
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : বাংলাদেশের উপকূলীয় ১৯টি জেলার প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ প্রতিনিয়ত ঘূর্ণিঝড়ের আতংকে দিন কাটাচ্ছে।
ষাটের দশকে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের ৩০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে পাকিস্তান সরকার। ষাট বছরে ভাঙতে ভাঙতে যার অস্তিত্ব এখন আর নেই বললেই চলে। বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে লবণপানি প্রবেশ করায় একসময়ের সবুজ শ্যামল জনপদ গাবুরায় কৃষি উৎপাদন নেমে এসেছে শূন্যের কোটায়। একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত আর নদীর ভাঙ্গন এ দ্বীপকে এতটাই ভঙ্গুর করে দিয়েছে যে, এখানে এখন আর বড় ঘূর্ণিঝড়ের প্রয়োজন হয় না। অমাবস্যার জোয়ারে পানির চাপ একটু বাড়লে মানুষের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জি এম মাছুদুল আলম এই প্রতিবেদক কে বলেন, ’গাবুরার দক্ষিণ–পশ্চিমে খেলপেটুয়া নদী, উত্তর–দক্ষিণে কপোতাক্ষ নদ। প্রায় ৫০ বর্গ কিলোমিটারের গাবুয়া এখন কাগজে-কলমে ৩৩ বর্গ কিলোমিটার; আমাদের ছোটবেলায় দেখা অনেক জনপদ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে গত ৫০ বছরে। দ্রুত বাঁধ সংস্কার না হলে দেশের মানচিত্র থেকেই হারিয়ে যেতে পারে দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা।’
এ সমস্যা শুধু গাবুয়ার নয়। ষাটের দশকে দেশের ১৩ জেলায় ৫ হাজার ৮১০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকার ১৩৯টি পোল্ডার (বেড়িবাঁধ) নির্মাণ করা হয়েছিলো। শুনতে আশ্চর্য শোনালেও সত্যিটা হলো, স্বাধীনতার ৫০ বছরে উপকূল সুরক্ষায় নতুন একটি পোল্ডারও তৈরী করতে পারেনি বাংলাদেশ। পাকিস্তান আমলে তৈরী বেড়িবাঁধ সংস্কার আর পুনঃনির্মাণেই কেটে গেছে ৫০টি বছর! অর্ধশত বছরেরও আগে নির্মিত এসব বাঁধ এখন আর সামাল দিতে পারছে না সামুদ্রিক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কা। ৭১০ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূল রেখার প্রায় ১৫ হাজার কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকা এখনো অরক্ষিত।
ভারতের ট্রপিক্যাল মেটেরোলজি ইনস্টিটিউটের জলবায়ু বিজ্ঞানী ড. রক্সি ম্যাথিও কল-এর তথ্যমতে, বিশ্বের ভয়াবহতম ১০ ঘূর্ণিঝড়ের ৮টিই সৃষ্টি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বিশ্বে যত মৃত্যু ঘটেছে, তার ৮০ শতাংশই হয়েছে এই অঞ্চলে। এ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির প্রবণতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় ১৯ জেলার প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ চরম ঝুঁকিতে রয়েছেন।
উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প (সিইআইপি-১) এর প্রকল্প পরিচালক ও পাউবোর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ‘দেশে বর্তমানে পোল্ডারের সংখ্যা ১৩৯, যা ষাটের দশকে তৈরী করা হয়েছিলো। এর মধ্যে ৬০টি বেড়িবাঁধ এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। বিভিন্ন কারণে আমরা এসব সংস্কার করতে পারিনি। বাকিগুলো পাউবো বিভিন্ন সময় সংস্কার ও পুনঃনির্মাণ করেছে। তবে নতুন করে কোন বাঁধ তৈরী করা হয়নি।’
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭০ ও ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়সহ একের পর এক ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে দেশের বাঁধের বেশিরভাগ অংশ নাজুক হয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র সুপার সাইক্লোন সিডরে উপকূলীয় ৩০ জেলার ২ হাজার ৩৪১ কিলোমিটার বাঁধ বিধ্বস্ত হয়। এর মধ্যে সম্পূর্ণ বিলীন হয় ৩৯১ কিলোমিটার। ১ হাজার ৯৫০ কিলোমিটার বাঁধ আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার ৩৮টি পোল্ডারের ১৬৫১ কিলোমিটার বেঁড়িবাধের মধ্যে ৬৮৪ কিলোমিটার বিধ্বস্ত হয়। ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে উপকূলীয় ১০ জেলার ৪৭৮ কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙে বিলীন হয়ে যায়। আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৬৭৮ কিলোমিটার।
সাতক্ষীরা জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো, আশরাফুল আলম ’উপকূলীয়বাঁধগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। ষাট বছর আগের বাঁধ যে এখনো সার্ভিস দিচ্ছে সেটাই অনেক বেশি। এছাড়া যে সময় বাঁধগুলো নির্মাণ করা হয়েছিলো, সে সময় শুধুমাত্র জোয়ার থেকে জনবসতিকে রক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিলো। কিন্তু বর্তমানে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়ের চাপ বাঁধগুলো আর নিতে পারছেনা।’
চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে সাড়ে ছয় বছর আগে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। কিন্তু প্রকল্প শেষের আগেই সেই বাঁধে দেখা দিয়েছে ভাঙন। স্থানীয়দের অভিযোগ, বেড়িবাঁধ সংস্কারের নামে লুটপাটের কারণেই স্বপ্নের বেড়িবাঁধের এই পরিণতি।
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস আঘাত হেনেছিল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের উপকূলীয় অঞ্চলে। এতে প্রাণ হারিয়েছিলো প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার লোক। ভঙ্গুর বেড়িবাঁধের কারণে এত লোকের প্রাণহানি হয়েছিল বলে মনে করেন সংশ্নিষ্টরা। সর্বশেষ ২০২১ সালে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে বঙ্গোপসাগরের লোনা পানিতে প্লাবিত হয় চট্টগ্রামের উপকূলীয় উপজেলা বাঁশখালীর ৯ ইউনিয়ন।
বাঁশখালীর খানখানাবাদ ইউনিয়নের বাসিন্দা মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ’৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের পর পাঁচবার ভিটে সাগরে বিলীন হয়েছে। অনেক কষ্টে একটা ঘর করেছি। এখন আবারও বেড়িবাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। মূলত সংস্কারের নামে নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে কাজ করে রাজনৈতিক নেতা, ঠিকাদার ও পাউবোর কর্মকর্তারা সরকারি টাকা লুটপাট করেছেন।’
জানতে চাইলে বর্তমান সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম এই প্রতিবাদকে জানান, ‘আগে কম খরচের নকশা করা হতোকারণে অনেক সময় কাজ টেকসই হয় না।’
খুলনার দাকোপ উপজেলার ৩২ নম্বর পোল্ডারের ৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সংস্কার ও দুই কিলোমিটার নদীশাসনের কাজ আগামী জুনে শেষ হওয়ার কথা। এই প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। এখন একই বাঁধ সংস্কারে প্রায় ১৫২ কোটি টাকার একটি প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে পাউবোর পক্ষ থেকে।
জানতে চাইলে খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, ‘বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পটি ২০১৩ সালের দিকে সার্ভে হয়েছে। তখন দুই কিলোমিটার নদীশাসনের কথা বলা হয়েছে, যা এরই মধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে, কিন্তু এই সময়ের মধ্যে নদীর গতি-প্রকৃতির পরিবর্তন হয়েছে। ফলে আরো ছয় কিলোমিটার জায়গা নদীশাসনে আনা প্রয়োজন। এ বিষয়ে প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এতে প্রায় ১৫২ কোটি টাকা ব্যয় হবে।’
সাতক্ষীরা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ মো সাইফুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সাতক্ষীরায় একসময় বিশ থেকে পঁচিশ জাতের ধানের আবাদ হতো। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দফায় দফায় ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে জমিতে লবণপানি ঢুকে জমি উর্বরতা হারায়। প্রতিষ্ঠিত কৃষকরাও বাঁধ কেটে জমিতে লবণপানি প্রবেশ করিয়ে মাছচাষ শুরু করে। ফলে একদিকে জমি নষ্ট হয়েছে, অন্যদিকে বিনাশ করা হয়েছে বাঁধ।’
গাবুরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জি এম মাছুদুল আলম বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, আম্পান ও ইয়াসের গাবুরার কপোতাক্ষ নদের ২৭ কিলোমিটার বাঁধের মধ্যে ২১ কিলোমিটারই ধসে গেছে। কিন্তু সরকারিভাবে বাঁধ সংস্কারের কাজ এখনো শুরু হয়নি। তাই স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে কোনো রকম বাঁধ টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।’
সাতক্ষীরা জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল খায়ের বলেন, ‘গবেষণায় দেখা গেছে প্রতি বর্ষা মৌসুমে বাঁধের ৩ শতাংশ টপ সয়েল ধুয়ে যায়। সে হিসেবে বছরে ৩৮ কিলোমিটার বাঁধ বিলীন হয়ে যাবার কথা। এছাড়া নতুন করে কোনো বাঁধ আমরা নির্মাণও করতে পারিনি। এখনো যেসব বাঁধ টিকে আছে পানি উন্নয়ন বোর্ড সংস্কার করে বলেই তা টিকে আছে। এছাড়া অনেক সময় প্রকল্প পাশ হয়ে তা বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে জনগণকে ভুগতে হয়।’
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পানিসম্পদ কৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সামিউন বাসিরের মতে- দুটি কারণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ টেকসই হয় না। প্রথমত, নিম্নমানের কাজ। দ্বিতীয়ত- নকশায় ত্রুটি।
তিনি বলেন, ‘পাউবোর উচিত বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে টেকসই বাঁধ নির্মাণে কার্যকর নকশা করা ও দুর্নীতি খতিয়ে দেখা।
উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প (সিইআইপি-১) এর প্রকল্প পরিচালক ও পাউবোর সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম জানান, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের সাগর উপকূল রক্ষায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে তিন হাজার ২৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘কোস্টাল ইমব্যাংকমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (সিইআইপি-১)’ নামের মেগাপ্রকল্পের কাজ চলছে। সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, বরগুনা, পটুয়াখালী ও পিরোজপুর জেলার ঝুঁকিপূর্ণ ১০টি পোল্ডার নিয়ে কাজ হচ্ছে এই প্রকল্পের। ৫০ বছরের স্থায়িত্ব ধরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০১৩ সালে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হলেও কাজ শুরু হয় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে। বর্তমানে এই প্রকল্পের ৭২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
সাবেক প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, ‘সিইআইপি-২ প্রকল্পের আওতায় আরও ২০টি বাঁধ সংস্কার করা হবে। বাকিগুলোর জন্য আলাদা আলাদা প্রকল্প নেওয়া হবে। আগামীতে পোল্ডারের সংখ্যা বাড়বে। প্রস্তাবনা দিয়েছি, আরও ৮টি পোল্ডার নামকরণের জন্য পাউবোর একটি কমিটি কাজ করছে।’
জীবন। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা আর আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটায় উপকূলীয় এলাকার মানুষ। বেড়িবাঁধের বেশিরভাগ অংশই ঝুঁকিতে থাকায়, গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে দুশ্চিন্তায় উপকূলবাসী। ফসলি জমি ও জানমাল রক্ষায় ষাটের দশকে নির্মিত এসব বাঁধ কখনই পুরোপুরি মেরামত করা হয়নি। ফলে প্রতিবছরই ভারী বৃষ্টিতে নড়বড়ে বাঁধ ভেঙে ডুবে যায় উপকূলীয় এলাকা। নদ-নদীতে জোয়ারের পানির উচ্চচাপের কারণে উদ্বেগ ছড়াচ্ছে। নড়বড়ে বেড়িবাঁধে প্রায়ই কোথাও না কোথাও ভাঙন সৃষ্টি হচ্ছে। বাঁধ ভেঙে বিস্তির্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। পানিতে ভেসে যায় ফসলি জমি, পুকুর ও মাছের ঘের। সিডর, আইলা, আম্ফানসহ নানা দুর্যোগে বারবার ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে খুলনাসহ উপকূলের বেড়িবাঁধ।
জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের সুরক্ষা নির্বাহ করে বেড়িবাঁধের ওপরে। বাঁধ ভালো থাকলে তারা দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাবে। আর বাঁধ ভেঙে গেলে তাদের ঘরবাড়ি, ফসলের ক্ষেত, রাস্তাসহ সবকিছু পানিতে ভেসে যায়। নিঃস্ব হয়ে পড়ে মানুষ।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সিডর, আইলা, ফনী, আম্ফান ও ইয়াসের মত ঘূর্ণিঝড়ের জলোচ্ছ্বাসে বিপর্যস্ত উপকূলবাসী। দুর্যোগপূর্ণ পরিবেশে বেড়িবাঁধই উপকূলের একমাত্র রক্ষাকবচ। অথচ ষাটের দশকে নির্মিত বেড়িবাঁধ জোড়াতালি দিয়ে এতদিন চলে আসলেও বর্তমান পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক। শক্তিশালী বেড়িবাঁধের অভাবে ভাঙ্গন অব্যাহত থাকে সব মৌসুমেই, বর্ষায় পরিস্থিতি প্রকট আকার ধারণ করে। আগের বছর গুলোর তুলনায় সমুদ্রের উচ্চতা বেড়েছে। মৌসুমি বর্ষায়, এমনকি জোয়ার ভাটায়ও নিয়মিত প্লাবিত হচ্ছে।
উপকূলীয় বাসিন্দাদের বেশিরভাগই দরিদ্র এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মানবসৃষ্ট বিপদ উভয়েরই সংস্পর্শে রয়েছে। দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর মধ্যে খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুর, বরগুনা ও বরিশালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা আর আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার মানুষ। বেড়িবাঁধের বেশিরভাগ অংশই ঝুঁকিতে থাকায়, গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে দুশ্চিন্তায় থাকে উপকূলবাসী। ফসলি জমি ও জানমাল রক্ষায় ষাটের দশকে নির্মিত এসব বাঁধ কখনই পুরোপুরি মেরামত করা হয়নি।
সরকারের হিসাবে দেশে ১৯ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর প্রায় অর্ধেকই উপকূলীয় এলাকায়। উপকূলীয় ৮ জেলাতে মোট বাঁধের আয়তন ৫ হাজার ৮০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় মোট দুই হাজার ৬ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। খুলনা জেলায় ৯৯৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়। লবণাক্ত পানি ফসলি জমিতে চলে আসার পর টানা কয়েক বছর ফসল হয় না। সিডর, আইলা, আম্ফানসহ নানা দুর্যোগে বারবার ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে খুলনা উপকূলের প্রায় পৌনে ৯শত কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। ফলে প্রতিবছরই ভারী বৃষ্টিতে নড়বড়ে বাঁধ ভেঙে ডুবে যায় কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়া উপজেলার কয়েকটি স্থান। বাঁধ ভাঙলে তা সংস্কার না করে শুধুমাত্র ভাঙা জায়গা মেরামত করা হয়। শুধু খুলনার দাকোপ, পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলার ২১টি পয়েন্ট এবং সাতক্ষীরার শ্যামনগর ও আশাশুনির ২৯টি পয়েন্টে নতুন ভাঙন দেখা দিয়েছে। এসব এলাকায় নদী পাড়ের বাসিন্দাদের মধ্যে বাড়ছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা।
উপকূলীয় এলাকায় অনেক জায়গায় বাঁধের চেয়ে জোয়ারের উচ্চতা বেশি থাকায় বসতি ও কৃষিজমিতে পানি প্রবেশ করেছে। ঘূর্ণিঝড়ের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়ে দেখা দিয়েছে স্থানীয় দ্বন্দ্বের কারণে বেড়িবাঁধের ভাঙা অংশ দ্রুত মেরামত না হওয়া। বেশির ভাগ জায়গায় ঠিকাদারদের গাফিলতি ও দুর্নীতির কারণে বাঁধ দুর্বল ছিল। অনেক জায়গায় ঠিকমতো মেরামত হয়নি। ফলে বাঁধ ভেঙেছে, আবারও ভাঙতে পারে। ফলে জোয়ার–ভাটার পানি বেড়িবাঁধগুলো ভাঙা অংশ দিয়ে প্রবেশ করছে। এতে বাঁধের ফাটা অংশ আরও বড় হচ্ছে। সময় যত যাবে, বাঁধের ফাটল আরও বড় হলে মেরামতের খরচও বাড়বে।
দেশের বেড়িবাঁধের বর্তমান ডিজাইন ষাটের দশকের। তখনকার তুলনায় বর্তমানে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস আরও ক্ষীপ্রগতিতে আঘাত হানছে। প্রকৃতির গতিপ্রকৃতির পরিবর্তন হলেও বেড়িবাঁধের ডিজাইন আধুনিকায়ন হয়নি। আনা হয়নি কোনো ধরনের পরিবর্তন। ফলে একটু বেশি জোয়ার হলেই বাঁধ ভেঙে স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে। মেরামত সংস্কারে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ কোন কাজে আসেনি বরং প্রকল্পের টাকা নয়ছয়ের ঘটনা ঘটেছে, হয়েছে অর্থের অপচয়। নতুন বাঁধ নির্মাণেও অর্থ লুটপাট হয় দুর্নীতির মাধ্যমে, তারপর কোনক্রমে তৈরি করে দুর্বল বাঁধ। ফলে জলোচ্ছ্বাসের সময় পানির চাপে নাজুক বাঁধ ভেঙে যায়।
সময়ের পরিক্রমায় উপকূলের সুরক্ষা বাঁধগুলো দুর্বল এবং নিচু হয়ে গেছে। ইঁদুরের গর্তেও বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেড়িবাঁধের ঢালুতে ছিন্নমূল মানুষ ঘর তৈরি করে বসবাস করে। অনেকে বেড়িবাঁধের ওপর নানা ধরনের গাছ, শাকসবজি আবাদ করে। এসব দেখভালে উপজেলা পর্যায়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেখভালের জন্য নেই তেমন কোনো জনবল।
সংশ্লিষ্টদের মতে, আগে বেড়িবাঁধে ৬ মাস সময় নিয়ে মাটি ভরাট করা হতো। বিশেষ করে ডিসেম্বরে মাটি ভরাট শুরু হতো, শেষ হতো জুনে। প্রায় ৬ মাস মাটি ভরাটের ফলে মাটি স্বাভাবিক নিয়মে ভালোভাবে বসে শক্ত বাঁধ তৈরি হতো। এখন বেড়িবাঁধের টেন্ডারে সর্বোচ্চ ৩ মাস বা ৯০ দিন সময় দেওয়া হয়। অনেক সময় আরও কম সময়ে বর্ষার মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে বেড়িবাঁধের কাজ করতে হয়। এতে কাজের মান বলে কিছু থাকে না। তৈরি বেড়িবাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই। ফলে সামান্য জোয়ারের পানিতে বাঁধ ভেঙে জীবন ও সম্পদহানির ঘটনা ঘটে। উপকূল এলাকা বাঁচাতে টেকসই বেড়িবাঁধের অভাবে উপকূলবাসীর কষ্টের শেষ নেই।
উপকূলের জনগণকে আবহমানকাল ধরে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস মোকাবিলা করে বসবাস করতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। যেমন ঘূর্ণিঝড়ের বিপদ সম্পর্কে সতর্কীকরণের সমস্যা কমেছে। ‘মুজিব কেল্লা’ নির্মাণের ফলে আশ্রয় নেওয়ার জায়গা বেড়েছে। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। বিশেষত, জলোচ্ছ্বাস ও ভারী বৃষ্টির পানি সহজে সরে না। এ কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় এবং অনেক সময় এক ঘূর্ণিঝড়ের জলাবদ্ধতা না কাটতেই আরেক ঘূর্ণিঝড় এসে পড়ে।
কেন উপকূলের এ অবস্থা হলো এবং ভবিষ্যতে কী করা প্রয়োজন, তা বুঝতে হলে বাংলাদেশের পানি উন্নয়নের ইতিহাসের দিকে একটু তাকানো প্রয়োজন। পঞ্চাশের দশকেই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে বেশ কয়েকটি পানি উন্নয়ন প্রকল্প গৃহীত হয়। তার মধ্যে অন্যতম ছিল উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্প, যার অধীনে কয়েক দশকে ৫ হাজার ৬৬৫ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করে পুরো উপকূলকে ১৩৯টি পোল্ডারে বিভক্ত করা হয়।
উদ্দেশ্য ছিল জোয়ারের লবণাক্ত পানি উপকূলের জমিতে বিস্তৃত হতে না দেওয়া এবং এর ফলে পোল্ডারগুলোতে আরও বেশি ধান উৎপাদন করা। প্রথম দিকে ধান উৎপাদন ঠিকই বাড়ে। কিন্তু সময় গেলে পোল্ডারের বিভিন্ন কুফল দেখা দিতে থাকে।
বিজ্ঞাপন
পোল্ডারের ধারণাটি আসে নেদারল্যান্ডস থেকে। বাংলাদেশের মতো নেদারল্যান্ডসও একটি বদ্বীপদেশ। তাই সে দেশের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে করা হয়েছিল।
সে কারণে বিশ্বব্যাংক এবং এফএও বাংলাদেশের উপকূলের উন্নয়নের পন্থা নির্ণয়ে ওলন্দাজ বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হয় এবং বহুলাংশে তাঁদের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলের ওপর নেদারল্যান্ডসের মতো পোল্ডার কর্মসূচি চাপিয়ে দেওয়া হয়। এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বিদেশি পরামর্শক ও ঋণদাতা সংস্থাগুলো নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতির মৌলিক পার্থক্যগুলো অনুধাবন করেনি।
প্রথমত, নেদারল্যান্ডসের মতো পোল্ডার বানিয়ে সমুদ্রগর্ভ থেকে জমি উদ্ধারের কোনো প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশের ছিল না এবং আজও নেই। বরং এখনো প্রতিবছর প্রায় ১৯ বর্গকিলোমিটার ভূমি বঙ্গোপসাগর থেকে উত্থিত হয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগ হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, যেখানে বাংলাদেশের নদ-নদীর বার্ষিক প্রবাহের পরিমাণ পায় ১ হাজার ১০০ বর্গকিলোমিটার, সেখানে নেদারল্যান্ডসের জন্য তা মাত্র প্রায় ৯৩ বর্গকিলোমিটার।
তৃতীয়ত, যেখানে বাংলাদেশের নদ-নদী বাহিত পলিবালির পরিমাণ এখনো প্রায় ১১৫ কোটি টন, সেখানে নেদারল্যান্ডসের জন্য তা মাত্র প্রায় ৩৪ লাখ টন।
চতুর্থত, বাংলাদেশে নদীপ্রবাহের ঋতুভেদ চরম; বছরের মোট প্রবাহের প্রায় ৮০ শতাংশ বর্ষাকালের মাত্র চার মাসে কেন্দ্রীভূত থাকে। পক্ষান্তরে, নেদারল্যান্ডসে কার্যত কোনো ঋতুভেদ নেই।
বিজ্ঞাপন
উভয় দেশই বদ্বীপে অবস্থিত হলেও নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের নদ-নদী এবং উপকূল পরিস্থিতি ভিন্ন, সমস্যাও ভিন্ন। ঋতুভেদ না থাকায় নেদারল্যান্ডসে কার্যত নদীপ্রবাহজনিত বন্যার সমস্যা নেই।
বিপরীতে বাংলাদেশের জন্য বন্যা প্রশমনই বড় চ্যালেঞ্জ। নদীতে পলি না থাকায় নেদারল্যান্ডসের জন্য পলি ব্যবস্থাপনার কোনো সমস্যা নেই। সে কারণে নেদারল্যান্ডস শুধু দুটি খোলা রেখে বাকি সব নদীমুখ বন্ধ করে দিতে পেরেছে। বাংলাদেশের জন্য এ ধরনের পদক্ষেপের কথা ভাবাই যায় না, কেননা দ্রুতই পলিবালি সব নদী ভরাট করে দেবে।
বাংলাদেশের জনগণ এ দেশের বিশেষ অবস্থার উপযোগী সমাধান ঠিকই উদ্ভাবন করেছিলেন এবং সেটা ছিল অষ্টমাসি বাঁধ। উপকূলে এসব বাঁধ নির্মিত হতো শুষ্ক আট মাসের জন্য, যাতে জোয়ারের নোনাজল ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। বর্ষার শুরুতে এসব বাঁধ অপসারণ করা হতো। তখন নদীর পানি জোয়ারের পানিকে ঠেকিয়ে দিয়ে উপকূলের ভেতরে প্রবেশ করত। তার সঙ্গে প্রবেশ করত পলিমাটি। এই পলিমাটির পতনের ফলে উপকূলের প্লাবনভূমির উচ্চতা ক্রমে বৃদ্ধি পেত।
কিন্তু ওলন্দাজ ও অন্যান্য বিদেশি পরামর্শক ও ঋণদাতা সংস্থাগুলো বাংলাদেশের এই বিশেষ পরিস্থিতি এবং তার জন্য উপযোগী বিশেষ সমাধানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি না করে বরং নেদারল্যান্ডসের মতো স্থায়ী বাঁধ ও পোল্ডার নির্মাণে অগ্রসর হন।
পোল্ডারের কারণে উপকূলের জমিতে পলিপতন বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশের নদ-নদীবাহিত পলিবালির মূল অংশ মেঘনা মোহনায় পৌঁছালেও বঙ্গোপসাগরের ঘড়ির বিপরীতমুখী প্রবাহের ফলে তার একটি অংশ খুলনা ও বরিশালের উপকূলেও পৌঁছায় এবং জোয়ারের প্রবাহ দ্বারা উপকূলের ভেতরে প্রবেশ করে। কিন্তু বাঁধের কারণে পোল্ডারের ভেতরে এই পলি পৌঁছাতে পারে না।
এই ‘পলিবঞ্চনা’র ফলে পোল্ডারের ভেতরের জমি উচ্চতা বৃদ্ধিও বন্ধ হয়ে যায়। বরং ভূগর্ভস্থ পানির উত্তোলন, জমির অব্যাহত সংহতকরণ, শিকড়সহ গাছপালার উৎপাটন ইত্যাদি কারণে সেখানে জমির উচ্চতার আরও অবনমন ঘটতে থাকে।
দ্বিতীয়ত, প্লাবনভূমিতে বিস্তৃত হতে না পেরে নদীখাতগুলোতে পলিপতন বেড়ে যায়। ফলে নদীখাতগুলো ভরাট হতে থাকে এবং পোল্ডারের ফ্ল্যাপ ও স্লুইসগেটগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এভাবেই পোল্ডারগুলোতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়—যশোরের ভবদহ এলাকা যার একটি বড় উদাহরণ।
তৃতীয়ত, প্লাবনভূমিতে বিস্তৃত হতে না পেরে নদীপ্রবাহ নদীখাতগুলোতে সংকুচিত হয়। ফলে নদীর পানিসীমার উচ্চতা আরও বেড়ে যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে যোগ হয়ে তা বাংলাদেশের উপকূলের জন্য আপেক্ষিক কার্যকর সমুদ্রসীমার উচ্চতা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
পলিবঞ্চনার কারণে পোল্ডারের ভেতরে ভূমির অনপেক্ষ ও আপেক্ষিক অবনমনের বিষয়টি সবচেয়ে পরিষ্কারভাবে দেখা যায় সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটের দক্ষিণের শ্যামনগর, দাকোপ, কয়রা, মোংলা ও শরণখোলায় যেগুলোর উত্তরের অংশ পোল্ডারের অধীন কিন্তু দক্ষিণাংশ সুন্দরবনের অন্তর্গত, সুতরাং পোল্ডারের বাইরে। ফলে এসব এলাকায় পলিপতনের প্রভাবসংক্রান্ত একটি ‘প্রাকৃতিক পরীক্ষা’ সংঘটিত হয়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে নদী গবেষক আউরবাখ ও তাঁর সহযোগী গবেষকেরা দেখিয়েছেন যে গত ৫০ বছরে পলিবঞ্চনার কারণে পোল্ডারের বাইরের (তথা সুন্দরবনের) তুলনায় পোল্ডারের ভেতরের এলাকার ভূমি উচ্চতা ১ দশমিক ১৫ মিটার (৩.৮ ফুট) কম। অর্থাৎ পোল্ডারগুলো ইতিমধ্যে প্রায় চার ফুট গভীরতাসম্পন্ন কূপে পরিণত হয়েছে এবং এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে আগামী দিনে এই গভীরতা দিন দিন বাড়বে।
লক্ষণীয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের উপকূলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার ৫ মিলিমিটার থেকে ১১ মিলিমিটার বলে অনুমিত হয়। পক্ষান্তরে, বিশেষজ্ঞদের মতে, পলিপতনের ফলে উপকূলের ভূমির উচ্চতা প্রতিবছর ১০ থেকে ২০ মিলিমিটার করে বৃদ্ধি পেতে পারে। সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে টিকে থাকতে বাংলাদেশের উপকূলের জন্য পলিপতন একটি বর্ম হিসেবে কাজ করতে পারে। কিন্তু পোল্ডারের কারণে এই বর্ম কাজ করতে পারছে না।
আশা করা গিয়েছিল, নীতিনির্ধারকেরা পোল্ডারের এই বিপজ্জনক প্রতিফল দ্বারা উদ্বিগ্ন হবেন এবং অবিলম্বে পোল্ডারগুলোকে এমনভাবে সংশোধনের উদ্যোগ নেবেন, যাতে এগুলোর ভেতর পলিপতনের প্রক্রিয়া পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকেরা হাঁটছেন উল্টো পথে।
২০১৩ সাল থেকে সরকার মূলত বিশ্বব্যাংকের ঋণের ভিত্তিতে ‘উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প’ নামে এক নতুন প্রকল্প শুরু করেছেন, যার উদ্দেশ্য হলো উপকূলীয় বাঁধকে আরও উঁচু ও শক্তিশালী করা, যাতে শুধু জোয়ারের পানি নয়, ঘূর্ণিঝড় সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের পানিও পোল্ডারের ভেতরে ঢুকতে না পারে।
প্রায় ৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বাজেটের এই প্রকল্পের প্রথম পর্বের অধীনে ১৭টি পোল্ডারে এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয়। এর মধ্যে ১০টির কাজ প্রায় সম্পন্ন এবং বাকি ৭টি এই প্রকল্পের প্রায় ৫০০০ কোটি টাকার বাজেটের দ্বিতীয় পর্বে আরও ১৩টি পোল্ডারের সঙ্গে বাস্তবায়নের জন্য অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
লক্ষণীয়, যেসব পরামর্শক সংস্থার নেতৃত্বে ‘উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প’ প্রণীত ও বাস্তবায়িত হচ্ছে, তার নেতৃত্বে রয়েছে এক ওলন্দাজ সংস্থা। অর্থাৎ প্রায় ৭০ বছরের অভিজ্ঞতার পরও বাংলাদেশ ক্ষতিকর ওলন্দাজ প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।
২০২৩ সালে প্রণীত এই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্বের ‘বাস্তবায়নযোগ্যতা সমীক্ষা’তেও পোল্ডারগুলোর পলিবঞ্চনা এবং সে কারণে এগুলোর কূপে পরিণত হওয়া এবং ক্রমশ সমুদ্রসীমার নিচে চলে যাওয়ার কোনো উল্লেখ দেখা যায় না।
এই সমীক্ষায় ‘অতীত কর্মসূচি এবং আহরিত শিক্ষণীয়’ শিরোনামের দীর্ঘ পাঁচ পৃষ্ঠার একটি সারণিতে মোট ১৫টি শিরোনামে নানা ধরনের আহরিত শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মৌলিক যে শিক্ষা, তথা পোল্ডারগুলোর কূপে পরিণত হওয়া, সে বিষয়ে একটি শব্দও তাতে খুঁজে পাওয়া যায় না।
ওলন্দাজদের কাছ থেকে সম্ভবত ভিন্ন কিছু আশা করাও সংগত নয়। কারণ, তাঁরা তো পোল্ডার বলতে সমুদ্রসীমার নিচের এলাকাই বোঝে! উপকূলের জনগণকে কি জেনেশুনে সমুদ্রসীমার নিচে ঠেলে দেওয়া ঠিক হচ্ছে?
যদি তা না হয়, তবে অবিলম্বে নীতির পরিবর্তন প্রয়োজন। যেসব বিদেশি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের পরিস্থিতির সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত, তাঁরা পোল্ডারের সংকটটি ঠিকই উপলব্ধি করেছেন। যেমন হিউ ব্রেমার, যিনি বাংলাদেশের নদ-নদী নিয়ে একাধিক বই লিখেছেন, তিনিও পোল্ডারের ভেতর পলি ‘ইনজেকশনে’র সুপারিশ করেছেন, যদিও ঠিক কী পদ্ধতিতে এই ইনজেকশন করা হবে, তা স্পষ্ট করেননি।
পলিপতনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা দুভাবে হতে পারে। একটি হলো উপকূলীয় বাঁধগুলোকে এমনভাবে সংশোধন করা, যাতে পোল্ডারের ভেতরে পলিপতনের সুযোগ থাকে। সে জন্য এমন স্লুইসগেট থাকতে হবে, যেগুলো বর্ষার চার মাস খোলা থাকবে, যাতে পলিমিশ্রত পানি ভেতরে ঢুকতে পারে এবং বাকি সময় বন্ধ থাকবে।
তত্ত্বগতভাবে এই সমাধান যতটা আকর্ষণীয়, বাস্তবে তা ততটা কার্যকর নয়। অতীত অভিজ্ঞতাই তার প্রমাণ। দেখা যাবে, শিগগিরই এসব স্লুইসগেট অকেজো হয়ে গেছে এবং এ কারণে কূপের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে।
দ্বিতীয় উপায় হলো অষ্টমাসি বাঁধের ব্যবহারসম্পন্ন উন্মুক্ত পন্থায় প্রত্যাবর্তন। এই প্রস্তাবের পক্ষে রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা-আবিষ্কার’ কবিতার কথা স্মরণ করা যেতে পারে।

