সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : দেশেরউপকূলীয় মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্ন ভঙ্গ করছেবাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের একশ্রেণীর কর্মকর্তা কর্মচারী . । দেশের দক্ষিণাঞ্চলে উপকূলীয় একটি জনপদের ২৫ শতাংশ মানুষ মাঝারি থেকে তীব্র উদ্বেগের মধ্যে থাকে। একই এলাকার প্রায় ২৩ শতাংশ মানুষ মাঝারি থেকে তীব্র বিষণ্নতায় ভুগছে। উদ্বেগ ও বিষণ্নতার এই হার জাতীয় হারের চেয়ে অনেক বেশি।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণাটি হয়েছে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নে। এ ইউনিয়নের মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে যৌথভাবে গবেষণাটি করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ এবং নাগরিক সংগঠন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ। মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে গবেষণা ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নটি ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলাসহ প্রায় প্রতিটি দুর্যোগের শিকার। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এখানে দৃশ্যমান। গবেষণার ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, দুর্যোগে মানসিক আঘাত পাওয়ার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তাঁর নিজেরও আছে। সেই অভিজ্ঞতার কথা জনসমক্ষে প্রকাশ করতে লজ্জাবোধ করেন। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করার জন্য তিনি গবেষক দলকে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, গবেষণাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ভিত্তি তৈরি করল। আইনুন নিশাত অভিযোগ করেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অসহযোগিতার কারণে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় স্বাস্থ্যের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। তিনি জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
গবেষকেরা মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের ৬৫৩ জন নারী-পুরুষের ওপর জরিপ করেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের ছয়টি দলগত সভার মতামত নিয়েছেন তাঁরা। এ ছাড়া তাঁরা সরকারি কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা–কর্মীসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ১৫ জনের বিশেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এর ভিত্তিতে তাঁরা গবেষণা ফলাফল তৈরি করার পাশাপাশি করণীয় বিষয়ে সুপারিশ করেছেন।
অনুষ্ঠানে গবেষণা ফলাফল উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চের সমন্বয়কারী শারমিন নাহার ও একই প্রতিষ্ঠানের জনস্বাস্থ্য–বিশেষজ্ঞ মো. সাইফুল ইসলাম। দুজনই এই গবেষণার সহমুখ্য ইনভেস্টিগেটর।
গবেষণায় দেখা গেছে, এলাকার মানুষ ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া, বন্যা, নদীভাঙন, খরা, অল্প সময়ে বিপুল বৃষ্টি, বজ্রপাত, ঘন কুয়াশার মুখোমুখি হচ্ছেন। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে কৃষির ওপর। প্রভাব পড়ছে মৎস্যসম্পদ, প্রাণিসম্পদ ও স্বাস্থ্যের ওপর। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অবকাঠামো, প্রাণিসম্পদ, বন ও শিক্ষা। সুনির্দিষ্টভাবে মানুষের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, পানীয় জলের সংকট তৈরি হয়েছে, খাদ্যঘাটতি আছে, মানুষের চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সমস্যা আরও আছে। এলাকার মানুষ মনে করেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাবে পারিবারিক দ্বন্দ্ব, সামাজিক সংঘাত, এলাকায় বাল্যবিবাহ, অভিবাসন, শিশুশ্রম বেড়েছে। এসব কারণে ক্ষতি হয়েছে তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের।
এলাকার মানুষ গবেষকদের বলেছেন, মানুষের মধ্যে রুষ্ট আচরণ দেখা যাচ্ছে। তাঁরা ভয়ের মধ্যে থাকেন। তাঁদের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করে, ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না। তাঁরা দুঃস্বপ্ন দেখছেন, অনেকে বাঁচার ইচ্ছা হারিয়েছেন, অনেকের কাজের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই।
গবেষকেরা বিজ্ঞানভিত্তিক মানদণ্ডে মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি পরিমাপ করার চেষ্টা করেছেন। এতে দেখা গেছে, দেশের উপকূলের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বেশ খারাপ।
সর্বশেষ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপে (২০১৯) দেখা গেছে, দেশের প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত। এর মধ্যে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ ভোগে বিষণ্নতায়, ৪ দশমিক ৭ শতাংশের মধ্যে উদ্বেগ বেশি।
গবেষণায় দেখা গেছে, মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের প্রায় ২২ দশমিক ৩৪ শতাংশ মানুষ মাঝারি থেকে তীব্র বিষণ্নতায় ভুগছে। পাশাপাশি মাঝারি থেকে তীব্র উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে ২৫ শতাংশ মানুষ। দুটি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, এলাকার মানুষের মধ্যে বিষণ্নতা ও উদ্বেগ অনেক বেশি। এ ছাড়া এলাকার ৪৯ শতাংশ মানুষ মানসিক চাপে থাকে। ৪৪ শতাংশ মানুষের ঘুম ভালো হয় না।
অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচক জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, দীর্ঘকাল ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের মধ্যে থাকলে মানুষের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন হতে পারে, মানুষের আচরণে পরিবর্তন আসতে পারে। একটি পর্যায়ে মানুষের বিশ্বাসেও পরিবর্তন আসতে পারে। পরিবর্তন ঘটতে পারে নৃতাত্ত্বিক। এ বিষয়ে গবেষণার নতুন প্রস্তাব করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার, সুইডেন দূতাবাসের স্বাস্থ্য খাত–বিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল নোভাক এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব জেসমিন নাহার। জনস্বাস্থ্যবিদ জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে ও সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের কর্মসূচি উপদেষ্টা ইয়াসমিন এইচ আহমেদ। সমাপনী বক্তব্য দেন একই প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচি পরিচালক শেখ মাসুদুল আলম।
বাংলাদেশে সমুদ্র উপকূলের মোট দৈর্ঘ্য ৭১১ কিলোমিটার। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস, জোয়ার-ভাটাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপকূলীয় অঞ্চলে স্বাভাবিক ঘটনা। আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ক্রমাগত বেড়ে চলছে। এসব দুর্যোগের কবল থেকে উপকূলবাসীকে রক্ষা করতে বেড়িবাঁধ এবং বনায়নের মাধ্যমে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তোলার কথা অনেকবার শোনা গেছে। তবে ৩-৪ দশক আগের বেড়িবাঁধ নানা দুর্যোগে ভেঙে গেছে। আবার অসাধু ব্যক্তিরা বনায়নের গাছ কেটে চিংড়িঘের তৈরি করেছে। সব মিলিয়ে উপকূল বরাবর অরক্ষিত। ১৯৬৬ সাল থেকে আমাদের ম্যানগ্রোভ বনায়ন শুরু। দক্ষিণ এবং পূর্ব উপকূলীয় অঞ্চলকে জলোচ্ছ্বাস এবং উপকূলীয় ভাঙন থেকে রক্ষা করার জন্য ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল সংঘটিত প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর মূলত উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। কারণ হচ্ছে, বেড়িবাঁধের সম্মুখে অবস্থিত ঢাল বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে জলোচ্ছ্বাসের প্রকোপ থেকে রক্ষা এবং উপকূলবর্তী এলাকাসমূহের
কৃষিজমি ও জানমাল রক্ষা করে। উপকূলবতী এলাকাসমূহে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, প্রচলিত নিয়মে সারিবদ্ধভাবে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বৃক্ষরোপণ করেও যেখানে জলোচ্ছ্বাসের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। বরং উপকূলরেখার সম্মুখ অংশে ব্যাপক বনায়নের মাধ্যমে তা প্রতিরোধ সম্ভব হতো, কিন্তু হয়নি।
বিভিন্ন সময় প্রকাশিত সংবাদে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের উপকূলীয় বেষ্টনীর ৫০ শতাংশের বেশি সুশোভিত ঝাউবন উজাড় হওয়ার কথা গণমাধ্যমে এসেছে অনেকবার। কিন্তু অসৎ কাঠ ব্যবসায়ী, চোরাকারবারি, বনদস্যুদের নির্বিচারে গাছ কাটা, যথেচ্ছ ও অপরিকল্পিত চিংড়িঘের, লবণ চাষ এবং শিপব্রেকিং ইয়ার্ড তৈরি রোধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়নি। এমনকি বনদস্যুদের সঙ্গে নির্বিচারে বনজঙ্গল ধ্বংস তা-বে কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংশ্লিষ্ট থাকার কথা অনেকবার বলা হয়েছে। কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। যে কারণে বরগুনার প্রমত্ত বিষখালী নদী বারবার ছিনিয়ে নিয়েছে মানুষের আশ্রয়, স্বপ্ন, হাসি। সিডর ও সিডর-পরবর্তী সময়ে বিষখালীর ভাঙনে অনেকবার এলাকার মানুষ হারিয়েছেন ঘর, গাছের ছায়া, উঠানের মাটি। এমনকি স্মৃতির ঠিকানা। তবু তারা হার মানেননি, হার মানেন না। শুধু বরগুনা নয়, এমনই উপকূলবাসীর চিত্র। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর বরগুনাসহ উপকূলে আঘাত হেনেছিল প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর। গতকাল ছিল সেই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের ১৮ বছর পূর্তি। ১৮ বছর পর এসেও সেই দুঃসহ দিনের স্মৃতি মনে পড়লে আঁতকে ওঠেন উপকূলবর্তী মানুষ। কিন্তু তারা হার মানেন না। আবার জোটবদ্ধ হয়ে স্বপ্ন দেখেন, গভীর প্রত্যয়ে নতুন করে বাঁচার। দেশের জন্য এ এক নির্দয় উপহাস।
আমরা রাজনীতি করি মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা এবং চিকিৎসা নিশ্চিতের জন্য। সেখানে নিজস্ব বিত্তবৈভব নিয়ে মগ্ন থাকি। এ যেন সেই মঙ্গোলীয় শোষণ। আর ব্রিটিশের শোষণ-শাসন, পাকিস্তানিদের শোষণ-শাসন ভেঙে আমরা স্বাধীন হলাম প্রশ্ন আসে, কী পেল জনগণ? দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ বাস করে উপকূলীয় অঞ্চলে। তাদের জীবন-জীবিকা প্রাথমিকভাবে নির্ভর করে মাছ, কৃষি, বন, স্থানীয় পরিবহন, লবণ ইত্যাদির ওপর। কিন্তু জলোচ্ছ্বাস এবং ঘূর্ণিঝড় সবকিছু ল-ভ- করে দেয়। উপকূলের সংকট, সমস্যা, সম্ভাবনা এবং জলবায়ুর ঝুঁকিতে থাকা মানুষের অধিকার ও ন্যায্যতার দাবি আদায়ে তেমন কোনো দায়িত্ববোধ কোনো সরকার দেখায়নি। কেন এমনটি হয়েছে, তা অজানা। রাজনীতি মূলত কোন ধরনের মানুষের কথা বলে? চিন্তা থমকে যায় এই ভেবে আমাদের রাজনীতি শোষক না শোষিতের পক্ষে? আর উপকূলবাসী কোন পক্ষে যাবে! সরকার নিশ্চয়ই তাদের কথা ভাবে। প্রত্যাশা থাকল, অচিরেই তারা নিশ্চিত জীবনযাপন পাবেন। কান্না, দুর্ভাবনা, হতাশা আর ভাঙনের ধ্বনি কাড়বে না স্বপ্ন ও সুন্দর জীবনের পথচল।
জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে দেশের সমুদ্র উপকূলীয় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ বহুমাত্রিক সংকটে পড়ছে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য, খাদ্য, বসতি, বিশুদ্ধ পানীয় জল, যাতায়াত এবং নিরাপত্তাহীনতায় পতিত হতে হচ্ছে তাদের। দেশের সমুদ্র উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, যশোর, ভোলা, কক্সবাজার জেলার মানুষকে চরম সংকটে ফেলছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে। এর বাস্তব প্রমাণ পাওয়া গেছে সদ্য সমাপ্ত ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’ দেশের উপকূলীয় উপকূলে আঘাতে সম্পদ ও বাড়িঘর, পশুপাখি, মাছসহ তাদের মূল্যবান সম্পদের ক্ষতি। আবার এসব অঞ্চলের নদীসমূহ অতিমাত্রায় জোয়ার-ভাটার কারণে প্রতিদিন নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। এসব নদীতে সাগর থেকে জোয়ারের পানি আসে এবং ভাটায় ফিরে যায়। এ নদীগুলোর সঙ্গে পদ্মাপ্রবাহের কোনো সম্পর্ক নেই। এ কারণে সমগ্র এলাকা হচ্ছে জোয়ার-ভাটার প্লাবনভূমি।
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বিগত কয়েক বছরে জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ। সমুদ্রের অতিমাত্রায় জোয়ার -ভাটা এবং জলোচ্ছ্বাসে একদিকে নদীভাঙন অন্যদিকে সমুদ্রের পানির অতিমাত্রায় লবণাক্তায় এসব অঞ্চলে বিশুদ্ধ পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা দেয়। লবণাক্ত পানি পান করে নারী, শিশুসহ প্রায় সব বয়সি মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের লাখো মানুষের। অন্যদিকে খুলনা বাগেরহাট, সাতক্ষীরা প্লাবনভূমির নিম্নাংশে অবস্থিত জগৎখ্যাত সুন্দরবন। সুন্দরবন থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ টন গাছের পাতা এ অঞ্চলের গভীর জোয়ারের পানি নদীতে পড়ে এবং তা ধীরে ধীরে জলজ প্রাণীর খাদ্যকণায় রূপান্তরিত হয়। তাই এ অঞ্চলের জৈবিক উৎপাদনশীলতা পৃথিবীর যেকোনো এলাকার তুলনায় অনেক বেশি।
উপকূলীয় বাঁধ হওয়ার আগে জোয়ারের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ জলরাশি নদীগুলোর দুকূল ছাপিয়ে প্লাবনভূমিতে উঠে আসত এবং জোয়ারবাহিত পলি প্লাবনভূমিতে পড়ে তীব্র স্রোতে ভাটায় তা ফিরে যেত। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেমন জোয়ার-ভাটার নদীগুলোর নাব্য বজায় থাকত, তেমনি ভূমির গঠন প্রক্রিয়া সমানতালে চলত। তা ছাড়া এখানকার কৃষকরা প্লাবনভূমির চারদিকে জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে সাময়িক বাঁধ দিয়ে আমন ধান রোপণ করত এবং পৌষ মাসে বাঁধ ভেঙে প্লাবনভূমিতে জোয়ারবাহিত পলির কারণে সুযোগ করে দিয়ে ভূমি গঠন ও জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করত। ফলে নদীর নাব্য থাকত। এ কারণে এখানকার নদী, প্রকৃতি, পরিবেশ ও কৃষিব্যবস্থা এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী; দেশের অন্যান্য উপকূল থেকে তা ভিন্নতর; কিন্তু এখানকার প্রকৃতি ও প্রতিবেশকে বিবেচনায় না নিয়ে ষাটের দশকে উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্পের আওতায় এ অঞ্চলে ৩৯টি পোল্ডার নির্মাণ করা হয়, এর আওতায় ১ হাজার ৫৫৬ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ ও ২৮২টি স্লুইসগেট নির্মিত হয়। এ কারণে এই নদীগুলো স্থায়ীভাবে প্লাবনভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। যার ফলে জোয়ারবাহিত পলি প্লাবনভূমিতে পতিত হতে না পেরে নদীতে অবক্ষেপিত হচ্ছে এবং ইতোমধ্যে বহু নদী মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। অবশিষ্ট জোয়ার-ভাটার নদীগুলো পলি দ্বারা ভরাট হয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। এর ফলে বিগত শতকের আশির দশকে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা এবং ধীরে ধীরে তা হয়ে উঠেছে প্রলয়ঙ্করী ও বিধ্বংসী।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নেতিবাচক প্রভাবে উপকূলীয় মানুষের মধ্যে মানসিক অসুস্থতা দেখা দিচ্ছে। উপকূলীয় অঞ্চলে বাস করা ২২.৪৮ শতাংশ মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছে। এ ছাড়া ৪৩.৯৫ শতাংশ মানুষের ভালো ঘুম হয় না। সম্প্রতি রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়।
সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি এবং বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ, সিভিল সোসাইটি প্ল্যাটফরমের এই যৌথ গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, ‘বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জলবায়ুর প্রভাব শীর্ষক’ গবেষণায় গুরুতর দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা, মানসিক চাপ, মানসিক বৈকল্য এবং ঘুম না হওয়ার মতো জটিল স্বাস্থ্য সমস্যা উঠে এসেছে। এ ছাড়া উপকূলীয় অঞ্চলের ৪৩.৯৫ শতাংশ মানুষের ভালো ঘুম হয় না বলেও গবেষণায় উঠে এসেছে। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীরা জানান, খুলনার শ্যামনগর এলাকায় এই সমীক্ষা চালানো হয়।
বাংলাদেশ একটি নিম্নভূমি হওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এই অঞ্চল ঘূর্ণিঝড়, উপকূলীয় বন্যা এবং উপকূলীয় ক্ষয়ক্ষতির মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য খুব ঝুঁকিপূর্ণ। এই প্রেক্ষাপটে বিগত নব্বইয়ের দশকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের গবেষণা সংস্থা সিইজিআইএস একটি সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষায় নদী বাঁচানোর মাধ্যমে জলাবদ্ধতা দূর করার জন্য নদীতে অবাধ জোয়ার-ভাটার ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে। এর পর নদী অববাহিকায় বিশেষ করে খুকশিয়া বিলে এই পদ্ধতি বাস্তবায়ন করে। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে এই অববাহিকার পাঁচ-সাতটি উপজেলা জলাবদ্ধতামুক্ত থাকে; কিন্তু কৃষকদের অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিপূরণসংক্রান্ত জটিলতার কারণে দ্বন্দ্ব-সংঘাত সৃষ্টি হলে নদী রক্ষা কার্যকারণ বন্ধ হয়। ফলে হরি, শ্রী ও ভদ্রা নদীগুলো আবারও ভরাট হয়ে গেছে এবং জলাবদ্ধতার তীব্রতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
অন্যদিকে ২০১৫ সালে সাতক্ষীরা জেলার কপোতাক্ষ নদ অববাহিকার জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য পাখিমারা বিলে টিআরএম কার্যক্রম চালু হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি কপোতাক্ষ অববাহিকায় আর কোনো জলাবদ্ধতা দেখা দেয়নি। তবে বর্তমানে টিআরএম কার্যক্রম বন্ধ রাখার ফলে নদীর নাব্য দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। কিন্তু জনগণের দৃষ্টিতে তার কোনোটিই প্রকৃতি, নদী ও পরিবেশসম্মত নয় এবং সেই কারণে জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও নদীর নাব্য রক্ষায় এসব প্রকল্প সফল ভূমিকা রাখতে পারেনি। একই নদী বারবার খননের মাধ্যমে জলাবদ্ধতা দূরীকরণের চেষ্টা করা হচ্ছে; কিন্তু তা এক-দুই বছরের মধ্যে ফের পলি দ্বারা ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের জনবসতি ও সভ্যতা রক্ষার জন্য এ অঞ্চলের নদীকে বাঁচিয়ে রাখা বা নদীর নাব্য রক্ষার জন্য জোয়ারের পানিতে আসা পলি নদীর প্লাবনভূমিতে ফেলার ব্যবস্থা নিতে হবে।
গবেষণা প্রতিবেদনে সুপারিশ অনুযায়ী উপকূলের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার বিধান বাড়ানো, পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করা, কাউন্সেলিং ইউনিট স্থাপন করা এবং ন্যাশনাল আডাপ্টেশন প্ল্যান (ন্যাপ) জাতীয় স্বাস্থ্য অভিযোজন পরিকল্পনার সঙ্গে একীভূত করা। আরও সুপারিশের মধ্যে রয়েছে দুর্বল জনগোষ্ঠীর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া, নীতি এবং আইনি কাঠামোর পরিবর্তন এবং মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানকারীদের জন্য স্বাস্থ্য সুবিধা বিধানগুলো উন্নত করা। সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানসিক স্বাস্থ্যের আরও প্রভাব জানতে উপকূলের পরিবারগুলোর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা দরকার।’
সুইডেন দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি ডা. ড্যানিয়েল নোভাক জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় স্বাস্থ্যের অন্তর্ভুক্তির ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন বিপজ্জনক। সুইডেনে মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের ভবিষ্যৎ প্রভাব জেনে তাদের বাচ্চাদের হত্যা করার মতো উদাহরণও রয়েছে। খরায় জেগে উঠল ৩০০ বছরের পুরোনো শহর। কৃত্রিম হ্রদের নিচে তলিয়ে গিয়েছিল ফিলিপাইনের প্রাচীন শহর পান্তাবঙ্গন। ১৯৭০-এর দশকে কৃত্রিম হ্রদের জন্য জলাধার নির্মাণের পর ডুবে যায় শহরটির ধ্বংসাবশেষ। তীব্র খরার কারণে বাঁধের ভেতরের কিছু অংশ শুকিয়ে যাওয়ায় জেগে উঠেছে শহরের চিহ্ন পান্তাবঙ্গ।
বাংলাদেশে গত এক মাস ধরে রছে প্রচণ্ড দাবদাহ। ইতোমধ্যে এ কারণে মারা গেছে প্রায় ২৪ জন। তীব্র গরমের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটির লাখ লাখ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। মাঝেমধ্যে বন্ধ থাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অফিসের কার্যক্রমও বাড়ি থেকে করার সুপারিশ করা হয়েছে। আগামী দিনগুলোতেও তাপমাত্রা বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত থাকতে পারে বলে ফিলিপাইনের আবহাওয়া দপ্তরের বিশেষজ্ঞ বেনিসন এস্তারেজা বলেছেন। তিনি বলেছেন ‘ফিলিপাইনে জলবায়ু পরিবর্তনের সাধারণ প্রভাব হলো উষ্ণ তাপমাত্রা। আমরা যে তাপ অনুভব করছি, তা আগামী দিনে ক্রমাগত বাড়তে পারে।’ ফিলিপাইনে এখন উষ্ণ ও শুষ্ক ঋতুর মাঝামাঝি সময়। বিশেষ আবহাওয়া পরিস্থিতি ‘এলনিনো’র (প্রশান্ত মহাসাগরের সাগরপৃষ্ঠের পানির অস্বাভাবিক উষ্ণতা) প্রভাবে দেশটিতে গরমের তীব্রতা আরও বেড়েছে। এমনি অবস্থায় বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় মানুষকে রক্ষায় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
প্রধান সম্পাদক: লে. কমান্ডার (অব.) রাশেদ ইকবাল, প্রকাশক আসিফ কবীর কর্তৃক জন্মভূমি প্রকাশনী লি: ১১০/২,সাংবাদিক হুমায়ুন কবীর বালু সড়ক, খুলনা থেকে মূদ্রিত ও প্রকাশিত