সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর : গত বছর ২০২৪/ ২৬ মে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় রিমাল। প্রায় প্রতিবছর বাংলাদেশের উপকূলে ছোট-বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানার ঘটনা ঘটে। রিমালের স্থায়িত্বের দিক থেকে অন্যান্য ঘূর্ণিঝড় থেকে বেশ আলাদা। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবারের ঘূর্ণিঝড় রিমাল বেশি সময় ধরে তাণ্ডব চালিয়েছে বাংলাদেশের উপকূলে। রিমাল তাণ্ডব চালিয়ে চলে যাওয়ার পরও এখনো রয়ে গেছে এর ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষত।
রিমালের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় উপকূল অঞ্চলের বেড়িবাঁধ। খুলনা, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, সাতক্ষীরাসহ দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর বেড়িবাঁধ ভেঙে পানিবন্দি হয়ে পড়ে কয়েক লাখ মানুষ। খুলনা, বাগেরহাট, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনায় বাঁধ ভাঙে বেশি। খুলনা বিভাগে ৬১ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বরগুনায় ১২ কিলোমিটার, পটুয়াখালীতে ৯ কিলোমিটার এবং ভোলায় ১৩ কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া বরিশাল বিভাগে ৫০ কিলোমিটার বাঁধের ক্ষতি হয়। এর আগেও সিডর, আইলা, আম্ফানসহ অন্যান্য ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বেড়িবাঁধ ভেঙে যেতে দেখা গেছে। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাবে—এটিই হয়ে উঠেছে উপকূলের স্বাভাবিক ঘটনা। তবে টেকসই বেড়িবাঁধ তৈরি করা গেলে হয়তো কিছুদিন পরপর উপকূলের মানুষদের এমন পানিবন্দি হয়ে নানা ভোগান্তির শিকার হতে হতো না।
খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট উপকূলের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি চিংড়িচাষ। ওই জেলাগুলোর উপকূলীয় অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার একটি বৃহৎ অংশ প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে চিংড়ি চাষের ওপর নির্ভরশীল। যখন লোকালয়ে সমুদ্রের লোনা পানি প্রবেশ করে তখন এসব অঞ্চলের চিংড়ি ঘেরগুলো পানিতে ভেসে যায়। ফলে বেশ মোটা অঙ্কের লোকসানে পড়তে হয় চিংড়ি চাষের সঙ্গে সম্পৃক্তদের। এ অঞ্চলের অর্থনীতি বেশ বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার পূর্বেই দরজায় কড়া নাড়তে থাকে নতুন কোনো ঘূর্ণিঝড়। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হলেও এসব ঘের ব্যবসায়ীর জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না, যার ফলে এই ব্যবসায়ীরা অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হন এবং ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
এ ছাড়া লোকালয়ে পানি ঢুকে ভেসে যায় মানুষের ঘরবাড়ি। ফলে মাথা গোঁজার শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে হাজার হাজার মানুষ হয়ে পড়ে গৃহহীন। যদিও সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ঘূর্ণিঝড় কবলিতদের সাহায্য করা হয়, তবু এই সাহায্য যথেষ্ট নয়। এই সাহায্য প্রদান প্রক্রিয়ায় রয়েছে স্বচ্ছতার অভাব। অনেক সময় দেখা যায়, এই সাহায্য কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছায়ই না।
উপকূলের মানুষের মধ্যে বেড়িবাঁধ ভাঙা বিষয়ে একটি কথা চালু আছে। জানি না সেটা কতটুকু সত্য। তারা বিশ্বাস করেন, এ অঞ্চলের চিংড়ি চাষিরা নিজেদের ঘেরে লোনা পানি তোলার জন্য বেড়িবাঁধে ছিদ্র করে দেন। আর এ ছিদ্রগুলো ধীরে ধীরে বৃদ্ধি বাঁধগুলো ভাঙায় কাজ করে। তবে বাঁধের ভঙ্গুরতায় শুধু চিংড়ি চাষিদের দোষারোপ করা যায় না। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই যথাযথ কর্তৃপক্ষের গাফিলতিও দায়ী। কর্তৃপক্ষের উচিত যে কোনো মূল্যে এসব বাঁধ রক্ষা করা। এ ক্ষেত্রে তাদের উচিত চিংড়ি চাষিদের সচেতন করা এবং চিংড়ি চাষের জন্য প্রয়োজনীয় পানির বিকল্প ব্যবস্থা করা।
বেড়িবাঁধগুলো রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতিরও অভিযোগ রয়েছে। সবসময়ই দেখা যায় ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়ার পরপরই পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁধ সংস্কারের জন্য তোড়জোড় শুরু করে। অথচ সারাবছরই উপকূলের একটি বড় অংশ বাঁধ না থাকার কারণে অরক্ষিত থাকে। এভাবে সংস্কার করা বাঁধ টেকসই হয় না। যে কোনো সময় পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গেই বাঁধগুলো ভেঙে প্লাবিত হয়।
প্রতিবছর সরকারি বাজেটের একটি বড় অংশ বরাদ্দ করা হয় দেশের উপকূল রক্ষার জন্য। অথচ দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে বরাদ্দকৃত অর্থের বেশিরভাগই লোপাট হয়ে যায়—এমন অভিযোগ গণমাধ্যমে হরহামেশায় প্রকাশিত হয়। ফলে উপকূলবাসী পায় না তাদের বহুল কাঙ্ক্ষিত বেড়িবাঁধ। তারপর নতুন একটি ঘূর্ণিঝড় আসে, আবার প্লাবিত হয় উপকূল। এভাবেই চলতে থাকে বছরের পর বছর।
বেড়িবাঁধ তৈরির জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাৎ হওয়ার বিষয়ে উপকুলের জনগণ থেকে শুরু করে সরকারের উচ্চপর্যায় পর্যন্ত সকলেই কমবেশি অবগত থাকা স্বত্বেও কেন এটি বন্ধ হচ্ছে না, তা আমাদের অজানা। এ বিষয়ে সরকারের উচ্চপদস্থদের আন্তরিকতা কামনা করছি।
ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী সময়ে টেকসই বেড়িবাঁধ তৈরির আশ্বাস দেওয়া হলেও কিছুদিন পরই কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ভুলে যায় সে আশ্বাসের কথা। অথচ টেকসই বেড়িবাঁধ উপকূলবাসীর প্রাণের দাবি। ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য উপকূলের মানুষকে ত্রাণ বা সাহায্য প্রদান করা হয়ে থাকে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য। ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে খুবই সামান্য। এ ছাড়া এ নিয়ে এ অঞ্চলের মানুষের মনে রয়েছে অসন্তোষ। ফলে মানুষ ত্রাণ চায় না, তারা চায় টেকসই বেড়িবাঁধ। টেকসই বেড়িবাঁধ তৈরি করা হলে তারা অন্তত ঘূর্ণিঝড়ে পানিবন্দি হওয়ার ভয় থেকে মুক্তি পাবে। ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও অনেক কমে আসবে। হারাতে হবে না নিজেদের মাথা গোঁজার শেষ সম্বল।
উপকূলবাসীর প্রাণের দাবি টেকসই বেড়িবাঁধ

Leave a comment