হারুন -অর-রশীদ
প্রায় দু’শ বছরের পুরাতন খুলনা বড় বাজার। নানা কারণে তার ঐতিহ্য হারাচ্ছে। দক্ষিণ- পশ্চিমমাঞ্চলের সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক কেন্দ্র এই বড় বাজার। প্রতিদিন কাকডাকা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পণ্য সামগ্রী বেচা কেনা হচ্ছে। কোটি কোটি টাকা হাতবদল হচ্ছে। এটি একটি ব্যবসায়ীক বড় মোকাম। দূর দুরন্ত থেকে আগত ক্রেতারা তাদের চাহিদা মতো পণ্য সংগ্রহ করছেন। খুচরা পণ্য বিক্রির পাশাপাশি পাইকারি ব্যবসার অনেক সুযোগ রয়েছে। রয়েছে হাজার হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বড় বাজারের মধ্যে রয়েছে কেডি ঘোষ রোড, কালিবাড়ি রোড, ভৈরব স্ট্র্যান্ড রোড়, ওয়েষ্ট মেকড রোড, স্টেশন রোড, জিগজাগ রোড, হেলাতলা , ক্লে রোড ও মহেন্দ্র দাসের মোড়।
ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বড় বাজারের রয়েছে নানা সমস্যা। রাস্তাগুলো একবারে সংকোচিত। ঠেলাগাড়ি, রিকসা, ইজিবাইক ও ভ্যানগাড়ি প্রবেশ করায় বাজারে আসা ক্রেতা সাধারণ পথ চলতে নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। রাস্তার ওপর খুচরা ব্যবসায়ীরা পসরা নিয়ে বসেন। বিশেষ করে বাজারে কর্মরত শ্রমিকদের অশ্লীল ভাষা ব্যবহার ও বিরুপ মন্তব্য করায় নারী ক্রেতাদের লজ্জায় পড়তে হয়। ভৈরবস্ট্র্র্যান্ড রোডটি ভৈরব নদের পাড়ে হওয়ার কারণে প্রতিবছর দেবে যায়। রাস্তাটিতে ব্যবসায়ীরা তাদের মালামাল রাখায় একে বারে সরু হয়ে গেছে। ক্রেতাদের চলাচল করতে মারত্মক অসুবিধা হচ্ছে। একই সঙ্গে পুরাতন জরাজীর্ণ ভবনগুলো এখন রয়েছে মারাত্মক ঝুঁকিতে। মহেন্দ্র নাথ দাসের মোড়ে ফল পট্টির অবস্থা একই রকম। সারাক্ষণ জানজট লেগে থাকে। সোনাপট্টি ও মুড়ি পট্টিতে লোকজন প্রবেশ করতে পারছেনা। বড় বাজারে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশ করতে পারছেনা। ক্লে রোডর অবস্থা একই রকমের।
খুলনা বিভাগীয় শহর। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। ব্রিটিশ অধ্যায়ের অবসান ঘটে। ১৯৫০-৭০’র দশকে কিছু বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। হযরত পীর খানজাহান আলী (র.) স্মৃতি বিজড়িত ও ভৈরব-রূপসা বিধৌত খুলনার ইতিহাস নানাভাবে ঐতিহ্য মন্ডিত। নামকরনে নানান মত রয়েছে।
খুলনার নাম করণ করা হয় কিসতম খুলনা থেকে খুলনা। ধনপতি সাওদাগরের দ্বিতীয় স্ত্রী খুল্লনার নামে নির্মিত খুল্লনেশ^রী কালিমন্দির থেকে খুলনা। এভাবে খুলনার নামমকরণ করনা হয়।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে শহর হিসেবে বিখ্যাত হওয়ার আগে খুলনার পরিচিত ছিল ‘চার্লিরহাট’ বা সাহেবের হাট নামে। তখন বড় বাজারের নাম ছিল চার্লিগঞ্জ নামে। নীল কুঠিয়াল চার্লস এই বাজারের নামের কারণে তার নামে নাম করণ করা হয় চার্লিগঞ্জ । নড়াইলের জমিদাররা খুলনাকে শাসন করতো। বড় বাজার ভৈরবনদেরা তীরে কাচরী ছিল। দু‘তলা ভবনে প্রজারা এসে খাজনা দিয়ে যেত নবাবদের কাছে। প্রজারা নৌ-পথে এসে খাজনা পরিশোধ করতো। বড় বাজারে এখনো কাচারীঘাট বিদ্যমান রয়েছে।
সূত্র জানায়, এক সময় যশোরের অধীনে ছিল খুলনা। ১৮৪২ সালে খুলনাকে নয়াবাদ থানা থেকে মহাকুমায় উন্নীত করা হয়। এ সময় সকল শ্রেণির মানুষ তাদের প্রয়োজনে ভৈরব নদের তীরে আস্তে আস্তে বাজার গড়ে তোলে। মহাকুমার প্রতিষ্ঠার ৪০ বছর পর ১৮৮২ সালের ২৫ এপ্রিল নতুন জেলার নটিফিকেশন করা হয় এবং ১ জুলাই থেকে খুলনা জেলা যাত্রা শুরু হয়। লোক সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে বড় বাজারেরও পরিধি বাড়তে থাকে। ১৮৮০ ও ৮৪ সালে স্টিমার, রেলওয়ে স্টেশন এবং পৌরসভা চালু হলে বড় বাজার হয়ে উঠে জমজমাট। ব্যবসায়ীদের আগমন ঘটে। নতুন রূপ নেয় বড় বাজার। ভারত থেকে মাড়ায়ারী ব্যবসায়ীরা এই বাজারকে কেন্দ্র করে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের আগ পর্যন্ত মাড়োয়ারীরার ব্যবসা নিয়ন্ত্রিত করতো। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে তারা তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। এর অল্প দিনের মধ্যে এর শূন্যতা পূরণ করে পাকিস্তানী ব্যবসায়ীরা। ১৯৫০ সালে মোংলা বন্দর চালু হলে বড় বাজারের যৌবন ফিরে আসে। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীনতা লাভ করলে পাকিস্তানীরা তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিলে আবারো বড় বাজার শুণ্যতায় পড়ে। বাঙালী ব্যবসায়ীরা আবার দ্রæত বড় বাজারের শুন্যতা পূরণ করেন। ৮০’র দশক থেকে বড় বাজারে শুরু হয় চাঁদাবাজিসহ নানা অত্যাচার , জুলুম ও নির্যাতন। ব্যবসায়ীরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে নৌ-পথ। মোংলা বন্দর অচল ও খুলনার মিলকল কারখানা বন্ধ। হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। শুরু হয় নানা অস্থিবরতা। শুরু হয় বড় বাজারের যৌবনের ভাটা। এই বাজারকে ঘিরে গড়ে উঠছে বেশ কয়েকটি ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠান। বড় বাজার বিআইডবিøউটিএ, জেলা প্রশাসন ও সিটি কর্পোরেশন নিয়ন্ত্রণ করে। বাজার থেকে রাজস্ব তিন ভাগ হয়ে যাচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের সব চেয়ে সংগঠন হচ্ছে খুলনা শিল্প ও বনিক সমিতি। বড় বাজারে বেশ কয়েকটি ব্যবসায়ীদের সংগঠন রয়েছে। এর মধ্যে খুলনা বাজার ব্যবসায়ী মালিক সমিতি , ধান চাল বনিক সমিতি, খুলনা মেট্রোপলিটন স্টেশনারী ব্যবসায়ী সমিতি, বড় বাজার ক্লথ মার্চেন্ট এসোসিয়েশন, খুলনা ক্ষুদ্র বাজার ব্যবসায়ী সমিতি, ফুটপাত হকার্স এসোসিয়েশন, মসলাপট্টি ব্যবসায়ী সমিতি, খুলনা জেলা হকার্স এসোসিয়েশন , কাঁচা ও পাকা মাল আড়ৎদার সমিতি , তৈজষ পত্র ব্যবসায়ী সমিতি, কাপুড়িয়া পট্টি বস্ত্র ব্যবসায়ী সমিতি , বাংলাদেশ জুয়েলারী এসোসিয়েশন খুলনা জেলা শাখা ও খুলনা লবণ মিল মালিক সমিতি। এই ব্যবসায়ী সমিতিগুলো বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।
বড় বাজারের তুলাপট্টির বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো.রফিকুল ইসলাম বলেন, বড় বাজারের রাস্তাগুলো চওড়া করা প্রয়োজন। চলতি শুকনো মৌসুমে যে কোন সময় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। এতে ব্যবসায়ীদের মারত্মক ক্ষতির আশংকা রয়েছে। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সরকার রাজস্ব নিলেও তাদের সহযোগিতায় তেমন কিছু করা হচ্ছেনা।
বড় বাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মো. সুজন মিয়া বলেন, এখন ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। করোনায় যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে অনেক সময়ের প্রয়োজন। প্রতিদিন ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকা হাত বদল হতো। তা এখন অর্ধেকে নেমে আসছে। সামনে রয়েছে হালখাতা। পাওনা টাকা ওঠবে কিনা সন্দেহ রয়েছে।
খুলনা বাজার ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. সোহাগ বলেন, ব্যবসায়ীরা এখন সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে ব্যবসা পরিচালনা করছেন। ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন। সৌহার্দ পূণ্য অবস্থানে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বড় বাজারের হারানো যৌবন ফিরে আসছে। তবে করোনায় ব্যবসায়ীদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে সময় লাগবে। সরকারের ব্যবসায়ীদের প্রতি নজর দেয়া প্রয়োজন।