
এবারো দামের উদ্বেগে অশনি সংকেত
সিন্ডিকেটে বাজার অস্থির হয়ে ওঠার শঙ্কা
জন্মভূমি ডেস্ক : দেশের চামড়া শিল্পের কাঁচা চামড়া সংগ্রহের প্রধান মৌসুম ঈদুল আজহা। আর এই চামড়ার দাম নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে নৈরাজ্য। দেশ-বিদেশে চামড়াজাত পণ্যের দাম ক্রমশ বাড়তে থাকলেও কাঁচা চামড়ার ন্যায্য দাম পান না প্রান্তিক পর্যায়ের বিক্রেতারা। তৃণমূল পর্যায়ের ক্রেতারাও বিপুল লোকসান দিয়ে থাকেন। সরকার চামড়ার দাম বেঁধে দিলেও এই নৈরাজ্য ঠেকানো যাচ্ছে না। ক্ষোভে-দুঃখে অনেক ক্রেতাকে চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলতেও দেখা গেছে। অন্যদিকে সিন্ডিকেটে চামড়ার বাজার অস্থির হয়ে ওঠার আশঙ্কাও রয়েছে। ফলে এবারো অনিশ্চয়তা আর ন্যায্য দাম পাওয়া নিয়ে পুনরাবৃত্তির শঙ্কা করা হচ্ছে। ওদিকে কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে সাভারে অবস্থিত বিসিক চামড়া শিল্প নগরীর ট্যানারিগুলো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারা বছর দেশে যে পরিমাণ চামড়া উৎপাদন হয়, তার অর্ধেকের বেশি আসে ঈদুল আজহায়। আর এই কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে কৃত্রিমভাবে চামড়ার দাম কমিয়ে দিতে তৎপর একটি চক্র। ফলে চামড়ার প্রকৃত দাম পাওয়া যায় না।
সিন্ডিকেটের কারণে অনেক চামড়া পচে নষ্টও হয়ে যায়। অথচ চামড়া ও চামড়াজাত খাত দেশের এমন একটা শিল্প যার কাঁচামাল তথা উৎপাদনের উপকরণ শতভাগ দেশীয় উৎস থেকে পাওয়া যায়। এমনকি দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রক্রিয়াজাত চামড়া রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশ। সরকার কয়েক বছর ধরে বলছে, এ খাত থেকে ৫০০ কোটি ডলার আয় করা সম্ভব কিন্তু রপ্তানি আয় ১০০ কোটি ডলারের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।চামড়া
কিনতে ঋণ: সাধারণত কোরবানি উপলক্ষে ২ শতাংশ রেয়াতি সুবিধায় চামড়া শিল্পে ঋণ দেয় ব্যাংকগুলো। এবারো ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়া ক্রয় ও কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে ট্যানাররা ২৭০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ পাবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। গত বছরের তুলনায় ১০ কোটি টাকা বেশি। ১২টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এ ঋণ বিতরণ করা হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, ২০২৩ সালে চামড়া খাতে ব্যাংকের ঋণ বরাদ্দ ছিল ২৫৯ কোটি টাকা। ২০২২ সালে ছিল ৪৪৩ কোটি, ২০২১ সালে ৬১০ কোটি, ২০২০ সালে ৭৩৫ কোটি এবং ২০১৯ সালে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। এই ঋণের ২৪ শতাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর।
বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের (বিটিএ) তথ্যমতে, বর্তমানে ট্যানারি মালিক ও বাণিজ্যিক রপ্তানিকারক মিলিয়ে সংস্থাটির সদস্যসংখ্যা প্রায় ৮০০। সারা দেশে ১ হাজার ৮৬৬ জন বড় ও মাঝারি চামড়া ব্যবসায়ী রয়েছে। রাজধানীর পোস্তা, নাটোরের রেলওয়ে বাজার, যশোরের রাজারহাট, গাইবান্ধার পলাশবাড়ী, রংপুরের তারাগঞ্জ, নওগাঁও, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, আমিনবাজার ও টঙ্গী-গাজীপুরের আড়তগুলোতে কাঁচা চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও মজুত করা হয়।
চামড়া ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এ বছর গরু, মহিষ ও ছাগল মিলিয়ে মোট ১.১০ কোটি কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা তাদের। গত বছর এ লক্ষ্যমাত্রা ১ কোটি পিস ছিল। এ মৌসুমে সংগ্রহ করা এই কাঁচা চামড়ার বাজারমূল্য প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
চামড়ার দাম: এবার কোরবানিকে সামনে রেখে পশুর চামড়া সংগ্রহের জন্য দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। তবে গত বছরের চেয়ে এবার ঢাকার মধ্যে প্রতি বর্গফুট চামড়ায় ৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৩ টাকা করে বেড়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ট্যানারি ব্যবসায়ীদের চলতি বছর ঢাকায় গরুর প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত চামড়ার দাম পাঁচ টাকা বাড়িয়ে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। গত বছর লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম ছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। আর ঢাকার বাইরে নির্ধারণ করা হয় ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, যা গত বছর ছিল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। পাশাপাশি সারা দেশে ট্যানারি ব্যবসায়ীদের লবণযুক্ত খাসির চামড়া কিনতে প্রতি বর্গফুট ২০ থেকে ২৫ টাকা দিতে হবে। গত বছর এসব চামড়ার দাম ছিল ১৮ টাকা থেকে ২০ টাকা। অন্যদিকে বকরির চামড়া প্রতি বর্গফুট ১৮ টাকা থেকে ২০ টাকা দিতে হবে ট্যানারি ব্যবসায়ীদের। গত বছর এসব চামড়ার দাম ছিল প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা। তবে এবারো সরকার নির্ধারিত দাম না পাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট মহল থেকে।
জানা গেছে, সরকার পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিলেও প্রান্তিক ব্যবসায়ী কিংবা কোরবানি দেয়া লোকজন চামড়ার সঠিক মূল্য পান না। অনেক সময় ধর্মীয় কিংবা দাতব্য সংস্থাগুলোকে বিনামূল্যে চামড়া দিয়ে দেন। অভিযোগ রয়েছে, প্রান্তিক পর্যায়ে কোরবানি হওয়া পশুর চামড়ার আকার নির্ধারণে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। যে কারণে কোরবানিদাতা পর্যায়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছে ছোট গরু-মহিষের চামড়া একশ’ থেকে দুইশ’ টাকায়, আকারে বড় গরু-মহিষের চামড়া আড়াইশ’ থেকে তিনশ’ টাকায় বিক্রি হয়।
বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক মো. সাখাওয়াত উল্ল্যাহ বলেন, ঈদে সক্ষমতার চেয়ে ট্যানারিগুলো বেশি চামড়া কেনে। গত বছর প্রায় ৩০ শতাংশ চামড়া নষ্ট হয়। ট্যানারিগুলো সক্ষমতা অনুযায়ী চামড়া কিনতে পারলে, এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। তবে গতবার বিদ্যুতের ভোল্টেজ ওঠানামার ফলে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে সমস্যা তৈরি হয়েছিল। চলতি বছর তিনি তিন মাস নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অনুরোধ জানান। গত ১৪ই মে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ঈদুল আজহার কাঁচা চামড়ার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সভায় জানানো হয়, যথাযথভাবে চামড়া ছাড়ানোসহ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে লবণ লাগানো নিশ্চিতে তারা কাজ করবে। পাশাপাশি সারা দেশের এতিমখানাগুলোতে বিনামূল্যে লবণ সরবরাহ করা হবে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ও ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ঋণের বিষয়েও সভায় সিদ্ধান্ত হয়।
মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি জানান, সারা দেশে ৩৬ হাজার কসাইকে একদিনের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পর্যায়ক্রমে আরও কসাইয়ের প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যাপারে বলা হয়। এদিকে বিসিক জানায়, চামড়ায় ব্যবহৃত অপরিশোধিত লবণের দাম নির্ধারণ করা হয় ১৭ টাকা থেকে সাড়ে ১৭ টাকা। চাহিদামতো ১ লাখ টন লবণ সরবরাহ করা হবে।