জন্মভূমি ডেস্ক : মাত্রাতিরিক্ত গরমে মানুষ যেমন হিটস্ট্রোক করে, তীব্র তাপদাহে ধানগাছও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেটাকে বলা হয় হিটশক বা হিট ইনজুরি। হিটশক হলে ধানের ফুল পুড়ে দানা চিটা হয়ে যায়। মূলত ধানের ফুল ফোটার সময়ই এ ধরনের ক্ষতি হয়। বর্তমানে এ ঝুঁকিতে রয়েছে দেশের প্রধান ফসল বোরো। ধান গবেষকরা বলছেন, অতিরিক্ত তাপমাত্রা বাড়া অথবা কমা- দুই কারণেই হিটশক বা হিট ইনজুরি হয়। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে হিটশকের মাত্রা ধরা হয়।
বোরো মৌসুম শুরু হয় শীতে নভেম্বর (কার্তিক-অগ্রহায়ণ) মাসে। আর শেষটা হয় চরম গরমের এপ্রিল-মে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) মাসে। ধানের জন্য ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি তাপমাত্রা অসহনীয়। ফুল ফোটার সময় এক-দুই ঘণ্টা এ তাপমাত্রা বিরাজ করলে মাত্রাতিরিক্ত চিটা হয়ে যায়। দেশে ২০২১ সালে এ ধরনের হিটশকের ঘটনা ঘটে। ওই বছর প্রায় অর্ধলাখ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়ে যায়।
এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, তীব্র গরমের কারণে এবার হিটশক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমরা সারাদেশের কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে সতর্ক বার্তা দিয়েছি। তিনি বলেন, হিটশক ফ্লাওয়ারিং স্টেজে (ফুল ফোটা পর্যায়ে) হয়। আমাদের অধিকাংশ ধান এখন সে অবস্থা পেরিয়ে ম্যাচুইরিটি স্টেজে এসেছে। তাই হিটশক হলেও খুব ক্ষতি হবে না। তারপরও আমরা সতর্ক থাকতে বলছি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাপপ্রবাহের মধ্যে কালবৈশাখীও থাকে। কিন্তু যখনই তাপপ্রবাহ হয় এবং সে সময় বৃষ্টি থাকে না, তখনই ধানের জন্য তা হিটশক ঘটে। অর্থাৎ, বৃষ্টিহীন তাপপ্রবাহের সময় ধানের ফুল এলে তা শুকিয়ে যায়। যে অবস্থা এখন বিরাজ করছে।
দেশে এ ধরনের ঘটনা নতুন না হলেও সাধারণ মানুষের কাছে বেশি পরিচিত নয়। কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের এটি একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। গাজীপুর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. নজমুল বারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘অতিরিক্ত তাপমাত্রা বাড়া অথবা কমাÍদুই কারণে হিটশক বা হিট ইনজুরি হয়। ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে হিটশকের মাত্রা ধরা হয়। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাপমাত্রা ক্রমাগত বাড়ছে। এমন হতে পারে। ঝুঁকি রয়েছে। তিনি বলেন, ধানের ফ্লাওয়ারিং স্টেজে এটা ক্ষতি খুব বেশি করে। এ সময়কে সবচেয়ে ভার্নারেবল অবস্থা ধরি আমরা। সে সময় গরম বাতাসের কারণে ধানের শীষ থেকে পানি বেরিয়ে যায়। ফুল শুকিয়ে যায়। ফলে ধান চিটা হয়ে যায়। কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের এটি একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। এ ঘটনা আগেও হয়েছে। তবে এত বিস্তর এলাকায় ক্ষতি হয়নি।
হিটশক দেশে নতুন নয় উল্লেখ করে গাজীপুর ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ শরীরতত্ত্ব বিভাগের সাজ্জাদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ২০১২ সাল থেকে আমরা হিটশকের তথ্য রেখেছি। এ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় যশোর সদর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, গাজীপুরের কালিয়াকৈর এবং ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জে হিটশক হয়েছে। তবে কখনো গ্রামের এক-দুটি মাঠে বা কোনো একটি এলাকার ক্ষেতে হয়েছে। বড় হিটশক ২০২১ সালে প্রথম হয়। ওই বছর ৪ এপ্রিল একসঙ্গে নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকা এবং গোপালগঞ্জ, কুষ্টিয়া, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ জেলাসহ কিছু অঞ্চলে হিটশক হয়েছিল। তিনি বলেন, এবছর বৈশাখ মাসেও বৃষ্টি না থাকায় সে আশঙ্কা রয়েছে। বৈশাখী গরম হাওয়া হলে ক্ষতি হয়। সাধারণত কালবৈশাখীর পরে বৃষ্টি হয়। তাই তাপমাত্রা কমে যায়, এমন হয় না। এবছর সেটা হচ্ছে না।
এখন সারাদেশেই এ তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে কৃষি ও মাঠ ফসলের সুরক্ষায় বেশ কিছু সতর্কতামূলক পরামর্শ দিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। বিশেষ করে যেখানে এখন ধান ফ্লাওয়ারিং স্টেজে রয়েছে, সেখানে হিটশকের আশঙ্কা বেশি। সে কারণে তাপপ্রবাহের ক্ষতি থেকে ধান রক্ষার জন্য বোরো ধানের জমিতে পর্যাপ্ত পানি ধরে রাখার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ধানের শীষে দানা শক্ত না হওয়া পর্যন্ত জমিতে অবশ্যই দুই থেকে তিন ইঞ্চি পানি রাখতে হবে।
বোরোর আবাদ:
দেশে বার্ষিক চাহিদার বিপরীতে মোট উৎপাদিত চালের ৫৫ শতাংশের বেশি আসে বোরো মৌসুম থেকে। তাই খাদ্য নিরাপত্তায় এ মৌসুমকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় সরকার। চলতি মৌসুমে মোট ৪৯ লাখ ৭৭ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে দুই কোটি ১০ লাখ টন। চাষ করা হচ্ছে হাইব্রিড, উফশী ও স্থানীয় জাতের ধান।
গত ২০২১-২০২২ অর্থবছরে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৮ লাখ ৭২ হেক্টর জমিতে। আবাদ হয়েছে ৪৯ লাখ ৫১ হাজার হেক্টর জমিতে। গত বছর চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই কোটি নয় লাখ টন। উৎপাদন হয়েছে দুই কোটি ১০ লাখ টন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) প্রাথমিক তথ্যে দেখা যায়, চলতি মৌসুমে বোরো ধানের আবাদ প্রায় চার শতাংশ বেড়েছে। এবছর মোট ৪৯ দশমিক ৯৯ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিবছর বোরো মৌসুমে সফলভাবে ধান ঘরে তোলা খুবই চ্যালেঞ্জিং। কারণ আকস্মিক বন্যা ও অতিবৃষ্টির কারণে হাওরের ধান ঠিকমতো ঘরে তোলা নিয়ে প্রতিবছরই আতঙ্কে থাকতে হয় কৃষকদের।