
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : শুরু হয়েছে ঘূর্ণিঝড় জালোচ্ছাসের মৌসুম চলবে বৈশাখের মাঝামাঝি পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়ের কথা শুনলেই সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, মুন্সিগঞ্জ, বুড়ি গোয়ালিনী ,আটুলিয়া ,কাশিমাড়ী ,পদ্মপুকুর, রমজান নগর ও কৈখালীর মানুষ আঁতকে ওঠেন। ঝড়-বৃষ্টিতে নদীর পানি বাড়লেই বাঁধ ভেঙে প্লাবনের শঙ্কা তৈরি হয়। ঝুঁকিতে রয়েছে উপকূল জুড়ে থাকা অধিকাংশ বেড়িবাঁধ। বিশেষ করে গাবুরা ইউনিয়নের গাবুরা-২, গাবুরা-৩ ও লেবুবুনিয়া পয়েন্টে বেড়িবাঁধ বেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তবে বর্তমানে সেখানে বাঁধ নির্মাণসহ ১ হাজার ২০ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এই প্রকল্প শেষ হলে ২৯ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিমুক্ত হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
পাউবোর তথ্যনুযায়ী সাতক্ষীরা অঞ্চলে ৬৭৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। তার মধ্যে বর্তমানে ১৩ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। অনেক এলাকায় বাঁধ কমবেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ষাটের দশকে মাটি দিয়ে তৈরি ঐ বেড়িবাঁধ ছিল ১৪ ফুট উঁচু ও ১৪ ফুট চওড়া ও প্রায় ৬০ ফুট তলা। কিন্তু প্রায় ৭০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের উচ্চতা ও চওড়ার অর্ধেকও এখন অবশিষ্ট নেই। অর্থাভাবে দীর্ঘদিনেও প্রয়োজন অনুযায়ী সংস্কার করতে না পারায় ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়। ষাটের দশকে তৈরি ঐ বেড়িবাঁধের বেশিরভাগই দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা হারিয়েছে। ফলে বাঁধগুলো ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস এবং নিম্নচাপ, লঘুচাপ, আমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারে লোকালয়ে পানি ঢোকা ঠেকাতে পারছে না। ফলে সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর ও আশাশুনির কয়েক লাখ মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম বলেন, চারপাশে কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়া নদী দ্বারা বেষ্টিত তার ইউনিয়ন। এই ইউনিয়নের গাবুরা, নাপিতখালী, জেলেখালী, তিন নম্বর পোল্ডারসহ বিভিন্ন এলাকায় উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। সাগরে নিম্নচাপের প্রভাব হলে কপোতাক্ষ নদ ও খোলপেটুয়া নদীর জোয়ারের উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। জোয়ারের সময় বাঁধের কানায় কানায় পানি ওঠে। বেড়িবাঁধের অবস্থা খুবই নাজুক ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে। তবে এখানে মেগা প্রকল্পের কাজ শেষ হলে অত্র এলাকার হাজার হাজার মানুষ উপকৃত হবে।
এছাড়া আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর, শ্রীউলা, আনুলিয়া ও আশাশুনি সদরের বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। আগামী বর্ষা মৌসুমে শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার কপোতাক্ষ, খোলপেটুয়া ও চুনা নদীতে জোয়ারের পানি বাড়ার কারণে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার আতঙ্কে রয়েছেন উপকূলবাসী। মুন্সীগঞ্জ এলাকার বিপ্লব হোসেন জানান, উপকূলের বিভিন্ন জায়গায় ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ নিয়ে সবাই আতঙ্কে রয়েছেন। কারণ ঝড়-বৃষ্টিতে উপকূলে কিছু না কিছু প্রভাব পড়েই।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন জানান, পাউবো-১ এর আওতায় ৩৮০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের মধ্যে ৭ কিলোমিটার অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চারিদিকে নদী দ্বারা বেষ্টিত গাবুরা ইউনিয়নের মানুষের বাঁধভাঙন থেকে রক্ষা করতে স্থায়ী টেকসই বেড়ীবাঁধ নির্মাণ, খাল খনন, স্লুইসগেট নির্মাণসহ নানা কাজের জন্য সরকারিভাবে ১ হাজার ২০ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। ইতিমধ্যে কাজের ২০ শতাংশ শেষ হয়েছে। এই প্রকল্প শেষ হলে ২৯ কিলোমিটার বাঁধ পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত হবে। বড় ধরনের দুর্যোগ না এলে বাঁধ ভাঙার সম্ভাবনা নেই বলে জানান তিনি। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আশিকুর রহমান বলেন, পাউবো-২ এর আওতাধীন বেড়িবাঁধগুলোর ভেতরে ২৯৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এরমধ্যে পাঁচ/ছয় কিলোমিটর অধিক ঝুঁকিপূর্ণ। বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত না হানলে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না।
কাজের তদারকিতে থাকা সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের এসও মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, গাবুরার অসহায় ও নিরীহ মানুষের কথা চিন্তা করে সরকার ১ হাজার ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘সাতক্ষীরা জেলার পোল্ডার নং-১৫ পুনর্বাসন প্রকল্প’ নামের একটি মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। প্রায় ৪০ টি প্যাকেজে উক্ত কাজ চলমান রয়েছে। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর জানান, উপকূলীয় শ্যামনগরের গাবুরায় বাঁধ নির্মাণসহ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। উক্ত কাজ সম্পন্ন হলে সুফল ভোগ করবে এলাকার জনগোষ্ঠী।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড ১ ও ২ এর আওতাধীন জেলায় ৬৭৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ২১টি পয়েন্টের ৩৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে পাউবো বিভাগ-১-এর অধীনে ছয়টি পয়েন্টে তিন কিলোমিটার ও বিভাগ-২-এর অধীনে ১৫টি পয়েন্টে ৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ।
এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী বড় ধরনের কোন ঘুর্ণিঝড় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের আভাস শুনলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সাতক্ষীরার উপকূলীয় শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলার নদীভাঙন এলাকায় বসবাসরত সাধারণ মানুষ।
ঘূর্ণিঝড়ের স্বাভাবিক ক্ষয়ক্ষতির বাইরেও উপকূলীয় সাতক্ষীরা ও খুলনা অঞ্চলের মানুষের সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক তৈরী করে এই অঞ্চলের নদ নদীর বেড়িবাঁধ। ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা যাই হোক না কেন, নদীতে জোয়ারের সময় সামান্য ঝড়েও বাধগুলো ভেঙে লোকালয় ও ফসলী জমি প্লাবিত হয়।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ২৬ মে মধ্যরাতে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ উপকূলের সমুদ্র তীরবর্তী এবং আশপাশের অঞ্চলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। ২০২৩ সালের ১৪ মে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের উপকূলে আঘাত হানে মোখা। এতে বাংলাদেশে কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও সাতক্ষীরা উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ২০২২ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আসানিতে প্রাথমিকভাবে অন্ধপ্রদেশ প্রভাবিত হয়। বাংলাদেশে কম ক্ষতি হয়। ২০২১ সালের ২৬ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস।
২০২০ সালে সুপার সাইক্লোন আম্ফান বাংলাদেশে আঘাত হানে ২০ মে। এতে উল্লেখযোগ্য ধ্বংস এবং প্রাণহানি ঘটে। ২০১৯ সালের ২ ও ৩ মে ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। প্রাণ হারান ৯ জন। ফণী ভারতের ওড়িশা উপকূলে আঘাত হানে এবং পরে কলকাতা ও বাংলাদেশের ওপর দিয়ে চলে যায়।
ঘূর্ণিঝড় মোরা উপকূল এলাকায় আঘাত করে ২০১৭ সালের ৩০ মে। প্রতি ঘণ্টায় বাতাসের গতি ছিল ১১০ কিমি.। মোরার প্রভাবে উপকূলে মারাত্মক ক্ষতি হয়। ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু উপকূলে আঘাত হেনেছিল ২০১৬ সালের ২১ মে। এতে চট্টগ্রামে ২৪ জনের মৃত্যু হয়। ৪-৫ ফুট উঁচু ঝড়ের ঢেউয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় লক্ষাধিক পরিবার। ঘূর্ণিঝড় মহাসেন উপকূলে আঘাত হানে ২০১৩ সালের ১৬ মে। এতে ১৭ জনের মৃত্যু হয়।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী এসব ঘূর্ণিঝড়ের কয়েকটি বাদে অধিকাংশতেই সাতক্ষীরা ও খুলনা উপকূলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। ফলে মে মাস এলেই এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।
উপকুলীয় বাসিন্দা প্রসাদ মন্ডল জানান, প্রতিবছর মে মাস আসলে আমাদের মনে খুব ভয় ধরে। বিভিন্ন দুর্যোগে নদের বাঁধ ভেঙে গ্রামে পানি ঢুুকে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সাইক্লোন সেন্টার গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়। জোয়ারের পানিতে ঘরের ভেতর থাকা মালামাল জিনিসপত্র সব ভেসে যায়
উপকূলীয় কপোতাক্ষ নদীর চরের বাসিন্দা নুরজাহান খাতুন বলেন, প্রতিবছর এই মে মাসে বিভিন্ন ঝড় ঝঞ্ঝা আসে। আমরা নদীর চরে থাকি আমাদের ঘর ভেঙে যায়। আবার কষ্ট করে ঠিক করি। মহেশ্বরীপুর গ্রামের বাসিন্দা মোঃ সিদ্দিকুর রহমান বলেন, মে মাসে খুব ভয় হয় বিভিন্ন দুর্যোগে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এখনো সে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তিনি আরো বলেন, আমাদের বাড়ির সামনের বেড়িবাঁধটা ঠিক করলে রাতে একটু ঘুম পড়তে পারতাম।
উপকূলের বাসিন্দা আশাশুনির বিছট গ্রামের আব্দুল হাকিম মোড়ল জানান, পাউবো বিভাগ-২-এর আওতাধীন ৭/২ পোল্ডারের বিছট সরকারি প্রাইমারি স্কুল থেকে বিছট খেয়াঘাট পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার বেড়িবাঁধ খুই ঝুঁকিপূর্ণ। গত ৩১ মার্চ ঈদের দিন সকালে স্কুলের কিছুটা দূরে বেড়িবাঁধ ভেঙে আনুলিয়া ইউনিয়নের সাতটি গ্রাম প্লাবিত হয়। বর্তমানে বিছট গাজীবাড়ি, সরদারবাড়ি ও মোড়লবাড়ির সামনের বেড়িবাঁধ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ এই তিনটি পয়েন্টে মেরামতের কাজ শুরু হলেও দীর্ঘদিন ধরে তা বন্ধ রয়েছে। ফলে এই তিনটি পয়েন্টে বাঁধের অবস্থা খুবই নাজুক।
তিনি বলেন, খরস্রোতা খোলপেটুয়া নদীতে জোয়ারের সঙ্গে একটু জোরে বাতাস হলেই এই ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ ভেঙে যাবে। বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানানোর পরও তারা এ বিষয়ে কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না। তিনি দ্রæত এই বাঁধ সংস্কারের কাজ শেষ করার দাবি জানান।
সাতক্ষীরা পাউবো বিভাগ-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দীন জানান, যে কোনো আপত্কালীন পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমাদের বিশেষ প্রস্তুতি রয়েছে। অমাদের ৭৫টি জিও টিউবের পাশাপাশি ৭৫ হাজার জিও ব্যাগ রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টেগুলো আমাদের স্পেশাল কেয়ারে আছে। এছাড়া আমরা জিও ফিল্টার ও জি পলেস্টার মজুত করে রেখেছি। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে তাৎক্ষনিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত