
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : খুলনার কয়রা উপজেলার কাঠমারচর গ্রামটি বরাবরই দারিদ্র্যপীড়িত এলাকা হিসেবে পরিচিত। এ গ্রামের দিনমজুর আবদুল ওহাব তরফদারের মেয়ে শরীফা খাতুনের যখন বিয়ে হয়, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। ওই অবস্থায় শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে জানতে পারেন, স্বামী মাহাবুবুর রহমানের আরেকটি বউ আছে। তারপরও সাংসারিক চাপ সামলে ধৈর্য ধরে স্বামীর সঙ্গেই ছিলেন কিশোরী শরীফা। এক বছর পরেই মা হন শরীফা। এভাবে অল্প বয়সেই তিন সন্তানের মা হন তিনি। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় স্বামী মারা যাওয়ায় শ্বশুরবাড়ি ছাড়তে হয় তাঁকে।
শরীফা যখন কাঠমারচর গ্রামের বাবার বাড়িতে এসে আশ্রয় নেন, তখন ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ছোবলে লন্ডভন্ড এলাকা। এ অবস্থায় গ্রামের লোকজনের সঙ্গে বাঁধের ওপর আশ্রয় হয় তাঁর। একসময় দুর্যোগ কেটে যায়। তবে নতুন দুর্যোগ নেমে আসে শরীফার জীবনে। বাবার সংসারেও তাঁকে নিয়ে বিরোধ তৈরি হয়। ভাই-ভাবিদের চাপে আলাদা হতে হয় তাঁকে। বর্তমানে ছোট্ট এক ঘরে তিন সন্তান নিয়ে আলাদা বসবাস করেন শরীফা। নিজে নদীতে জাল টেনে, কখনো অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে, কখনো চিংড়ির ঘেরে মজুরের কাজ করে সন্তানদের পড়ালেখার পাশাপাশি খাবার জুগিয়ে চলেছেন এই নারী।
উপকূলে শরীফা খাতুনের মতো নারীদের ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনে দুর্যোগ-দুর্বিপাকে স্বামীর অনুপস্থিতিতে সংসারে নারীরাই হয়ে ওঠেন পরিবারের প্রধান।
তেমনই একজন কয়রার কাটাকাটি এলাকার মজিদা খাতুন। শাকবাড়িয়া নদীর ওপারের বাঁকের দিকে আঙুল উঁচিয়ে মজিদা খাতুন দেখাচ্ছিলেন কয়েক বছর আগে সেখানেই ছিল তাঁর বসতভিটা। ছিল গোলপাতার ঘর। সামনে ছিল একটুকরা উঠান। সারা দিনের কর্মক্লান্তি শেষে সে ঘরেই সুখের নিদ্রায় যেতেন স্বামী-সন্তানদের নিয়ে। আজ সেখানে কেওড়া, বাইন, গরানের বন। আর পরিবার নিয়ে মজিদা খাতুনের ঠাঁই হয়েছে বাঁধের ঢালে দুটি খুপরিঘরে।
মজিদা খাতুন বলেন, ‘আমরা যেমনে থাকি গেরস্থদের হাঁস-মুরগিও এর চাইতে ভালো থাকে। গাঙে বেশি জোয়ার হলি ঘরের কোনায় পানি আসে। তখন ছোট ছাওয়াল-মাইয়েগুলো ভয় পায়।’
একটু দূরে হারেজখালি ক্লোজারের পাশে বাঁধের ঢালে দোচালা খুপরিঘরে মেয়ে ও তিন নাতি নিয়ে বাস করছেন জরিনা বেগম। দুই বছর ধরে সেখানেই আছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আম্পানে বাঁধের যে অংশ ভেঙে যায়, সেখানেই ছিল তাঁর এক বিঘার বসতভিটা। সে ভিটা এখন রিংবাঁধের তলায়। ভিটার সঙ্গে স্বামী মজিদ শেখের কবরটাও চাপা পড়েছে।
প্রতিবছর ভাঙনের ফলে গ্রামের নদীর তীরবর্তী অংশ বিলীন হচ্ছে। আর এভাবে বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে মজিদা খাতুন ও জরিনা বেগমের মতো নারীপ্রধান পরিবারগুলো। তাঁদের ঘর বাঁধার জায়গাটুকুও নেই। এসব পরিবারের সর্বশেষ আশ্রয় হয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধের ঢালে। সেখানে নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে আছে আরও অজানা শঙ্কা। তবু উপায় নেই এসব বাস্তুহারা মানুষের। সব ভয়ডর সয়ে বছরের পর বছর মাথা গুঁজে পড়ে আছেন তাঁরা। অভিযোগ জানানোরও জায়গা নেই যেন।
কয়রার গাতিরঘেরী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, চলতি বোরো আবাদ মৌসুমে পুরুষদের পাশাপাশি কৃষিকাজে নারী শ্রমিকেরাও শ্রম দিচ্ছেন। কিন্তু একই কাজে পুরুষের মজুরি যেখানে ৪০০ টাকা, সেখানে নারী শ্রমিকের মজুরি অর্ধেক দেওয়া হয়। এমন মজুরিবৈষম্য সর্বক্ষেত্রে বলে অভিযোগ করেন শ্রমজীবী নারীরা।
খুলনার কয়রা উপজেলার বড়বাড়ি এলাকায় একটি বোরো খেতে কাজ করছেন কয়েকজন নারী শ্রমিক
বোরো খেতের আগাছা পরিষ্কার করতে করতে তানজিলা খাতুন নামের এক নারী বলেন, ‘সকাল সাতটা থেকে একটানা জমির আগাছা বাইছে ১৫০ টাকা করে পাই। আবার এক-আধ ঘণ্টা দেরি করলি টাকা কম দেয়। কী করব এলাকায় কাজের অভাব, আয়-রোজগারের পথ নাই। প্যাটের দায়ে করতি হয়।’
বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে অনেকটা বিধ্বস্ত এলাকায় তেমন কোনো কাজ না থাকায় সংসারের খরচ জোগাতে কম পারিশ্রমিকে হাড়ভাঙা খাটুনি করতে হচ্ছে উপকূলের নারীদের। অথচ সে তুলনায় পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না তাঁরা।
বড়বাড়ি গ্রামের সাধনা রানী বলেন, ‘পুরুষ কিষানেরা সারাবেলায় যেটুকু কাজ করতি পারে, আমরাও তা–ই পারি। হয়তো একটু উনিশ-বিশ হতি পারে।’ একই গ্রামের কল্পনা মণ্ডল বলেন, ‘মজুরির কথা বলতি গেলি কাজে আসতি মানা করে জমিমালিকেরা। উপায়ান্তর না দেইখে মুখ বুজে কাজ করি। কী করব, প্যাটের ভাত তো জোগাতি হবে।’
সুন্দরবন–সংলগ্ন ৬ নম্বর কয়রা গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানকার নারীরা ছোট নৌকায় করে সুন্দরবন থেকে লোকালয়ে ফিরছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ খালি হাতে ফিরছেন। তাঁরা জানান, সুন্দরবনে প্রবেশে তাঁদের বন বিভাগের অনুমতিপত্র নেই। তবু পেটের তাগিদে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে গিয়েছিলেন কাঁকড়া শিকারে। কিন্তু বন বিভাগের লোকজন তাঁদের ফিরিয়ে দিয়েছেন।
কাটকাটা এলাকায় বেড়িবাঁধের ওপর ঝুপড়িঘরে বসবাস মজিদা খাতুনের
গ্রামের বাসন্তী রানী বলেন, ‘এলাকায় এখন কাজ নেই বললেই চলে। বাড়ির পাশে সুন্দরবন আছে বলে সেখান থেকে কম বেশি আয়–রোজগারে কোনো রকমে খেয়েপরে বাঁচি আছি। না হলি কী যে হতো, ভগবানই জানেন।’
দেখা গেছে, ৬ নম্বর কয়রা গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ নদীর পানিতে গোসল ও ঘরগৃহস্থালির কাজ সারছেন। সেখানে বাঁধের পাশে রয়েছে সারি সারি ঝুলন্ত টয়লেট। আশপাশের জমিতে লোনা পানির চিংড়ির ঘের থাকায় পুকুরের পানিও লবণাক্ত। এ ছাড়া গ্রামের দু-তিন কিলোমিটারের কোথাও নলকূপ নেই। গ্রামের বাসিন্দারা জানান, পানি সংগ্রহ করার দায়িত্ব নারীদের। খাবার পানির জন্য বাড়ির নারীরা প্রতিদিন বিকেলে দূরের মিঠা পানির পুকুর থেকে কলসি ভরে পানি আনেন। তাঁদের কথায়, এতে খাবার পানির সমস্যা এক রকম মিটলেও দূষিত পানি ব্যবহারে চর্মরোগের প্রকোপ রয়েছে সেখানে। এ ছাড়া জ্বালানির জন্য কাঠ সংগ্রহ করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনের ভেতরে যেতে হয় নারীদের।
৬ নম্বর কয়রা গ্রামের গৃহিণী পুষ্প মুন্ডা বলেন, ‘পানির কারণে নানা সমস্যায় ভুগতি হয় আমাগের নারীদের। বাচ্চাদেরও অসুবিধা হয়।’ সাধারণত এসব অসুখবিসুখে পাশের দোকান থেকেই বড়ি কিনে খান তাঁরা। কারণ, ওই গ্রামসহ আশপাশের অন্তত ১০ গ্রামের কোথাও চিকিৎসক বা চিকিৎসাকেন্দ্র নেই।
কয়রার সুন্দরবনসংলগ্ন কয়েকটি গ্রামে ঘুরে দেখা গেছে, নদীতে অনেক নারী পিঠে দড়ি বেঁধে জাল টানছেন। সুন্দরবনের গহিনের নদী থেকে উজানে ভেসে আসা বাগদার পোনা ধরার জন্য অসংখ্য নারী জাল পেতে রেখেছেন নদীতে। লোকালয়ের কাছে ছোট–বড় নদীতে কেউ টানা জালের সাহায্যে, কেউ নৌকায় বসে জাল পেতে মাঝনদীতে অপেক্ষা করছেন। রেণু আহরণের জন্য সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করেন তাঁরা।
৬ নম্বর কয়রা এলাকার বাবুর পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করছেন নারীরা
কয়রা গ্রামের স্বাস্থ্যকর্মী ফরিদা খাতুন জানান, প্রতিদিন এখানের নারীরা চিংড়িপোনা ধরার জন্য সাত-আট ঘণ্টা নদীর লবণাক্ত পানিতে থাকেন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততাও বেড়েছে এ অঞ্চলে। আর মাত্রাতিরিক্ত এসব নোনাপানি নিয়মিত ব্যবহারের কারণে জরায়ুসংক্রান্ত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এখানকার নারীরা।
কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মেডিকেল অফিসার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘বছরজুড়ে চিকিৎসা নিতে আসা উপকূলের নারীদের অধিকাংশের সমস্যা জরায়ু, ডিম্বনালি ও অন্যান্য প্রজনন অঙ্গের। এর অন্যতম কারণ মাটি ও পানিতে সহনশীল মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি লবণ। লবণাক্ততার সঙ্গে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস, সচেতনতার অভাব এবং অপুষ্টি এই সংক্রমণের অন্যতম কারণ।’

