—মুহাম্মদ ওয়াছিয়ার রহমান
ইসলামের মৌলিক স্তম্ভের মধ্যে কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ্জ ও যাকাত। যাকাত অর্থের এবাদাত এবং উশর হচ্ছে মালের এবাদত। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেন– ‘হে ঈমানদারগণ, যে মাল অর্জন করেছো এবং যা আমি যমীন থেকে তোমাদের জন্য বের করে এনেছি, তা থেকে উৎকৃষ্ট অংশ (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর’, সূরা বাকার–২৬৭।
শরীয়তী পরিভাষায় উশর হচ্ছে উৎপাদিত ফসলের যাকাত যা কোনো জমির উৎপাদিত ফসলের উশর বা মালের যাকাত বলা হয়। প্রথমে যাকাত ফরজ হয় মক্কাতেই কিন্তু তখন কী কী মালের উপর কী পরিমান দিতে হবে তার বিস্তারিত বিবরণ বলা হয়নি। যার ফলে সাহাবীগণ নিজেদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা থাকতো, তার সবটাই দান করে দিতেন। অতঃপর দ্বিতীয় হিজরীতে মদীনায় এর বিস্তারিত বিধান নাযিল হয়। আমদের মধ্যে লক্ষ্য করা যারা মনে করে– ‘কলেমা, নামাজ, রোজা, যাদের সামর্থ আছে তাদের জন্য হজ্জ্ব এবং বড়জোর গৌণ হিসেবে যাকাত এটা হলেই যথেষ্ট। অথচ যে কলেমার জন্য, দ্বীনের জন্য ও আল্লাহর বিধান আল্লাহর যমীনে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিশ্বনবী সাঃ সারাটা জীবন ত্যাগ করেছেন তা বেমালুম ভুলে গেছি। বুঝের সংকটের কারণে একদিকে যেমন–আমরা নানাবিধ অন্যায় ঘুষ, সুদ, অবিচার, মিথ্যার সাথে সম্পৃক্ত, ঠিক সামান তালে নামাজ, রোজা এবং হজ্জ্বও একই গতিতে চালিয়ে যাচ্ছি। যা নবী–রাসূল, সাহাবী এবং তাঁদের অনুসারীদের জীবদ্দশায় কোথাও দেখা যায়নি। ঠিক অনুরূপ ভাবে আমরা যারা যাকাতকে আবশ্যকীয় বিধান মনে করি তাদেরও অধিকাংশ বেমালুম ভুলে গেছি যে, যমীনের উৎপাদিত ফসলের উপর উশর বা যাকাতও একই ভাবে ফরজ। বাংলাদেশে প্রায় নব্বই শতাংশ মুসলমান অধিকাংশই গ্রামে বসবাস করি, যেখানে হাজার হাজার টন খাদ্যশষ্য উৎপাদিত হয়। কিন্তু হিসাব করে উশর ক’জনে আদায় করি! অথচ এটি একটি আবশ্যক বিধান। এমনকি গ্রাম–গঞ্জে মসজিদ–মাহফিল সমূহে এর উপর আলোচনাই লক্ষ্য করা যায় না।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ আরও বলেন– ‘(তিনি আরও সৃষ্টি করেছেন) খেজুর গাছ, বিভিন্ন প্রকার খাদ্যশস্য ও আনার, আবার তা ভিন্ন ধরনেরও হতে পারে, যখন তা ফলবান হয় তখন তোমরা তা খাও, তোমরা ফসল তোলার দিনে তার হক আদায় কর, কখনও অপচয় করিও না; কেননা, আল্লাহ তা‘য়ালা অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না’, সূরা আনআম–১৪১।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন নবী করীম সঃ বলেছেন– ‘পাঁচ ওসাকের (সাড়ে সাতাশ মন বা এগার’শ কেজি) কম পরিমাণ শস্যের জন্য কোনো যাকাত নেই, পাঁচ উটের কম সংখ্যায় যাকাত নেই এবং পাঁচ উকিয়ার কম (রৌপ্য দ্রব্যের জন্য) যাকাত নেই’ (বুখারী ও মুসলিম)। এক্ষেত্রে রাসুল সঃ–এর আরও একটি হাদিস জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রাঃ থেকে বর্নিত, তিনি নবী সঃ–কে বলতে শুনেছেন– ‘যে জমি, নদী–নালার (প্রাকৃতিক উপায়ে) পানিতে সিক্ত হয় তাতে উশর (উৎপাদিত শষ্যের এক–দশাংশ) ধার্য হয়। অন্যদিকে যে জমিতে উটের সাহায্যে পানি সরবরাহ করা হয় তাতে অর্ধেক উশর (এক–বিশাংশ) ধার্য হয় (মুসলিম শরীফ)। যাকাত যেমন অর্থটি এক বছর হাতে থাকা জরুরী কিন্তু কৃষি পণ্য বা ফসলের ক্ষেত্রে এক বছর গচ্ছিত থাকার বিষয়টি বিবেচিত হবে না। উৎপাদিত পণ্যকেই হিসাবে আনতে হবে।
যে ফসলের ওপর উশর ফরজ ঃ
ফসলের ওপর উশর ফরজ–যেমন খাদ্যশস্য, সরিষা, তিল, বাদাম, আখ, ফলমূল, শাকসবজি ও খনিজ দ্রব্য ইত্যাদি। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বিনিয়োগ করা হলে বনবৃক্ষ, ঘাস, ঔষধি বৃক্ষ, চা, রাবার, তুলা, ফুল, বীজ, চারা, কলম, মাছ–মাংশ ও অন্যসব ব্যবসায়িক পণ্য ইত্যাদি যাকাতের আওতাভূক্ত হবে। উশর আদায়ের প্রক্রিয়া ঃ (এক) ফসলের মালিক যদি উত্তোলনের শুরুতেই ফসলের পরিমান নিরূপণ করতে সমর্থ হন তাহলে প্রথম থেকেই উশর পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু শুরুতেই যদি নিসাব পরিমান না হয় তাহলে প্রথম উত্তোলন থেকেই হিসাব রাখতে হবে এবং যখন নিসাব পরিমানে পৌঁছে যাবে তখন থেকেই উশর পরিশোধ করতে হবে, (দুই) ফসল উত্তোলনের আগে যদি মালিক মারা যায়, তার উত্তরাধিকারগণ উশর পরিশোধ করবে, (তিন) এক বছরে ব্যক্তির ভোগ করার পর যদি সঞ্চিত থাকে তাহলে যাকাত ধার্য হয়, কিন্তু উশরের ক্ষেত্রে যখন ফসল কাটা হয় তখনই ভোগ ব্যয়ের পূর্বেই গণনা করতে হবে, (চার) ফসল যখনই ব্যবহার যোগ্য হবে তখনই তার উপর উশর প্রযোজ্য হবে, (পাঁচ) জমির খাজনা দিলে উশর মাফ হয় না এবং (ছয়) উশর মোট উৎপাদিত ফসলের উপর আদায় করতে হবে। অনুমানের উপর ভিত্তি করে উশর/যাকাত দেয়া যাবে না, দিলে তা সাদকা হিসেবে গণ্য হবে।
ফসলের যে অংশের উপর উশর প্রযোজ্য হবে না ঃ
(এক) ফল বা ফসলের যে অংশ চাষ কাজে ব্যবহৃত গবাদি পশু ভক্ষণ করে, (দুই) পথচারীগণ কর্তৃক ভক্ষণ করা অংশের উপর এবং (তিন) জনহিতকর কাজে দান কৃত অংশ।
উশর/যাকাত না দেয়ার পরিনাম ঃ
যাকাত না দেওয়ার পরিণাম সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য সঞ্চিত করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে কঠিন শাস্তির সুসংবাদ প্রদান করুন। যে দিন দোযখের আগুনে উত্তপ্ত এবং তা তাদের ললাট, পাসর্¦দেশ ও পৃষ্ঠাদেশে দাগ দেয়া হবে এবং বলা হবে এ সবকিছু তাই যা তোমরা দুনিয়াতে নিজেদের জন্য সঞ্চয় করে রেখেছিলে, সুতারাং যা তোমরা সঞ্চয় করে রেখেছিলে এখন তার স্বাদ গ্রহণ কর’ সূরা তওবা– ৩৪–৩৫।
পবিত্র কোরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী যাকাত/উশর মূলত আটটি খাতে ব্যয় করা যাবে ঃ (এক) গরীব ঃ যাদের কাছে কিছু না কিছু ধন–সম্পদ আছে কিন্তু তাদের যাবতীয় প্রয়োজন পূর্ণ করার জন্য তা যথেষ্ট নয়, (দুই) মিসকীন ঃ যেসব লোকের অবস্থা আরও খারাপ, তদুপরি কারোর কাছে কিছু চাইতে পারে না তারা মিসকীন, (তিন) যাকাত/উশর বিতরণকারী কর্মচারী ঃ যাকাত/উশর আদায়ে যাদের কর্মচারী, (চার) ইসলামের পথে মনোতুষ্টি করতে করতে ঃ ইসলামের বিরোধীদের মনোতুষ্টি করা, (পাঁচ) গোলাম ও কয়েদী মুক্তিঃ দাসত্বের শৃংখলে বন্দী এবং যে মুক্তি পেতে চায় তাকেও যাকাতের অর্থ দিয়ে মুক্ত করা যাবে। অন্যয় ভাবে আটক রাখা কয়েদী বা হাজতীদের মুক্তিতে এ অর্থ ব্যয় করা যাবে, (ছয়) ঋণগ্রস্ত লোক ঃ ঋণী অথবা ঋণ পরিশোধ করার সক্ষমতা যাদের নেই, তাদেরকেও যাকাতের অর্থ দ্বারা ঋণ মুক্তি দেয়া যাবে, (সাত) আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদে ব্যয় ঃ আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের সাহায্য করা এবং (আট) নিঃস্ব^ পথিক বা মুসাফিরদেরকে ঃ নিঃস্ব পথিক বা প্রবাসীকে যাকাতের অর্থ দেয়া যাবে। হালাল না খেলে দোয়া যেমন কবুল হয় না, তেমনি হারাম খাদ্য খাবার খাওয়ার ফলে রক্ত-মাংশ হারাম হচ্ছে। ওই রক্ত-মাংশ বা ওই হারাম শরীরের উপাদান থেকে জন্ম নেয়া পরবর্তী প্রজন্ম হারাম উপাদান থেকেই জন্ম হচ্ছে। সুতরাং এই হারাম থেকে জন্ম নেয়া প্রজন্ম থেকে কোন ভাল কাজ প্রত্যাশা করা যায় না। এজন্যই মনে হয়, বর্তমান প্রজন্ম ভাল কাজের দিকে আসছে না, বা আসলেও এ পথে টিকে থাছে না। প্রকৃত পক্ষে আমরা কলেমা, নামাজ, রোজা ও হজ্জ্বে যেমন আল্লাহর কাছে নিজেকে যেমনি সোপর্দ করে দিচ্ছি তেমনি যাকাত বা উশরের বিধানে প্রতিপালন করে নিজেকে সপে দিতে হবে। অথচ এই বিশেষ কিতাবী বিধানকে আমলে নিয়ে আসছি না। আল্লাহর বান্দাগণ যারা নামাজে মহান তাঁর সামনে গভীর আবেগ সহকারে দেহ-মন বিলিয়ে দেয় অথচ নামাজ থেকে বের হয়ে বাইরে এসেই সে আল্লাহর ফরয বিধান যাকাত বা উশরকে অবহেলা করে, কিভাবে এই দ্বৈত আমল তাঁর কাছে গ্রহনযোগ্য হবে।