুলের জন্য খুলনার অভিজ্ঞ শিক্ষকরা ২০ মিনিটের উপযোগী করে কন্টেন্ট তৈরি করেছেন। সপ্তাহের শুরুতে ক্লাসের একটি রুটিন প্রকাশ করা হয়, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা কোন দিন, কখন এবং কোন ক্লাস হবে তা জানতে পারছে। প্রাথমিক পর্যায়ে তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি এবং মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ক্লাসের ভিডিও কনটেন্ট সরবরাহ করা হয়। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ভিডিও আপলোড অব্যাহত রয়েছে। যার ফলে করোনাকাল অতিক্রান্ত হওয়ার পরও শিক্ষার্থীরা এর সুবিধাটি পাবে। শিক্ষার্থীরা খুলনার বাইরে বসেও এই শিক্ষাকার্যক্রমে অংশ নিতে পারছে।
শিক্ষার্থীরা এসকল ক্লাসে তাদের মতামত, সমস্যা, মন্তব্য তুলে ধরার সুযোগ পাচ্ছে। টেলিভিশনের শিক্ষা কার্যক্রমটি একমুখী হলেও এই কার্যক্রমটি দ্বিমুখী। ফলে শিক্ষার্থীদের কাছে এটি আরও আগ্রহ ও আনন্দময় হয়ে উঠেছে।
উদ্যোক্তারা আশা করছেন, অনলাইনভিত্তিক এই শিক্ষাকার্যক্রমটির ফলে করোনাকালের শিক্ষা ঘাটতি যেমন পুষিয়ে নেয়া যাবে তেমনি শিক্ষার্থীদের কোচিং নির্ভরতাও কমবে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সহযোগিতায় খুলনা জেলা প্রশাসন তথ্য প্রযুক্তি খাতকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য ভিডিও কনন্টেন্টে ক্লাসগুলো ধারণ করে ইউটিউব এবং ফেসবুকে প্রচারের ব্যবস্থা করেছে। ১১ মে অনলাইন স্কুল কার্যক্রমের উদ্বোধন কালে খুলনার বিভাগীয় কমিশনার ড. মুহা: আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, শিক্ষাব্যবস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রমটি যুগপোযোগী যা বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে পদক্ষেপ নিয়েছে করোনাকালে তার সুফল দেশবাসি পেতে শুরু করেছে।
করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকলেও প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম থেমে নেই। এই করোনাকালেও প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ শিক্ষকদের মাধ্যমে- ১. সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে শিক্ষার্থীদের সাথে দেখা করা এবং শিক্ষার্থীদের খাতা-কলম, মাস্ক এবং খাবার বিতরণ ২. মোবাইল ফোনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিষয়ভিত্তিক পাঠদান অব্যাহত রেখে সপ্তাহে দু’দিন পড়া দেওয়া ও নেওয়া ৩. শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সংসদ টিভিসহ বিভিন্ন অনলাইন স্কুলের পাঠদান সম্পর্কে অবহিতকরণ এবং বেতারে প্রচারিত পাঠদানের সময়সূচি জানানো ৪. শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকদের সাথে জুম মিটিং এর মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ও বিভিন্ন প্রয়োজনীয় নোট তৈরি করে টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে সামাজিক দূরত্ব মেনে শিশুদের কাছে পৌঁছে দেওয়া ৫. বিভিন্ন ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে শিশুদের সম্পৃক্ত করা ৬. এছাড়া নিয়মিত ভিডিও-অডিও ও ফোনকলের মাধ্যমে অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার মতো কাজগুলো অব্যাহত রেখেছে। অনলাইন স্কুল সম্পর্কে খুলনার জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এএসএম সিরাজুদ্দোহা বলেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো মাসের পর মাস বন্ধ থাকলেও শিক্ষা কার্যক্রম থেমে নেই। শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের ঐকান্তিক চেষ্টায় শিক্ষার্থীদের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত আছে। শিক্ষকরা বাড়িতে বসেও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার খোঁজ রাখছেন। হাতে গোণা যে সকল শিক্ষার্থীর সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে না, শিক্ষকরা তাদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন। টেলিভিশনসহ অনলাইন স্কুলগুলোর ক্লাসের প্রতি মনোযোগের জন্য শিক্ষার্থীদের বলা হয়েছে। এরফলে শিক্ষার্থীরা স্কুলে না এসেও শিক্ষা কার্যক্রম থেকে কোনভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে না।
মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বাঁধাগ্রস্ত হয়েছিল। বাঙালি জাতি ঐকান্তিক চেষ্টায় সেই বাঁধা কাটিয়ে উঠেছিল। করোনাকালেও শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক আর সর্বোপরি সরকারের প্রচেষ্টায় ডিজিটাল পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে এবারও শিক্ষার ক্ষত পুষিয়ে নিতে সক্ষম হবে।
লেখক: উপপ্রধান তথ্য অফিসার, আঞ্চলিক তথ্য অফিস, খুলনা।