
জন্মভূমি ডেস্ক : পদ্মা, মেঘনা ও কর্ণফুলী নদীর মোহনা এবং উপকূলীয় ১৯টি জেলায় প্রায় সাড়ে চার লাখ পরিবারের জীবন-জীবিকা জড়িয়ে আছে বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারের সঙ্গে।
শুধু মৎস্য আহরণ নয়, দেশের এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বিশাল সমুদ্রসীমাকে কাজে লাগিয়ে সামুদ্রিক বাণিজ্য, জাহাজশিল্প, শিপব্রেকিং, মেরিকালচার, জ্বালানি, পর্যটন ও নবায়নযোগ্য শক্তিসহ পঁচিশটির বেশি খাতে ব্লু- ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতির টেকসই ব্যবহারের অপার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় দপ্তরগুলোর সমন্বয়হীনতা, গবেষণা ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে বিপুল এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারছে না দেশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বঙ্গোপসাগর থেকে প্রতিবছর আট মিলিয়ন টন মাছ শিকার হলেও দেশের মৎস্যজীবীরা আহরণ করেন মাত্র দশমিক ৭০ মিলিয়ন টন। অন্যদিকে বটম ট্রলে (২০০ কিলোমিটার জলসীমায়) অতিরিক্ত মৎস্য আহরণের কারণে সাগরের সুস্বাদু লাক্ষা, চাপিলাসহ অন্তত আট প্রজাতির মাছ চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে।
বঙ্গোপসাগর থেকে প্রতিবছর আট মিলিয়ন টন মাছ শিকার হলেও দেশের মৎস্যজীবীরা আহরণ করেন মাত্র দশমিক ৭০ মিলিয়ন টন। অন্যদিকে বটম ট্রলে (২০০ কিলোমিটার জলসীমায়) অতিরিক্ত মৎস্য আহরণের কারণে সাগরের সুস্বাদু লাক্ষা, চাপিলাসহ অন্তত আট প্রজাতির মাছ চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে
অন্যদিকে, সমুদ্রসীমা বিজয়ের এক দশক পেরিয়ে গেলেও বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বহুমাত্রিক জরিপের কাজ এখনো আলোর মুখ দেখেনি। এক্ষেত্রে বিদেশি কোম্পানিগুলো এক পা এগিয়ে তিন পা পিছিয়ে যাচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশি কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করতে সুবিধা বাড়ানোর পন্থায় এগোচ্ছে সরকার।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সমন্বিতভাবে কাজ করলে সুনীল অর্থনীতি দেশের জিডিপি ৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে সক্ষম হবে। অনাবিস্কৃত এই অফুরান সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সমন্বিত একটি মেরিটাইম পলিসি বা সামুদ্রিক কৌশল প্রণয়ন, যা দেশের সামুদ্রিক পরিবেশ বা সামুদ্রিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করবে। একই সঙ্গে নজর দেওয়া প্রয়োজন সমুদ্র নিরাপত্তা, সমুদ্রদূষণ, সমুদ্রের প্রাণিজ-অপ্রাণিজ সম্পদের সুরক্ষা ও সংরক্ষণ, সমুদ্রবিজ্ঞান ও গবেষণা, সমুদ্র পরিবেশ সুরক্ষা এবং প্রশিক্ষিত জনবল গড়ে তোলায়।
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষের জীবিকা সরাসরি সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত। দেশে মাছের মোট উৎপাদনের ১৬ শতাংশ (৬ দশমিক ৮১ লাখ মেট্রিক টন) আসে সমুদ্র থেকে। এ সমুদ্র এলাকায় টেকসই আহরণ নিশ্চিত করা গেলে বছরে ৮০ লাখ টন মাছ ধরার সুযোগ রয়েছে। বঙ্গোপসাগরের বিশাল জলসীমাকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে শুধু সামুদ্রিক মাছ ও জলজ উদ্ভিদ রপ্তানি করেই প্রতিবছর আয় হতে পারে বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ।
মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক আনিছুর রহমান তালুকদার বলেন, গবেষণা জরিপ ‘সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট’র আওতায় ২০১৮ সাল থেকে জরিপ জাহাজ ‘আর ভি মীন সন্ধানী’ বঙ্গোপসাগরে ৩৮টি সার্ভে ক্রুজ পরিচালনা করে। যেখানে এখন পর্যন্ত ৪৫৭ প্রজাতির মৎস্য ও মৎস্যজাতীয় প্রাণী শনাক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে ৩৩৭ প্রজাতির মাছ, ২১ প্রজাতির হাঙ্গর ও রে মাছ, ২৪ প্রজাতির চিংড়ি, ৩ প্রজাতির লবস্টার, ২১ প্রজাতির কাঁকড়া, ১ প্রজাতির স্কুইলা, ৫ প্রজাতির স্কুইড, ৪ প্রজাতির অক্টোপাস এবং ৫ প্রজাতির কাটাল ফিশ।
ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব ও সাবেক সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট) রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) এম খুরশেদ আলম জানান, বঙ্গোপসাগরের বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২২০ প্রজাতির শৈবাল (সি-উইড), ৪৯৮ প্রজাতির ঝিনুক, ৫২ প্রজাতির চিংড়ি, ৫ প্রজাতির লবস্টার, ৬ প্রজাতির কাঁকড়া ও ৬১ প্রজাতির সি-গ্রাস চিহ্নিত করা হয়েছে।
সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্টের সাবেক পরিচালক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটির অতিথি শিক্ষক হাসান আহম্মেদ চৌধুরী বলেন, দেশে শুধু মাছের মাংসটুকুই খাওয়া হয়, বাকি সবকিছু বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু চীন-ভিয়েতনামসহ অনেক দেশ মাছের ৯৩ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবহার করছে। আমাদের কাছ থেকে ১০ ডলারে মাছ কিনে তারা নানা প্রক্রিয়ায় ১০০-১৫০ ডলার পর্যন্ত ভ্যালু এডিশন করছে। এ বিষয়গুলোর প্রতি আমাদের নজর দিতে হবে।
২০১৮ সালে বিশ্বব্যাংক গ্রুপ ‘টুয়ার্ডস অ্যা ব্লু ইকোনমি : অ্যা পাথওয়ে ফর সাসটেইনেবল গ্রোথ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের একটি সমীক্ষায় জানায়, সমুদ্র অর্থনীতির ব্যাপারে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কোনো সমন্বিত নীতি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেনি।
নির্বিচারে সামুদ্রিক মাছ শিকার এবং অবৈধ মাছ ধরা বন্ধ না হলে ভবিষ্যতে বঙ্গোপসাগর মৎস্যশূন্য হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সামুদ্রিক মৎস্য গবেষণা ও জরিপের মাধ্যমে এ মূল্যায়ন করছেন গবেষকরা।
গবেষকদের মতে, মাছের নতুন নতুন ক্ষেত্র না খুঁজে একই এলাকায় (বটম ট্রলে) অতিরিক্ত আহরণের কারণে অনেক প্রজাতির মাছ বাণিজ্যিকভাবে বিলুপ্ত হওয়ার প্রবল ঝুঁকি থাকে। এক্ষেত্রে সুরক্ষার ব্যবস্থা না করা হলে তা সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
গবেষক হাসান আহম্মেদ চৌধুরী বলেন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল নৌযানে সাউন্ড নেভিগেশন রেঞ্জিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাছের সুনির্দিষ্ট অবস্থান জেনে নির্বিচারে মাছ শিকার করা হয়। এ কারণে বঙ্গোপসাগরে আশঙ্কাজনক হারে মাছের মজুত কমছে।
বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এসকে আবিদ হুসাইন বলেন, আমরা এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বিশাল সমুদ্রসীমার মাত্র ২৪ হাজার কিলোমিটার এলাকায় মাছ শিকার করতে পারছি।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত