
আসাদুর রহমান, হরিণাকুণ্ডু (ঝিনাইদহ) : আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক এক সংসদ সদস্য। ঝিনাইদহ-২ (সদর ও হরিণাকুণ্ডু) আসন থেকে হঠাৎ বিএনপির মনোনয়ন চাইছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নাসের শাহরিয়ার জাহেদী মহুল। মনোনয়ন না পেলে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে লড়বেন তিনি। এ নিয়ে ঝিনাইদহ জেলাজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনে সংসদ সদস্য পদ হারান এই আওয়ামী লীগ নেতা। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলার বহু অভিযোগ রয়েছে মহুলের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, নাসের শাহরিয়ার জাহেদী মহুলের এমপি হওয়ার স্বপ্ন ছিল দীর্ঘদিনের। ২০০৭ সালে আয়োজিত নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আম মার্কায় অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই নির্বাচন না হওয়ায় সেসময় স্বপ্ন অপূর্ণ থেকে যায় তার। সেই স্বপ্ন পূরণের পথ খোলো সবশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। বিএনপি-জামায়াতসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করলে আওয়ামী লীগ সব আসনে ডামি প্রার্থী দেয়। নৌকার বিরুদ্ধে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী ঠিক করে দেয় আওয়ামী লীগ। ঝিনাইদহ-২ আসনে আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থী হন মহুল। শেখ হাসিনার ইশারায় তাকে বিজয়ী করা হয়।
আওয়ামী লীগের প্রভাব ও পেশীশক্তি খাটিয়ে মহুলের ছোটভাই কাইয়ুম শাহরিয়ার জাহেদী হিজল ঝিনাইদহ পৌরসভার মেয়র পদ দখলে নেন। নির্বাচিত হওয়ার পর পৌরভবনে বসে মদপান করে আলোচনায় আসেন হিজল। পৌরসভার বেশিরভাগ ঠিকাদারি কাজ করাতেন নিজের বাড়ির কাজের লোকদের দিয়ে। এ নিয়ে ঠিকাদারদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই ঝিনাইদহ সদর উপজেলা পাগলাকানাই ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা যুবদলের সদস্য লিটন ম-লকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন করে দেয় মহুলের পালিত সন্ত্রাসীরা। হামলার সময় সন্ত্রাসীরা গোস্ত কাটা ডাসা দিয়ে তার একটি হাত শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন করে আর একটি হাত ও একটি পা কেটে ঝুলন্ত অবস্থায় ফেলে রেখে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। পাগলাকানাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান চিহ্নিত অস্ত্রধারী আবু সাইদ বিশ্বাস ও রাজন কসাইয়ের নেতৃত্বে যারা হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করে তারা সবাই মহুলের অনুসারী।
গত বছরের ১৬ জুলাই ঝিনাইদহে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা হয়। শহরের উজির আলী স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে এই হামলায় অনেকে আহত হন। তৎকালীন সংসদ সদস্য নাসের শাহরিয়ার জাহেদী মহুলের নির্দেশে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সজিব হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক আল ইমরান হামলায় নেতৃত্ব দেন।
গত বছরের অক্টোবরে হওয়া সর্বশেষ বাফুফে নির্বাচনে সহ-সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন মহুল। এতে ক্ষুব্ধ হন ঝিনাইদহে কোটা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। মহুলের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে গত বছরের ২৭ অক্টোবর ঝিনাইদহে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে বৈষ্যম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা। জেলা শহরের শহীদ মিনার চত্বরে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ঝিনাইদহ বৈষ্যম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া রায়হান উদ্দীন, যুথি খাতুন, মাহমুদুর রহমানসহ অন্যরা।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, মহুল ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও স্বৈরাচার সরকারের সর্বশেষ একতরফা নির্বাচনের এমপি। তিনি ও তার ভাই হিজল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন বানচাল করার অর্থ জোগান ও মদদদাতা ছিলেন। আন্দোলন চলাকালে আওয়ামী লীগ নেতা মহুল ও তার ভাই ছাত্রদের ওপর নির্যাতন চালানোর সবধরনের ব্যবস্থা করেন। আওয়ামী লীগের এ নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেন বক্তারা।
চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি ভুয়া ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’র কাগজপত্র তৈরি করে এক নারীর ২৩ শতক জমি বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগে নাসের শাহরিয়ার জাহেদীর মহুলের বিরুদ্ধে যশোর আদালতে মামলা হয়। মামলার বাদী যশোর শহরের কাজীপাড়া এলাকার আজিজ সিটির বাসিন্দা শেখ আবদুস সবুরের মেয়ে ফারজানা ইকবাল।
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মহুল। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি নোভারটিস বাংলাদেশ লিমিটেডের ২৩০ কোটি টাকার প্রায় ১০ লাখ শেয়ার রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের কাছে হস্তান্তরে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। অর্থপাচার ঠেকাতে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইক্তান্দার হোসাইন হাওলাদার নোটিশ পাঠান। এরই পূর্বে কেনা-বেচার প্রক্রিয়াটি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের কর্ণধার সালমান এফ রহমানের নেতৃত্বে সম্পন্ন করার কথা ছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের পর রেডিয়েন্টের মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি চলমান ছিল। সালমান এফ রহমানের অবর্তমানে রেডিয়েন্ট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের চেয়ারম্যান নাসের শাহরিয়ার জাহেদী মহুল বর্তমানে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের ব্যবসায়িক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় দেখভাল করছেন বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
জানতে চাইলে সাবেক এমপি নাসের শাহরিয়ার জাহেদী মহুল সাংবাদিকদের বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে আমার ভুমিকা রাখার প্রয়োজন আছে। তাই আমি ঝিনাইদহ-২ আসনের উন্নয়নে কাজ করতে চাই। জনগণ আমার সঙ্গে আছে বলেই আগামী সংসদ নির্বাচনে আমি অবশ্যই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব। গত নির্বাচনে জনগণ আমার পাশে ছিল বলেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও চরম প্রতিকূলতার মধ্যে আমি নির্বাচিত হয়েছিলাম।
তিনি আরও বলেন, বিএনপির দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হতে পারলে স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন, রেললাইন স্থাপন, বেকার সমস্যা সমাধান হবে আমার মূল লক্ষ্য।

