
জন্মভূমি ডেস্ক ; রোহিঙ্গারা এখন কোটিপতি! গত ৫ বছরে বদলে গেছে অনেকের জীবন। সে সময়ে এ দেশের মানুষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি অনুগত থাকলেও এখন তা আর নেই। আশ্রিত রোহিঙ্গারা নিজেরাই এখন সংঘবদ্ধ। মাদক-অস্ত্রের চেরাগে অন্যরকম জীবন উপভোগ করছে। স্বর্ণের বার, অবৈধ অস্ত্র ছাড়াও লাখ লাখ ইয়াবার কারবারিও জমে গেছে। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে রয়েছে নিজেদের মার্কেট। বনবিভাগের জায়গাও এখন রোহিঙ্গাদের দখলে। সন্ধ্যা হলেই স্থানীয় বাসিন্দারা রোহিঙ্গাদের ভয়ে আর কেউ ঘর থেকে বের হন না।
প্রশাসনও অসহায় হয়ে পড়েছে। পুলিশের গুলিকেও এখন রোহিঙ্গারা ভয় পাচ্ছে না। ইয়াবা বিক্রি করে বন্দুক নিয়ে আসছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। অস্ত্রধারী আরসা, আরএনও ও মুন্না গ্রুপের প্রভাব বেড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ক্যাম্পে পুরো রাত রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের দখলে। সেখানে পাহাড়ি এলাকায় গড়ে উঠছে একাধিক অস্ত্র তৈরির কারখানা। এছাড়া সমুদ্র, উপকূল, সীমান্ত জল-পাহাড়ি জনপদ দিয়েও ক্যাম্পে অস্ত্র ঢুকছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের জিম্মি করতে ও আতঙ্কে রাখতে ব্যবহৃত হচ্ছে এসব অস্ত্র।
গত ৫ বছরে উখিয়া ও টেকনাফের পাহাড়ে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের হিংস্রতা শুধু ক্যাম্পে নয়, ক্যাম্পের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছে। স্থানীয় অনেকে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে অপহরণ ও হত্যার শিকার হয়েছে। ক্যাম্প ও স্থানীয় সূত্রমতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইন মানছেন না। আশ্রয়দাতা দেশের মুদ্রা ব্যবহার করছেন। প্রভাব খাটিয়ে এনজিওগুলোতে চাকরি করছেন। প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা বিভিন্ন এনজিওতে চাকরি করছেন।
অন্যদিকে স্থানীয়রা হয়ে পড়েছেন কর্মহীন। আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে সব ধরনের অনিয়ম করে যাচ্ছেন। আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের কারবারও তারা করছেন। পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ব্যবস্থা নিতে গেলে রোহিঙ্গারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পুলিশের দিকে আক্রমণ করতে আসে। যার ফলে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দিন দিন বাড়ছে অস্থিরতা।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, গত সাড়ে পাঁচ বছরে ক্যাম্পে ১৬৪টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন কমিউনিটি নেতা, স্বেচ্ছাসেবক ও সাধারণ রোহিঙ্গা।
ক্যাম্পের বাসিন্দারা বলছেন, মাদক ব্যবসা ও আধিপত্য বিস্তারের জেরে অধিকাংশ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। আবার অপহরণ করে চাঁদা না পাওয়ায় কিছু হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, ইয়াবা, মানবপাচার ও হাটবাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অভ্যন্তরে অন্তত ১৪টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীগোষ্ঠী সক্রিয় আছে। তাদের মাধ্যমে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।
সর্বশেষ গত ৭ জুলাই উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুস্কৃতিকারী সংগঠন আরসা এবং আরএসও সদস্যদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনায় আরসার হেড জিম্মাদার ক্যাম্প-৮ ডাব্লিউর এইচ-৪৯ ব্লকের আনোয়ার হোসেন (২৪), এ-২১ ব্লকের মোহাম্মদ হামীম (১৬), আরসা কমান্ডার ক্যাম্প-১০ এর এইচ ৪২ ব্লকের নজিবুল্লাহ, আরসার সক্রিয় সদস্য ক্যাম্প-৩ এর বি-১৭ ব্লকের নুর আমিনসহ পাঁচজন নিহত হন। এর আগের দিন ৬ জুলাই সকাল ১০টায় উখিয়ার কুতুপালংয়ের এক/ওয়েস্ট ক্যাম্পের এ/৯ ব্লকে সাব-মাঝি এবাদুল্লাহকে হত্যা করা হয়। এরও আগে ১৯ জুন সকালে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুই সন্ত্রাসী গ্রুপের গোলাগুলিতে ইমান হোসেন (১৮) নামে এক রোহিঙ্গা যুবক নিহত হন। এ সময় আহত হন আরো একজন। এর আগে ১৭ জুন কুতুপালং ক্যাম্পে নূর হোসেন প্রকাশ ভুট্টো (৪২) নামে রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতাকে (সাব-মাঝি) গুলি করে হত্যা করেছে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা।
রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, প্রথমদিকে ‘আরসা’ নিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভিন্ন মত থাকলেও ক্যাম্পের দুই রোহিঙ্গা নেতা, তিন মাঝি ও ছয় মুসল্লিসহ দুই ডজন খুনের ঘটনায় আরসা জড়িত বলে জেনেছেন তারা। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, তারা আরসা নয়; বরং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীগোষ্ঠী। চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বর্তমানে ১০টি সন্ত্রাসীগোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে হত্যাকাণ্ড ও সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে।
গত জুন থেকে চলতি জুন মাস পর্যন্ত ৩৮০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও শতাধিক গোলাবারুদসহ ১৬৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পাশাপাশি ২৬ লাখ ৩০ হাজার পিস ইয়াবা ও ২৯ কেজি আইসসহ ৭৭৯ জন রোহিঙ্গা অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হয়। একই সময়ে ৪৮ জন খুন হন। বেশির ভাগ ঘটনায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীগোষ্ঠী জড়িত। এসব ঘটনায় ১১৬ সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পাশাপাশি ১৩৬ রোহিঙ্গাকে অপহরণের ঘটনায় ১৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২৯ জন অপহরণকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছে টেকনাফের নয়াপাড়া, উনছিপ্রাং ও শালবন এবং উখিয়ার লম্বাশিয়া, কুতুপালং, জামতলী, ময়নারঘোনা ও মধুরছড়া ক্যাম্পে। ক্যাম্পে আরসার পাশাপাশি আরএসও সক্রিয় বলে দাবি করেছেন কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সদস্য সচিব এইচএম নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, মাদক থেকে শুরু করে অস্ত্র ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ এবং আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মাঝে মধ্যে অপরাধ ও হত্যাকাণ্ড ঘটায় আরসা ও আরএসও। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এসব সমস্যার একমাত্র সমাধান প্রত্যাবাসন। অন্যথায় কক্সবাজারের পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ।