মার্কিন নির্বাচনী প্রচারণার একেবারে শেষ মুহূর্তে দোদুল্যমান রাজ্যগুলো চষে বেড়ান রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ডেমোক্র্যাট দলীয় জো বাইডেন।
শেষ সময়ে এসে গত রোববার ৭৪ বছর বয়সী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অন্তত পাঁচটি ব্যাটেলগ্রাউন্ড রাজ্য সফর করেছেন; অন্যদিকে তার অন্যতম প্রতিদ্ব›দ্বী ৭৭ বছর বয়সী জো বাইডেন পেনসিলভানিয়ায় নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছেন। মার্কিন নির্বাচনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফল নির্ধারক রাজ্য হিসেবে পরিচিত পেনসিলভানিয়ায় ব্যাপক লড়াইয়ের ইঙ্গিত মিলছে।
মঙ্গলবারের নির্বাচনের আগে জনমত জরিপে এখন পর্যন্ত ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে আছেন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেন। কিন্তু নির্বাচনী ফল নির্ধারণ করতে পারে এমন রাজ্যগুলোতে ট্রাম্পের সঙ্গে তার ব্যবধান খুব বেশি নয়।
এদিকে, দেশটিতে এখন পর্যন্ত ৯ কোটিরও বেশি মানুষ আগাম ভোট দিয়েছেন; যা গত এক শতাব্দির মতো সর্বোচ্চ আগাম ভোটের রেকর্ড।
মার্কিন এই নির্বাচন এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হচ্ছে যখন দেশটিতে করোনাভাইরাস মহামারির তীব্র তাÐব চলছে। বিশ্বজুড়ে এখন পর্যন্ত করোনার সর্বোচ্চ দৈনিক সংক্রমণ এবং মৃত্যুও এই দেশটিতে ঘটছে। গত রোববারও যুক্তরাষ্ট্রে ৮১ হাজারের বেশি মানুষ নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।
মহামারি নিয়ন্ত্রণে ট্রাম্প প্রশাসনের সমালোচনা করে রোববার হোয়াইট হাউসের তিরস্কারের শিকার হয়েছেন দেশটির করোনা প্রতিরোধে গঠিত টাস্ক ফোর্সের প্রধান ও শীর্ষ ভাইরাস বিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউসি।
\ যা বলছেন ট্রাম্প-বাইডেন \
গত রোববার অত্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প; আইওয়া, মিশিগান, নর্থ ক্যারোলিনা, জর্জিয়া এবং ফ্লোরিডায় সমাবেশ করেছেন তিনি। ওয়াশিংটনে সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তৃতায় ট্রাম্প বলেছেন, তার নেতৃত্বে সরকারি গাড়ি উৎপাদন শিল্প পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। বর্তমানে দেশটির অর্থনীতি অত্যন্ত দ্রæতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে দাবি করেছেন তিনি।
চলতি বছরের তৃতীয় অর্থনৈতিক প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি রেকর্ড ভাঙা ৩৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। যদিও দ্বিতীয় প্রান্তিকে দেশটির অর্থনীতিতে ৩১ শতাংশ সংকোচন ঘটে; যা যুক্তরাষ্ট্রের ৮০ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ সংকোচন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, মার্কিন অর্থনীতির ওপর এই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে কয়েক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দেশটির অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক এই প্রভাব পড়েছে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন তারা।
পরবর্তীতে আইওয়া অঙ্গরাজ্যে কন্যা ইভানকা ট্রাম্প এবং সহযোগী হোপ হিকসের সঙ্গে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেন ট্রাম্প। এ সময় তিনি সীমান্ত সুরক্ষা এবং আদালতে আরও রক্ষণশীল বিচারক নিয়োগের প্রতিশ্রæতি দেন তিনি।
করোনাভাইরাস মহামারির ব্যাপারে সমর্থকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, তাদের কাছে দুটি বিষয় রয়েছে; যেখান থেকে তারা যেকোনও একটি বেছে নিতে পারেন। এর মধ্যে একটি বাইডেনের প্রাণঘাতী লকডাউন অন্যটি মহামারি শেষ করতে সক্ষম নিরাপদ ভ্যাকসিন।
ট্রাম্প যখন আইওয়াতে ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টা করেছেন; ঠিক সেই সময় বাইডেন তার নিজ রাজ্য ও জন্মস্থান পেনসিলভানিয়ায় ছুটেছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে এই রাজ্যকে অন্যতম প্রধান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০১৬ সালের নির্বাচনে সামান্য ব্যবধানে জয় পেয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু চলতি বছরের জনমত জরিপগুলোতে এই রাজ্যে জো বাইডেনের এগিয়ে থাকার আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
ফিলাডেলফিয়ায় নির্বাচনী সমাবেশে অংশ নিয়ে জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রে পদ্ধতিগত বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আহŸান জানান। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলার কৌশলের তীব্র সমালোচনা করেন তিনি।
তিনি বলেন, ট্রাম্প করোনাভাইরাস মোকাবিলা করেছেন প্রায় অপরাধমূলক উপায়ে। কৃষ্ণাঙ্গ স¤প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে; যা একেবারে অপ্রয়োজনীয়।
এর আগে, এক টুইটে জো বাইডেন বলেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প লাতিন পরিবারগুলোর মর্যাদায় আঘাত হেনেছেন। আমি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে এটির অবসান ঘটবে।
\ দুই প্রার্থীর প্রতিশ্রæতিতে পার্থক্য \
যুক্তরাষ্ট্রের এবারের নির্বাচনে প্রধান প্রধান কিছু ইস্যুতে নেয়া দুই প্রতিদ্ব›দ্বীর নীতিমালায় মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় গত জানুয়ারিতে একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বর্তমানে এই টাস্ক ফোর্স দেশে সবকিছু চালু এবং সুরক্ষার ব্যাপারে তাদের মনযোগ ঘুরিয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
কোভিড-১৯ এর চিকিৎসা অথবা ভ্যাকসিন তৈরির কাজ দ্রæতগতিতে শেষ করতে মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট এক হাজার কোটি ডলারের প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। কিন্তু জো বাইডেন নির্বাচিত হলে প্রত্যেক রাজ্যে করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য অন্তত ১০টি কেন্দ্র চালু করার প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন।
এছাড়া জাতীয়ভাবে কন্ট্যাক্ট-ট্রেসিং কর্মসূচি বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। দেশজুড়ে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরিধানের ব্যাপারেও নিজের সমর্থনের কথা জানিয়েছেন বাইডেন।
জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে ট্রাম্প শুরু থেকেই সন্দেহপ্রবণ অবস্থানে রয়েছেন। পুনর্নবায়নযোগ্য জ্বালানির স¤প্রসারণ করতে চান না তিনি। এছাড়া প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তিনি।
তবে জো বাইডেন বলেছেন, তিনি নির্বাচিত হওয়া মাত্রই যুক্তরাষ্ট্রকে প্যারিস চুক্তিতে ফেরাবেন। শুধু তাই নয়, ২০৫০ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃস্বরনের পরিমাণ শূন্যের কোটায় আনতে চান তিনি।
দ্বিতীয় দফায় নির্বাচিত হলে আগামী ১০ মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। পাশাপাশি নতুন নতুন ক্ষুদ্র ব্যবসা খাতে আরও ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা এবং আয়কর হ্রাস ও যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে কোম্পানিগুলোকে সরকারের দেয়া ঋণেও সুদ হার কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
অন্যদিকে, জো বাইডেন দেশের উচ্চ আয়ের মানুষদের কর বৃদ্ধি করতে চান। তবে যারা বছরে ৪ লাখের বেশি ডলার আয় করেন তাদের ওপর প্রয়োগ করতে চান আয় কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত।
যুক্তরাষ্ট্রের অতীতের নির্বাচনের দিকে তাকালে দেখা যায়, ভোট গণনা করতে কয়েকদিন সময়ের দরকার হয়। কিন্তু কে হতে যাচ্ছেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট; তা নির্বাচনের রাতেই প্রায় পরিষ্কার হয়ে যায়।
২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় পরদিন বিকেল ৩টার দিকে উল্লাসরত সমর্থকদের উদ্দেশে বিজয়ী ভাষণ দেয়ার জন্য নিউইয়র্কে মঞ্চে আসেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
কিন্তু এবার নির্বাচনী ফল এতো দ্রæত নাও আসতে পারে। দেশটির কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, চ‚ড়ান্ত নির্বাচনী ফল জানতে এবারে কয়েকদিন এমনকি কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। কারণ হিসেবে চলতি বছরের নির্বাচনে রেকর্ড গড়া আগাম ভোটের কথা বলছেন তারা।
দেশটিতে এখন পর্যন্ত ৯ কোটি ১০ লাখের বেশি মানুষ আগাম ভোট দিয়েছেন; যাদের প্রায় অর্ধেকই ডাক যোগে। এছাড়া ২০০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল জানতে ভোট গ্রহণের দিন থেকে প্রায় এক মাস সময় অপেক্ষা করতে হয়েছিল। কারণ সেই সময় দেশটির সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বিজয়ী প্রেসিডেন্টের নাম ঘোষণা করা হয়।