চল্লিশ দশকে যখন বাংলার নারী সমাজ অন্ধকার গৃহকোণে আবদ্ধ থাকাকেই নিয়তি বলেই জানত সেই সময়ে আনোয়ারা বেগম (যিনি সবার কাছে রানু আপা নামেই পরিচিত ছিলেন) সমাজের প্রচলিত প্রথার বিরুদ্ধে দৃঢ় বলিষ্ঠতায় নারী সমাজকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার ডাক দিয়েছিলেন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন শিক্ষা ছাড়া নারীর মুক্তি মিলবে না। খালিশপুরের চরের হাটে পৈতৃক বাড়ি হলেও পিতার কর্মসূত্রে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে জন্মগ্রহণ করেন ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩১ সালে। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা ছিল ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত ।কঠিন দারিদ্র্যের মধ্যে বাড়িতে বড় ভাইদের কাছে পড়াশোনা করে ১৯৪৮ সালে প্রাইভেটে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন।তারপর রাজেন্দ্র কুমার গার্লস কলেজ (RKGC, যে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন খুলনা পৌরসভার চেয়ারম্যান মহেন্দ্র কুমার ঘোষ) থেকে আইএ ও বিএ পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পাস করেন। মেট্রিক পাশ করার পর থেকেই তিনি একই সাথে খুলনা বি আর সিং রেলওয়ে স্কুলে চাকরি করতেন এবং (RKGC) কলেজে পড়তেন। এমএ পাস করার পর তাকে ওই কলেজেই অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাঁর সমগ্র জীবনই ছিল সংগ্রামময়। তিনি নির্ভীকভাবে শিক্ষার প্রসার, সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ মূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। আহসান আহমেদ রোডে কলেজটি পঞ্চাশের দশকে স্থানান্তরিত হয়। খুলনা গার্লস কলেজ নামে নিজস্ব ক্যাম্পাস পাওয়ার পরে তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা, দুঃসাহসী মনোভাব, যোগ্যতা দেখে গভর্নিং বডি তাঁকে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। তাঁর দক্ষ হাতের পরিচালনায় কলেজে নতুন নতুন বিভাগ খোলা হওয়ার ফলে ছাত্রী ও শিক্ষক সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ফলে তিনি কলেজটিকে বর্তমান স্থানে বয়রায় স্থানান্তর করেন। মোট ১৮ একর জমি ক্রয় করেন, তার থেকে ২ একর জমি কলেজসংলগ্ন বিভাগীয় গ্রন্থাগারকে দেন। আজকের খুলনা সরকারি মহিলা কলেজটি তাঁর নিজের হাতে তৈরি। তাঁর সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন এবং বলিষ্ঠ প্রশাসনিক দক্ষতার ফলে মহিলা কলেজ খুব দ্রুত জাতীয় পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কলেজ গুলোর মধ্যে স্থান করে নেয়। উর্দু কবি কৃষন চন্দের গাদ্দার উপন্যাস এর বঙ্গানুবাদ করে তিনি সারা বাংলাদেশে সাড়া ফেলে দেন। তাঁর জীবনী অল্প কথায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তাঁর স্বামীর বদলি জনিত কারণে ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে তিনি খুলনা ত্যাগ করেন। ফলে খুলনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় ৪০ বছরের বেশি সময় খুলনার মানুষ তাঁকে চেনে না, তাঁর বিশাল অবদান সম্পর্কে কিছুই জানে না। শেষ বয়সে তিনি সপরিবারে আমেরিকায় প্রস্থান করে ২০ আগস্ট ২০১৮ সালে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এবং সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়।