
সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর: ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস হলেও আজ ১৪ জুলাই সোমবার বাংলাদেশে পালিত হচ্ছে দিবসটি। এ প্রেক্ষাপটে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস ২০২৫-এর মূল প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে ‘ন্যায্য ও সম্ভাবনাময় বিশ্বে পছন্দের পরিবার গড়তে প্রয়োজন তারুণ্যের ক্ষমতায়ন’। এ প্রতিপাদ্য অনুযায়ী বিশ্বের মতো আমাদের বাংলাদেশের তরুণ-যুব জনগোষ্ঠীও একটি বড় সংখ্যা, বড় চ্যালেঞ্জ ও বড় সম্ভাবনার।
১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির গভর্নিং কাউন্সিল জনসংখ্যা ইস্যুতে গুরুত্ব প্রদান ও জরুরি মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯০ সালের ১১ জুলাই প্রথমবারের মতো ৯০টি দেশে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস উদযাপিত হয়। ১৯৮৭ সালে বিশ্ব জনসংখ্যা যখন ৫ বিলিয়ন (৫০০কোটি) পৌঁছেছিল, ঠিক তারপর জনসংখ্যা সংক্রান্ত বিষয়গুলির প্রতি বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য-যেমন টেকসই উন্নয়ন (Sustainable Development) এবং কল্যাণমূলক প্রকল্প সমূহকে উৎসাহিত করার জন্য ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির গর্ভনিং কাউন্সিল ১১ জুলাইকে ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করে।
১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ৪৫/২১৬ রেজুলেশনের মাধ্যমে পরিবেশগত ও উন্নয়নমূলক উদ্বেগের সাথে এর সংযোগের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে প্রতি বৎসর ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯০ সালের ১১ জুলাই ৯০টির বেশী দেশে প্রথম ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’ পালিত হয়। তারপর থেকেই উ.এন.ডি.পি (UNDP) এর বিভিন্ন দেশীয় অফিস, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান , সরকার এবং নাগরিক সমাজ এই দিনটি পালন করে আসছে।
বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন যে বিশ্বের জনসংখ্যা ২০২৫ সালে ৮.২ বিলিয়ন ( ৮২০ কোটি) ছাড়িয়ে যাবে। আর এই বৃদ্ধির বেশীর ভাগ অংশ সাব-সাহারান আফ্রিকান দেশ ,দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অংশে ঘটছে, যেখানে জন্মহার এখনো বেশ উচ্চ। ২০৩০ সালে বিশ্বের জনসংখ্যার পরিমাণ প্রায় ৮৫০ কোটি, ২০৫০ সালে প্রায় ৯৭০ কোটি এবং ২১০০ সালে ১০৯০ কোটি হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। অন্যদিকে, উন্নত দেশে বৃদ্ধির গতি কমেছে বা মোট জনসংখ্যার পরিমাণ কমছে। এটা স্পষ্ট যে বিপরীতমুখী প্রবণতাগুলি বিশ্বজুড়ে জনসংখ্যা বন্টনে ক্রমবর্ধমান ভারসাম্য হীনতার সৃষ্টি করেছে। পরিবেশগত বিপর্যয় এবং অতিরিক্ত জনসংখ্যার ফলে সৃষ্ট অভাব “সহিংসতা ও রাজনৈতিক অস্হিরতা” বৃদ্ধি করছে।
আমরা ইতিমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্য ও অন্যান্য অঞ্চলে জল, ভূমি ও জ্বালানি-সম্পদ নিয়ে যুদ্ধ দেখতে পেয়েছি / পাচ্ছি। বিশ্ব জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই অস্থিরতা ও সংঘর্ষ বাড়ার সম্ভাবনা প্রবল।ইউ.এন.ডি.পি ‘২০২৫ বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’ কে যুব ক্ষমতায়ন এর উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। প্রতিপাদ্য বিষয় “যুবকদের বিনিয়োগ: পরবর্তী প্রজন্মের ক্ষমতা”। এই বিষয়টি বিশ্বব্যাপী নানাহ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও টেকসই উন্নয়নকে চালু ও গতিশীল রাখতে তরুনদের চাহিদা-পূরণও সম্ভাবনার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। বিশ্বে বর্তমানে উর্বরতার ( Global Fertility Rates) হার কমছে, এবং ইহা জনসংখ্যা হ্রাসের সতর্ক-সংকেত। কিন্তূ জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (UNFPA) এর বিশ্ব জনসংখ্যার প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে জনসংখ্যা হ্রাসের আসল কারণ হল ‘প্রজনন সংস্থার অভাব’ – অনেক মানুষ, বিশেষ করে তরুণরা, তাদের পছন্দের সন্তান ধারণ করতে অক্ষম। উর্বরতার হার হ্রাস বিশ্বব্যাপী শিরোনামে আসারফলে, বিভিন্নদেশেরকিছু সরকার “জনসংখ্যা হ্রাস” সম্পর্কে সতর্ক করে জন্মহার বৃদ্ধির জন্য কঠোর নীতিমালা প্রণয়নকরেছে, অন্যদিকেযদিওএকই সাথে লক্ষ লক্ষ মানুষ এখনও তাদের প্রকৃত চাহিদা অনুযায়ী সন্তান ধারণ করতে পারছে না।
‘২০২৫ বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস’ এই চ্যালেঞ্জটি তুলে ধরেছে এবং সর্বকালের বৃহত্তম প্রজন্মের তরুণদের উপর গুরুত্ব আরোপ করছে। বলা বাহুল্য যে বর্তমানে বিশ্বে ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী প্রায় ১৪৫ কোটি তরুন আছে। “একটি নায্য এবং আশাবাদী বিশ্বে তাদের পছন্দের পরিবার তৈরী করতে তরুণদের ক্ষমতায়ন করা” এই বছরের ‘বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসে’র ভাবনা (থিম)। যুবকদের ভবিষ্যত গঠনের অধিকার, সরঞ্জাম এবং সুযোগ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল। বর্তমানে তরুন – তরুনীরা ডিজিটাল ভাবে যুক্ত, পরিবর্তন আনতে প্রস্তুত, তারা নিজেদের স্থানীয় সম্প্রদায় এবং তার বাইরেও সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি ক্রমবর্ধমান ভাবে এগিয়ে নিচ্ছেন কিন্তূ তারা কিছু বড় বাধার সম্মুখীন ,যেমন অর্থনৈতিক নিরাপত্তা হীনতা ,লিঙ্গবৈষম্য, সীমিত স্বাস্থ্যসেবা এবং জলবায়ু বিঘ্নতা এবং সংঘাত। ১৪টি দেশের ১৪ হাজার জনেরও বেশী মানুষের উপর করা UNFPA- You Gov জরিপে দেখা যায় যে অধিকাংশের বেশী মানুষ (interviewees) আরো বেশি সংখ্যক সন্তান নিতে ইচ্ছা / আকাঙ্খা প্রকাশ করেন, কিন্তূ সামাজিক, অর্থনৈতিক বা স্বাস্থ্যগত প্রতিকুলতার জন্য তারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। UNFPA-এর সর্বশেষ বিশ্ব জনসংখ্যা প্রতিবেদন অনুসারে, আসল সংকট জনসংখ্যার ‘সংখ্যা’নিয়ে নয়। এটি মানুষের নিজস্ব পছন্দ করার ক্ষমতা হারানোর বিষয়ে। এটি প্রজনন স্বাধীনতার সংকট। ভবিষ্যতের আশঙ্কা, যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশগত অবক্ষয়, যুদ্ধ ও মহামারী ইত্যাদি – উর্বরতা সিদ্ধান্ত (Fertility Decision) এর উপর প্রভাব ফেলছে।
প্রায় পাঁচ জনের মধ্যে একজন বলেছেন যে উপরোক্ত উদ্বেগ সমূহ তাদেরকে কাঙ্ক্ষিত সংখ্যার চেয়ে কম সন্তান ধারনের দিকে পরিচালিত করেছে বা করবে। আবাসন, শিশু-যত্ন খরচ ও লালন-পালন সমস্যা এবং চাকরির নিরাপত্তা হীনতা সহ নানাহ অর্থনৈতিক কারন গুলি পরিবারের ‘আকার’ ধারণের প্রধান সীমাবদ্ধতা। UNFPA এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩৯% রিপোর্ট করেছেন যে আর্থিক সমস্যাগুলি তাদের কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক সন্তান ধারণের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করেছে। বিশ্বব্যাপী সন্তান-ধারণের গড় বয়স ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে এখন ২৮ বছরে দাঁড়িয়েছে। প্রজনন বয়সের ২০% প্রাপ্ত বয়স্ক মনে করেন যে তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক সন্তান-ধারণ করতে পারবেন না। অন্যদিকে, প্রজনন স্বাস্থ্য সেবার অ্যাক্সেস একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে রয়ে গেছে, প্রায় ১.৮% লোক গর্ভ-নিরোধক বা উর্বরতা সম্পর্কিত পরিষেবা পেতে অসুবিধার কথা বলেছেন।
পরিবার পরিকল্পনা,মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য,লিঙ্গ সমতা,দারিদ্র্য হ্রাস,টেকসই উন্নয়ন এই বিষয়গুলো আমাদের সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সম্পৃক্ত সমস্যাগুলো সমাধানে একসাথে কাজ করতে হবে। আসুন, আমরা সবাই পরিবার পরিকল্পনা, শিক্ষা ও সচেতনতার মাধ্যমে একটি সুন্দর, স্বাস্থ্যকর এবং টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তুলি।