মোজাফ্ফর রহমান, সাতক্ষীরা : বাংলাদেশে যে কয়টি এলাকা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত তার মধ্যে অন্যতম দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা।
বঙ্গোপসাগরের তীরে সুন্দরবন লাগোয়া সাতক্ষীরার শ্যামগনগর ও আশাশুনি উপজেলার বড় একটি অংশ লবনাক্ত আক্রান্ত। লবনাক্ততার বিভীষিকা জনজীবনে কতটা প্রভাব ফেলেছে তা বুঝা যায় উপকূলীয় এই দুই উপজেলার জনপদের মানুষকে দেখলে।
ইদানিং এখানকার গ্রামের মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারে, মহিলাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়েছে কয়েকগুন।
লবনাক্ততার মাঝে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা পরিবারে নারীদের দুর্ভোগের শেষ নেই।
সুন্দরবন লাগোয়া সাতক্ষীরা শ্যামনগর এলাকায় লবনাক্ততা এতটাই প্রকট যে, স্বাদু পানির অভাব থাকে ৬মাসের বেশি। রান্না-বান্না, গোসল, ধোয়া-মোছা, সব কিছুতেই লবন পানি! এর প্রভাবে পুরুষের তুলনায় বিভিন্ন রোগ-বালাইতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে মহিলা ও কিশোরীরা। উপার্জন কাজের সুবাদে বছরের উল্লেখযোগ্য সময় এলাকার বাইরে থাকেন উপকূলীয় দরিদ্র পরিবারের পুরুষরা।
তবে মহিলাদের সে সুযোগ নেই।
বরং মাছ ধরা, চিংড়ি পোনা আহরণ এবং অন্যান্য কাজে মহিলাদেরকে লবন পানির সাথে থাকতে হচ্ছে দিনের উল্লেখযোগ্য সময়।
সরেজমিনে দেখা যায়, দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় উপকূলের লবনাক্ত অঞ্চলে প্রতিবন্ধি ও বিকলাঙ্গ শিশুর জন্মহার বেশি। কিশোরী বয়স থেকে ‘জেনিটাল অর্গান’ আক্রান্ত হচ্ছে লবনাক্ততার প্রভাবে। সন্তান জন্মদানে স্বক্ষমতা হ্রাস, ব্রেস্ট ক্যান্সার, জরায়ু ক্যান্সার বা জরায়ুতে বিভিন্ন উপসর্গের অন্যতম কারণ লবনাক্ততা। বলা যায় একটা বিভীষিকা জীবন পার করছেন দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে লবনাক্ত উপকূলের নারীরা। গেল ১০/১৫ বছর ধরে চলছে এমন অবস্থা।
এ অঞ্চলে স্বাস্থ্য সেবা খুবই অপ্রতুল। তবে উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের, বিশেষ করে মহিলা ও শিশুদের স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে গুরুত্ব দিয়ে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে সাতক্ষীরার উপকুলীয় উপজেলা শ্যামনগরের ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল।
হাসপাতালটির পরিচালক অবঃ লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ডাঃ মুজাহিদুল হক জানান, সাতক্ষীরা শ্যামনগরে প্রতিষ্ঠিত রিবা (জওইঅ) এ্যাওয়ার্ড বিজয়ী ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে ২০১৮ সাল থেকে শুরু হয় সার্ভিক্যাল ক্যান্সার স্ক্রিনিং টেস্ট। যা এ অঞ্চলে নারীদের জন্য ছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
এখন শুধু ক্যান্সার নয়, লবনাক্ত অঞ্চলে মহিলা ও কিশোরীদের বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল। ডাঃ মুজাহিদুল হক আরও জানান, কেবলমাত্র মহিলা ও কিশোরীদের জন্য বিশেষ সেবা নয়, চর্ম, চোখের ছানিসহ লবনাক্ত উপকূলবাসীর চাহিদা মতো স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে যাচ্ছে এই ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল।
শ্যামনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডাঃ জিয়াউর রহমান জানান, বাংলাদেশে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে সার্ভিক্যাল ক্যান্সার স্ক্রিনিং টেস্ট ও চিকিৎসা সেবা থাকলেও লবনাক্ত অঞ্চলে এর গুরুত্ব বেশি।
কেবল শ্যামনগর স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই প্রতিমাসে সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের চিকিৎসা নিচ্ছেন প্রায় ১০০ জন রোগি। পাশাপাশি ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালও দিয়ে যাচ্ছে মহিলাদের বিশেষ সেবা। এভাবে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত উদ্যোগ অব্যাহত থাকলে ভালভাবেই মোকাবিলা সম্ভব সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের মত নীরব ঘাতক।