
সিরাজুল, শ্যামনগর: সিরাজুল ইসলাম সাতক্ষীরা ।খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকারÑজীবনের জন্য যেমন অক্সিজেন অপরিহার্য, তেমনি টিকে থাকার জন্য বিশুদ্ধ খাদ্য। কিন্তু আজ আমরা এমন এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি, যেখানে প্রতিদিনের খাদ্যই ধীরে ধীরে আমাদের মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশেষত সাতক্ষীরা জেলার কৃষিপ্রধান উপজেলা আশাশুনি, শ্যামনগর, কলারোয়া, সাতক্ষীরা সদর, কালিগঞ্জ ও তালার চিত্রই যেন আজ সারাদেশের প্রতিচ্ছবি।
এখানে ভেজাল খাদ্য যেন অভ্যস্ততার পর্যায়ে পৌঁছে গেছেÑসবাই জানে, তবুও কেউ কিছু বলে না। নীরবতা, নিষ্ক্রিয়তা আর অদৃশ্য মাফিয়া চক্রের প্রভাবই যেন আজ সবচেয়ে ভয়ানক বিষ। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে ভেজালের বিস্তার মাঠ থেকে থালায়। খাদ্য দূষণের প্রক্রিয়া শুরু হয় মাঠ থেকেই। কৃষক অধিক উৎপাদনের আশায় ব্যবহার করছেন অনিরাপদ কীটনাশক, অতিরিক্ত সার, এমনকি নিষিদ্ধ ঘোষিত রাসায়নিক দ্রব্য।
এরপর মজুতকারী ও ব্যবসায়ীরা ফলমূল পাকাতে ক্যালসিয়াম কার্বাইড, মাছ ও মাংস সংরক্ষণে ফরমালিন, সবজিতে ইথেফেন, চাল পালিশ করতে টেক্সটাইল রং, এমনকি বিস্কুট ও মিষ্টিতে কাপড়ের রং ও লেবারেটরি কেমিক্যাল পর্যন্ত ব্যবহার করছেন। এই খাদ্য বাজারে বিক্রি হচ্ছে কোনো সতর্কবার্তা ছাড়া।
সাতক্ষীরার স্থানীয় বাজার যেমনÑআশাশুনি সদরের কাদাকাটি, বড়দল, বুধহাটা, শ্যামনগরের নূরনগর, তালার আঠার মাইল কিংবা দেবহাটার পারুলিয়াÑপ্রতিদিন এসব বাজারে ক্রেতারা যে খাদ্য কিনছেন, তার নিরাপত্তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। অথচ জেলা প্রশাসন কিংবা বিএসটিআই’র নজরদারি খুবই সীমিত।
খাদ্য দূষণের সঙ্গে পরিবেশ দূষণের রয়েছে গভীর যোগসূত্র। সাতক্ষীরার বিস্তীর্ণ চিংড়ি ঘের ও মাছচাষ নির্ভরতা অনেকাংশে নদী ও খালনির্ভর। কিন্তু নদীর পানি এখন ঘের ও মানুষ সৃষ্ট বর্জ্যে দূষিত। ভারতের সীমান্তঘেঁষা অঞ্চলে এসব বর্জ্যপণ্য প্রবেশ করছে অত্যন্ত অনিয়ন্ত্রিতভাবে।
এসব দূষিত পানি দিয়ে উৎপাদিত ধান, শাকসবজি ও মাছ আমাদের শরীরে জমা করছে লেড, মারকিউরি, ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিকসহ ভয়ংকর ভারী ধাতু, যা একসময় ডিএনএ পর্যন্ত ধ্বংস করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব বিষাক্ত উপাদান দেহে ঢুকে ধীরে ধীরে লিভার সিরোসিস, কিডনি বিকলতা, গ্যাস্ট্রিক ক্যান্সার, থাইরয়েড সমস্যা, এমনকি মানসিক বিকার সৃষ্টি করছে।
শিশুদের মানসিক বিকাশে স্থবিরতা, বুদ্ধিবৃত্তিক দুর্বলতা ও শারীরিক বিকলাঙ্গতাও এখন ভেজাল খাদ্যের পরোক্ষ ফলাফল। জাতীয় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ও জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একাধিক সমীক্ষায় দেখা গেছেÑচালের ১৩টি নমুনায় আর্সেনিক, ৫টি নমুনায় ক্রোমিয়াম, হলুদের ৩০টি নমুনায় সীসা, লবণে ২০ গুণ বেশি সীসা, তেল, বিস্কুট, দুধ, কেকসহ ৭৪টি নামিদামী পণ্যে ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া গেছে।
৪০% খাদ্যপণ্যে সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েক গুনগুণ বেশি বিষাক্ত রাসায়নিক। সাতক্ষীরার মেডিকেল রেকর্ড ঘাটলেও দেখা যাবে, কিডনি ও লিভার রোগীর সংখ্যা বিগত পাঁচ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে। শুধু সাতক্ষীরায় প্রতিবছর ক্যান্সার আক্রান্ত নতুন রোগীর সংখ্যা কয়েকশত ছাড়িয়ে যাচ্ছে, যার পেছনে অন্যতম কারণ হলোÑদীর্ঘমেয়াদি খাদ্যবিষক্রিয়া।
নিরাপদ খাদ্য আইন (২০১৩), ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন (২০০৯), ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন (২০১৫)Ñএসব আইন কাগজে কলমে থাকলেও মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন দুর্বল। আশাশুনি, তালা, কালিগঞ্জ, শ্যামনগরের মতো উপজেলায় নিয়মিত মোবাইল কোর্ট কার্যক্রম দুর্লভ।
ভেজাল খাদ্য প্রস্তুতকারীরা প্রভাবশালী রাজনৈতিক ও ব্যবসায়ী চক্র দ্বারা রক্ষিত হওয়ায় প্রশাসনের ভূমিকা অনেক সময় প্রশ্নবিদ্ধ। অনেক সময় ধরা পড়লেও বিচারের মুখোমুখি হয় না অপরাধীরা।আমাদের বড় ব্যর্থতা হলোÑসচেতনতার ঘাটতি। একজন গৃহবধূ জানেন না কোন সবজিতে ফরমালিন, একজন কৃষক জানেন না কোন রাসায়নিক কতটা মারাত্মক।
স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে নেই বাস্তবভিত্তিক আলোচনা। গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রতিবেদন হয় না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও এই বিষয়টিকে অবহেলা করে থাকেন।
সাতক্ষীরাকে ভেজালবিরোধী আন্দোলনের মডেল অঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলতে নিচের পদক্ষেপগুলো জরুরি: প্রতি উপজেলায় মাসে অন্তত দুটি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা বাধ্যতামূলক করা, রাসায়নিক আমদানিতে এনবিআরের কড়াকড়ি ও ট্রেসিং ব্যবস্থা চালু, প্রতিটি বাজারে খাদ্য পরীক্ষার জন্য মোবাইল ল্যাব চালু, স্কুল পর্যায়ে ‘নিরাপদ খাদ্য’ বিষয়ক সচেতনতামূলক ক্লাস বাধ্যতামূলক করা, কৃষকদের জৈব কৃষি প্রশিক্ষণ ও প্রণোদনা দেওয়া, গণমাধ্যম, চিকিৎসক, শিক্ষক, এনজিও ও পুরোহিত, ইমামদের সম্পৃক্ত করে ব্যাপক ক্যাম্পেইন, ভেজালকারীদের ছবি ও নাম জনসমক্ষে প্রকাশ করে সামাজিকভাবে বয়কট করা, শেষ কথায় বলিÑ‘খাদ্য যদি বিষ হয়, তবে উন্নয়ন অর্থহীন’একটি জাতির শক্তি তার সুস্থ জনগণ।
সাতক্ষীরা তথা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের নিরাপদ খাদ্য পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত না হলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতিÑসবই অকার্যকর হয়ে যাবে। আমাদের শিশুরা যেন আর বিষ খেয়ে বড় না হয়, কৃষক যেন পণ্য উৎপাদন করে গর্ব করতে পারেন, ভোক্তা যেন বাজারে গিয়ে ভয় না পানÑএই স্বপ্ন বাস্তবায়নে আসুন আজই আমরা সোচ্চার হই, সংগঠিত হই।জোরে সোরে ভেজাল বিরোধী যুদ্ধ সাতক্ষীরা থেকেই শুরু হোকÑএই প্রত্যাশা।(সচ্চিদানন্দদে সদয়, সাংবাদিক)