
জন্মভূমি ডেস্ক : এবার ঈদযাত্রায় সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৪৯ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে বেশি মোটরসাইকেল আরোহী বলে বেসরকারি সূত্রে জানা গেছে। গত এক সপ্তাহে সারাদেশে দুই শতাধিক মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। ঈদের আগে ও পরের গত এক সপ্তাহে শতাধিক মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। শুধু ঈদের দিনেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত ২১৬ জন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) চিকিৎসা নিয়েছেন বা নিচ্ছেন বলে সূত্রে জানা গেছে।
সর্বশেষ বৃহস্পতিবার রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে তিন মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া গত বুধবার ঢাকা-দিনাজপুর মহাসড়কে বাসের চাপায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়। এভাবে প্রতিদিন সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহতের খবর পাওয়া যায়। মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতি ও সরকারের অনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে দিন দিন দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। এতে দেশের যুবক সমাজ হারিয়ে যাচ্ছে। তাই এখনো মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ গণপরিবহন বিশেষজ্ঞদের।
এ বিষয়ে গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ‘আগে সড়ক দুর্ঘটনায় পথচারী মৃত্যুর সংখ্যা বেশি হতো। এখন সেখানে দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহীর নিহতের সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের চলাচলের মাধ্যম পথচারী-বান্ধব নয় ও মোটরসাইকেল-বান্ধবও নয়। মহাসড়কে গতির ঝড়ের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। মোটরসাইকেল চলাচলের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। গত পাঁচ বছর যাবত মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ছে। দুই চাকার বাহনটি দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে পড়ছে।
‘উঠতি বয়সের যুবকরা কোনো নিয়ম মানে না’ এই গতানুগতিকতার কথা বললে এখন আর হবে না। এক্ষেত্রে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। শুধু ব্যবসা বিবেচনা করলে হবে না। দেশের যুব সমাজের কথা চিন্তা করতে হবে। যেভাবে মোটরসাইকেল সহজলভ্য করা হচ্ছে। এটা ভবিষ্যতের জন্য আরও হুমকির মুখে ফেলা হবে।’ তাই এখন থেকে কঠোরভাবে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণের পরামর্শ দেন তিনি।
বেসরকারি তথ্য মতে, গত ১৯ এপ্রিল থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত গত এক সপ্তাহে ঈদযাত্রায় ১৪৯টি দুর্ঘটনার মধ্যে প্রতিদিন গড়ে ২৩টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বেশিরভাগেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বলে জানিয়েছেন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক মো. সাইদুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘মোটরসাইকেল চার চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু দেশে গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত ও সহজলভ্য না হওয়া এবং যানজটের কারণে মানুষ মোটরসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছে এবং দুর্ঘটনা বাড়ছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বৃদ্ধির পেছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, মোটরসাইকেল চালকদের বিরাট অংশ কিশোর ও যুবক। এদের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা এবং না মানার বিষয়টি প্রবল। কিশোর-যুবকরা বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হচ্ছে এবং অন্যদের আক্রান্ত করছে। মোটসাইকেল চালক সড়ক-মহাসড়কে বেপরোয়াভাবে চলাচল করছে। বেপরোয়া মোটরসাইকেলের ধাক্কায় পথচারী নিহতের ঘটনাও বাড়ছে।’
তিনি জানান, এবার ঈদযাত্রা সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ কম হলেও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার সংখ্যা বাড়ছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার একটি ব্যাপক অংশ ঘটছে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, পিকআপ ও বাসের ধাক্কা, চাপা এবং মুখোমুখি সংঘর্ষে। এসব দ্রুত গতির যানবাহনের চালকদের অধিকাংশই অদক্ষ ও অসুস্থ। তাদের বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানোর ফলে যারা সাবধানে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন তারাও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমেছে। কারণ বিগত ১৪ বছরের ধারাবাহিক উন্নয়নের ফলে দেশের সড়ক মহাসড়কের অবস্থা আগের তুলনায় অনেক ভালো ছিল। ঈদের ছুটি ঈদের আগে এক দিন বাড়ানোর কারণে মানুষ আগে থেকে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। মোটরসাইকেল পদ্মা সেতু ও দেশের সকল সড়ক মহাসড়কে অবাধে ঈদ যাত্রার সুযোগ ছিল। অতিরিক্ত গরম, বাস ভাড়া ও অন্যান্য খরচ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষের যাতায়াত কমেছে। এ ছাড়া সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো। একারণে এবারের ঈদে সড়ক দুর্ঘটনা ও হতাহতের সংখ্যা ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছেন সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘বিগত ২০১৫ সাল থেকে এবারের ঈদযাত্রা অনেকটাই স্বস্তিদায়ক হয়েছে। এর মূল কারণ ছিল ঈদের আগের তিনদিনের লম্বা ছুটি। তাই মানুষ ধাপে ধাপে ঢাকা ছেড়ে গেছেন। একসাথে যানবাহনের ওপর এত চাপ পড়েনি, যা অন্য সময় পড়ত। এ ছাড়া এবার অনেকেই গ্রামে যাননি। অন্যবারের তুলনায় কমে গেছে। পাশপাশি পদ্মা সেতু ও মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ না থাকায় অনেকেই নিজস্ব মোটরসাইকেলে গ্রামের গেছেন। তাই যানবাহনের চাপ কমে গেছে।’ তাই আগামী ঈদের আগেও ছুটি বাড়িয়ে দেওয়ার দাবি জানান তিনি।