
সিরাজুল ইসলাম, শ্যামনগর: আজ থেকে দুই দশক আগেও বাংলাদেশের সকল গ্রামাঞ্চলে প্রাচীনতম ঐতিহ্যবাহী গরুর ঘানির মাধ্যমে সরিষার তেল তৈরি হতো। এই ঘানির মালিক ঘানি বা শাহাজী নামে পরিচিত। আর এই তেল দিয়ে মানুষ তাদের তেলের চাহিদা পূরণ করত এবং সরিষা ভাঙানো খৈল গরুর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
বাংলাদেশের রেস্তোরাঁ
যশোরের চৌগাছা উপজেলাতে নানা ধর্ম আর নানান পেশার মানুষের বসবাস। এ সকল পেশার মধ্যে কলু (শাহাজী) একটি অন্যতম পেশা। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে এক সময়ে এই পেশার মানুষের বসবাস চোখে পড়ার মতো ছিল। নানা প্রতিকূলতার মাধ্যমে ওই পেশা পরিবর্তন করতে তারা বাধ্য হয়েছে বলে জানা গেছে। গরু ও গাছের সমন্বয়ে সরিষা, তিল এবং ভেরেন্ডা থেকে তেল তৈরি করে তা বাজারে বিক্রি করে তারা জীবিকা নির্বাহ করতেন। ঘানিতে তৈরি করা তেল যেমন সুস্বাদু তেমনি উপকারী। কিন্তু ঘানিতে তৈরি করা তেলের স্থান দখল করে নিয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে তৈরি করা তেলে। ডিজিটাল প্রযুক্তিতে তৈরি তেলের বাজার মূল্য কম থাকায় মানুষ ওই তেলে দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়েছেন। বিনিয়োগ ও পরিশ্রম বেশি কিন্তু বাজারমূল্য কম থাকায় দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে ঘানির সংখ্যা।
সাতক্ষীরা শ্যামনগর উপজেলার গোপালপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায় নানা প্রতিকূলতার মধ্যে কয়েকটি ঘানি এখনও অবশিষ্ট আছে। প্রতিটি ঘানিতে চলছে তেল তৈরির কাজ। এমন এক সময় ছিল খড়িঞ্চার ওই মহলস্নাটিতে ঘরে ঘরে ছিল ঘানি। যে কারণে মহলস্নাটি কলুপাড়া হিসেবে পরিচিতি পায়। কিন্তু এখন হাতে গোনা ৫ থেকে ৬টি ঘানি গ্রামটিতে অবশিষ্ট আছে। ঘানিতে তেল প্রস্তুতে ব্যস্ত শাহজি হারুন অর রশিদ (৭৫)। তিনি জানান, ‘বাপ-দাদারা এই পেশায় নিয়োজিত ছিল। বলা চলে পৈত্রিক সূত্রে আমি এই পেশা পেয়েছি। বাপ-দাদারা ঘানি থেকে রোজগার করা অর্থে আমাদের বড় করেছে, আমি এখান থেকে রোজগার করে সংসার চালাই।’ তিনি বলেন, ১ কেজি সরিষা মাড়াই করতে ২০ টাকা নেয়া হয়। দিনে ২০ থেকে ২৫ কেজি সরিষা মাড়াই করা যায়। ভালো মানের সরিষা হলে ১০ কেজি সরিষা থেকে ৩ কেজি তেল হয়। আর খৈল হয় ৬ কেজি। প্রতি কেজি তেল বাজারে ২২০ টাকা দরে বিক্রি করেন।
ঘানিনের মালিকরা জানান, নিঃসন্দেহে এটি একটি ঐতিহ্য। নানা কারণে আজ ঘাইন হারাতে বসেছে। উপজেলার সচেতন মহল প্রাচীনতম এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য সংশ্লিষ্টদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।ঘানির সরিষার তেল এক সময় ছিল বাঙালি রসুই ঘরের অন্যতম অনুসঙ্গ। বিয়ে, ঈদ, আকিকা, পূজা-পার্বণ, পারিবারিক অনুষ্ঠানে এই তেল ছিল অপরিহার্য বিষয়। তবে কালের বিবর্তনে প্রযুক্তিক উৎকর্ষে হারাতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী ঘানি শিল্প।
বগুড়ায় এখন আর ঘানি খুব একটা চোখে পড়েনা।
গরু দিয়ে কাঠের ঘানি ঘুরিয়ে সরিষার তেল বের করারে দৃশ্যও তাই বিরল।
ঘানির চারপাশে একসময় গরু বা অন্য কোন প্রাণী জোঁয়াল কাঁধে নিয়ে ঘুরতো। আর ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ হতো। আশপাশের মানুষ চোখ বন্ধ করে বুঝে নিতো সরিষা মাড়াই করে কলু সম্প্রদায় তৈরি করছে খাঁটি সরিষার তেল।
ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজের সাথে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়তো সরিষার তেলের ঝাঁঝালো গন্ধ। বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ব্যবহারে হারিয়ে যেতে বসেছে আদি কালের ঘানি শিল্পের সেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ।
জানা যায়, সাতক্ষীরা খুলনা বাগেরহাট যশোর নড়াইল জেলার উপজেলার গ্রামে গ্রামে ঘানিশিল্পের ব্যপক প্রচলন ছিল। বিশেষ করে শিবগঞ্জ উপজেলায় ঘানি শিল্প ছিল বেশি।বগুড়ায় ঘানি শিল্পের কখন কিভাবে প্রসার হয়েছিলো সে ইতিহাস জানা না গেলেও প্রবীণ ব্যক্তিরা বলছেন, মানুষের প্রতিদিনের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ঘানি শিল্পের শুরু হয়। ঘানিতে ভালো ও খাঁটিমানের সরিষার তেল পাওয়া যেতো বলে এই এর জন্য মানুষ মুখিয়ে থাকতো। একদিকে মানে খাঁটি অপরদিকে পরিবারের সদস্যদের জন্য ভালো ভোজ্য তেল। সেকারণে সাতক্ষীরা খুলনা বগুড়া ও সাতক্ষীরার আশপাশের জেলায় বগুড়ার ঘানির তেলের চাহিদা ও সুখ্যাতি ছিলো।
বলা হয় স্বাধীনতার পরেও বগুড়ার ঘানিতে তৈরি সরিষার তেল নওগাঁ, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর জেলায় বিক্রি হতো।
ঘানির তেলের মানের কারণে চাহিদাও ছিল খুব। তবে বর্তমানে ঘানিতে সরিষা ভেঙে তেল বানানো সেই কলু সম্প্রদায়ই ছেড়েছে আপন পেশা। জীবিকার তাগিদে তারা হাঁটছে অন্য উপার্জনের পথে। দুই একটি পরিবার দেখা যায় শিবগঞ্জ উপজেলার একেবারে প্রান্তিক পল্লীতে।
কলু সম্প্রদায়ের লোকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, গাছের ভালো কাঠ দিয়ে ঘানি তৈরি হয়ে থাকে। এর সঙ্গে গরু বা অন্য কোন প্রাণীকে ঘানির সাথে ঘোরাতে জোঁয়াল থাকে। জোঁয়ালের গোড়ার দিকে বেশ কিছু ভারী পাথর থাকে। যেন ঘানির ভিতরে চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এই জোঁয়াল যত ঘুরবে তত চাপ সৃষ্টি হবে। আর সেই চাপে বের হবে সরিষার তেল। এই তেল ফোঁটা ফোঁটা করে পরে একটি পাত্রে জমা হবে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির বৈদ্যুতিক মোটরচালিত লোহার ঘানির কারখানা এই শিল্পকে বিপন্ন করেছে। সাথে দাম ও অপ্রতুলতার কারণে ভোজ্য তেল হিসেবে সরিষার ব্যবহারও কমেছে অনেকটা।
দিনে ঘানিতে ২৫ থেকে ৩০ কেজি কেউ বা আবার ৪০ কেজি সরিষা মাড়াই করতে পারতো। এখন সেখানে মেশিনের ঘানিতে এক হাজার কেজিও মাড়াই করা যায়। ঘানিতে শ্রম বেশি লাভ কম। শিবগঞ্জের পৌর এলাকার কলুমগাড়ি গ্রামের মোঃ আবু জাফর সিদ্দিক ঘানিতে খাঁটি সরিষার তেল ভাঙতেন। তিনি ৬ মাস আগে নানা প্রতিকূলতার কারণে সেটি বন্ধ করে দিয়েছেন।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গোপালপুর গ্রামের মোঃ আবু জাফর সিদ্দিক জানান, পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া এই ব্যবসা তারা করে আসছিলেন। আবু জাফর তার বংশের তিন পুরুষের এ পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। তার দাদা মৃত মানিক উল্লাহ ঘানির খাঁটি সরিষার তেল বিক্রি করতেন। দাদার পর বাবা মৃত হোসেন আলীও একই পেশার জীবিকা নির্বাহ করেছেন। বর্তমানে সত্তর বছর বয়সে এসে তিনি এ শিল্পটি আর টিকিয়ে রাখতে পারেননি। বর্তমানে ২ ছেলে, ৫ মেয়ে ও স্ত্রী রোকেয়া বেগমকে নিয়ে তার সংসার। বাপ-দাদার এই পেশা ছাড়তে তিনি এখনও নারাজ। আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হওয়ায় তিনি এ পেশা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। বর্তমানে তার বাড়িতে শুধু ঘানিশিল্পের কিছু চিহ্ন রয়েছে। আবু জাফর আরও জানান, ঘানির সঙ্গে একটি গরুর চোখ বেঁধে কাঁধে জোয়াল লাগিয়ে দেওয়া হতো। আর গরুটি দিনভর ঘানির চারপাশে আপন মনে ঘুরতে থাকতো। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঘানিতে তেল ভাঙার কাজ করতেন তিনি। এক সময় ঘানির নল দিয়ে টিপটিপ করে তেল বের হতো। তার স্ত্রী রোকেয়া বেগম ৪৮ বছর ধরে প্রতিনিয়তই স্বামীকে ঘানিতে সারিষা মাড়ায়ে সহযোগিতা করেছেন। তার ঘানিতে এক মন সরিষা থেকে ১৫ থেকে ১৬ লিটার তেল পাওয়া যেত। তিনি প্রতিদিন ২৭ কেজি সরিষা ঘানিতে ভাঙতেন এবং তা থেকে গড়ে প্রায় ৮ থেকে ৯ লিটার তেল বের হতো। ওই তেল মাটির কলসি করে মহাস্থান ও শিবগঞ্জ হাট বারে বিক্রি করতে নিয়ে যেতেন। বাজারে মেশিনে ভাঙানো সরিষা তেলের চেয়ে তার তেলের চাহিদা অনেক বেশি ছিল। তিনি প্রতি লিটার তেল বিক্রি করেন ১৮০ টাকা দরে।
সাতক্ষীরার কলোরোয়ার কেড়াগাছে গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি আজিজার রহমান জানান, তিনি কলু জাফরের কাছ থেকে দীর্ঘদিন ধরে সরিষার তেল কিনছেন। পরিবারের সদস্যদের জন্য ভালো মানের ভোজ্য তেল ব্যবহার করা হতো। তিনি জানান, এক সময় গৃহস্থরা খাঁটি সরিষার তেল সব ধরণের রান্নার কাজে ব্যবহার করতো। এছাড়া ঈদ, পুজা, ঘরোয়া কোন অনুষ্ঠানে ঘানির তেলের রান্নার একটা রেওয়াজ ছিলো। সেটিও নেই। এক কথায় ঘানির সরিষার তেল ছাড়া সে সময় রান্না হতো না। কিন্তু ইদানিং এই তেল পাওয়ায় যাচ্ছে না। সবই এখন মেশিনে তৈরি তেল। ঘানি শিল্প হারিয়ে গেলেও সরিষা চাষ কমেনি বগুড়ায়। এখনো কৃষকরা শ্রম দিয়ে মমতায় ফলিয়ে যাচ্ছেন সরিষা। মানে, দামে, হাত পেরিয়ে মেশিনে তৈরি হয়ে সরিষা তেল আবার আসছে ঘরেঘরে। তবে সেটি মেশিনের মাড়াই করা সরিষার তেল।