
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : প্রতি বছর শীত মৌসুমে ওরা ডানায় ভর করে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশে আসে। আবার শীত চলে যাওয়ার পর গরম আসার মুহূর্তে স্বদেশে ফিরে যায়। ওরা আসে সুদূর উত্তর গোলার্ধ থেকে। ওদের কেউ বলেন পরিযায়ী, কেউ বলেন যাযাবর পাখি। কেউ-বা বলেন অতিথি পাখি। আমরা জানি, আমাদের দেশে অতিথি পাখিরা আসে প্রধানত সাইবেরিয়া, উত্তর ইউরোপ, হিমালয় পর্বত ও তিব্বত অঞ্চল থেকে। শীতকালে আমাদের দেশে যেসব অতিথি পাখি আসে সেগুলো হচ্ছে বুনোহাঁস, খঞ্জনা, ওয়ার্বলার, হাড়গিলা, কাদাখোঁচা, বক, সারস, কোকিল প্রভৃতি। এসব অতিথি পাখি আমাদের দেশের ঝোপ-জঙ্গল, মাঠ-ঘাট ও জলাশয়ে বিচরণ করে। কিছু পাখি এসে আশ্রয় নেয় দ্বীপ, সমুদ্র উপকূল, নদীর চর, ছোট-বড় জলাশয় এবং সুন্দরবন অঞ্চলে। অতিথি পাখি অনুকূল পরিবেশের সন্ধানে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়, এমনকি হাজার হাজার মাইল দূরে উড়ে যায়। বিস্ময়ের ব্যাপার, এরা নির্ভুলভাবে দিক নির্ণয় করতে পারে এবং সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে একটুও ভুল করে না।
এসব পাখি কখনও ধনুকের মতো, কখনও ইংরেজি ‘ভি’ অক্ষরের মতো ত্রিকোণাকারে, কখনও একগাছি ফুলের মালার মতো উড়ে চলে দূর থেকে দূরে, বহুদূরে। এরা খেয়াল-খুশিমতো বিভিন্ন দেশে অবস্থান বা বিচরণ করে। এই দূরত্ব কয়েকশ মাইল থেকে কয়েক হাজার মাইল পর্যন্ত হতে পারে। উড়ে চলার সময় বিভিন্ন ভূমিচিহ্ন যেমন নদীনালা, পাহাড়, জঙ্গল প্রভৃতি মনে রেখে এরা দেশান্তরের পথে চলাফেরা করে। পাখিবিদদের মতে, দেহের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে এসব পাখি সহজেই বিভিন্ন অঞ্চলের আবহাওয়ার তারতম্য অনুভব এবং সে অনুযায়ী সেখানে অবস্থান করতে পারে। এক ধরনের অতিথি পাখি আছে, যেগুলোকে রীতিমতো দক্ষ অ্যাথলেট বলা যায়। ‘বার হেডেড গুজ’ বা ‘দাগি রাজহাঁস’ নামের প্রজাতির অতিথি পাখিগুলোকে ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়াও মধ্য এশিয়ার নানা দেশে দেখা যায়। শীতের সময় এ পাখিগুলো মধ্য এশিয়া থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অতিথি হয়ে আসে। বসন্তকালে আবার মধ্য এশিয়ায় চলে যায়। এরা সেখানকার পার্বত্যাঞ্চল ও জলাশয়ে বিচরণ ও প্রজনন করে। এ জন্য এদের সাত হাজার মিটার উঁচু হিমালয় অতিক্রম করতে হয়। এরা অনায়াসে আট ঘণ্টায় বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত হিমালয় পার হতে পারে। এত উঁচুতে বাতাস বেশ হালকা থাকে। তাই অর্ধেক অক্সিজেনে কাজ চালিয়ে নিতে হয় এদের। এটা অবশ্য তাদের জন্য কোনো সমস্যাই নয়।
প্রশ্ন জাগতে পারে, অতিথি হাঁসগুলো কোন কৌশলে কোনো রকম অসুবিধা ছাড়াই এ পথ অতিক্রম করে কীভাবে? পেশির কাজের জন্য প্রয়োজন অক্সিজেন। অক্সিজেন রক্তের লোহিত কণিকার মাধ্যমে বাহিত হয়। দেহের সেল বা কোষে অক্সিজেন থেকে শক্তি সৃষ্টি হয়। গবেষকরা মনে করেন, এ অতিথি পাখিগুলোর পেশির ধমনিতে রয়েছে অনেক রক্ত, যা ভালোভাবে সরবরাহ হয়। তা ছাড়া এদের রক্তের লোহিত কণিকা কিছুটা ভিন্ন ধরনের। এই কণা অক্সিজেন শক্ত করে ধরে রাখতে পারে। এ কারণে পর্যাপ্ত অক্সিজেন পেশিতে আসতে পারে। আর একটা কৌশল হলো, এসব পাখির মাইটোকন্ড্রিয়া রক্তের ধমনির পাশাপাশি থাকে। তাই এরা দ্রুত অক্সিজেন গ্রহণ করে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এভাবে শারীরিক গঠনের দিক দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে বলেই এরা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে উঁচু পথ অতিক্রম করতে পারে।
শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার মিরপুর চিড়িয়াখানা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জলাশয়সহ ভাটি বাংলার অনেক এলাকা অতিথি পাখিতে ভরে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে অতিথি পাখিদের জন্য ভয়ংকর বিপদ ওঁৎ পেতে থাকে। শ্রান্ত ও ক্লান্ত হয়ে এ দেশে নামার সঙ্গে সঙ্গে অনেক পাখির জীবন শিকারির ফাঁদে আটকা পড়ে। এক শ্রেণির মানুষ অসহায় এসব অতিথি পাখি শিকার করে উল্লাসে মেতে ওঠে এবং এদের মাংস ভক্ষণ করে রসনা তৃপ্ত করে। অতিথি পাখি মারা বা ধরা নিষিদ্ধ হলেও আইন অমান্য করে অনেকেই তা প্রকাশ্যে বিক্রি করে। এ জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ জরুরি। অতিথি পাখি আমাদের অনেক উপকার করে থাকে। ওদের মারবেন না। ওদের স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে দিন।
শীতের শুরুতেই পৃথিবীর বিভিন্ন শীতপ্রধান দেশ থেকে কিছুটা উষ্ণতার আশায় হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসে প্রচুর প্রজাতির অতিথি পাখি। কিন্তু কিছু অসাধু চক্রের কারণে প্রতিনিয়ত এসব পাখি নিধন হচ্ছে। পাখি নিধন বন্ধে স্থানীয় প্রশাসন মাঝে-মধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও নিয়মিত মনিটরিংয়ের অভাবে বন্ধ হচ্ছে না পাখি শিকার।
জানা গেছে, কয়রা, পাইকগাছা, দাকোপসহ সুন্দরবনের উপকূলীয় অঞ্চলের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে অবাধে চলছে অতিথি পাখি শিকার। এসব অঞ্চলের বিভিন্ন খাল-বিল, জলাশয় ও চিংড়িঘের থেকে সংঘবদ্ধ শিকারি চক্র ফাঁদে ফেলে প্রতিদিন রাতে শিকার করছে অসংখ্য বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।
পৌরসদর থেকে কয়রা অভিমুখে শিববাটী ব্রিজ পার হয়ে একটু দূরে নির্মাণাধীন কৃষি কলেজের বিপরীতে শামীম হোসেনের ‘ইব্রাহীম গার্ডেন’ নামে বনায়ন প্রকল্প রয়েছে। দিনের শেষে সন্ধ্যার পর থেকে বালিহাঁস, দলকচু, খয়েরী ও দেশীয় বকসহ বিভিন্ন প্রজাতির হাজার হাজার পাখি দল বেঁধে আশ্রয় নেয় সেখানে। অন্যদিকে পৌর মেয়র সেলিম জাহাঙ্গীরের প্রবাসী ভাই শামীম হোসেন পাখিদের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে পাখিদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় গড়ে তুললেও প্রয়োজনের তুলনায় তা একেবারেই অপ্রতুল।
সূত্র জানায়, পাইকগাছা উপজেলার বয়রা, কচুবুনিয়া, বাসাখালী, বাইসারাবাদ, তেঁতুলতলা, লতা, উলুবুনিয়া, পুটিমারী, শংকরদানা, হানিমুনকিয়া, বাহিরবুনিয়া, দেলুটি, সোলাদানা, কপিলমুনি, তালতলা, গোয়ালবাথান, শ্রীফলতলা, প্রতাপকাটি, শামুকপোতা, চকবগুড়া, খড়িয়া, অকাইবাসী, ঠাকুনবাড়ী, আমিরপুর, বাইনবাড়ীয়া, কুমখালী ও পৌরসভার বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে বিভিন্ন এলাকায় বড় বড় খাল-বিল, জলাশয় ও চিংড়ি ঘের রয়েছে। সকাল-সন্ধ্যা বিভিন্ন প্রজাতির এসব অতিথি পাখিরা দলবেঁধে এসব এলাকায় গিয়ে খাদ্য সংগ্রহে নেমে পড়ে। এ সময় সংশ্লিষ্ট ঘের বা জলাশয়ের কর্মচারীদের যোগসাজসে শিকারি চক্র পাখি শিকারে করে।
স্থানীয়রা জানান, এর আগে তারা বিভিন্ন মাছ ও ফড়িং জাতীয় কীট-পতঙ্গে বিষ, ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে রাখতো। কোথাও কোথাও ফাঁদ পেতে রাখা হয়। এভাবে শিকারি চক্র প্রতিদিন পাখি শিকার করে। তবে এখন তারা তথ্য প্রযুক্তির সহায়তাও নিচ্ছে।
সূত্র জানায়, শিকারিরা গুগল থেকে বিভিন্ন প্রজাতির ডাক ডাউনলোড করছে নিজ নিজ মোবাইলে। এরপর রাতের আকাশে পাখিদের আনাগোনা দেখে মোবাইলে ওইসব পাখির ডাক বাজানো শুরু করছে। পাখিরা ওই টোন শুনে মনে করছে তার অন্যান্য সাথীরা সেখানে জড় হতে থাকে। আর শিকাকিদের এই প্রতারণায় প্রলুব্ধ হয়ে নিচে নেমেই ফাঁদে জড়িয়ে পড়ছে। এভাবে প্রতিদিন শিকার হচ্ছে অসংখ্য অতিথি পাখি।
পাইকগাছা উপজেলার বাতিখালী বনায়ন সমিতির অধ্যাপক জিএমএম আজাহারুল ইসলাম জানান, প্রতিবছরের ন্যায় এবারও নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে অতিথি পাখি আসা শুরু হয়। মার্চ-এপ্রিল মাস পর্যন্ত এলাকায় পাখিগুলো অবস্থান করে। এরপর আগতদের মধ্যে বেঁচে থাকারা উড়াল দেয় নিজ দেশে। তবে এদের থাকার জন্য তেমন কোনো নিরাপদ আশ্রয়স্থল বা অভয়াশ্রম না থাকায় শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে হাজার হাজার মাইল দূরে আসা অতিথি পাখিদের অধিকাংশরাই প্রবাসেই নিধন হয়।
তিনি জানান, পাখিরা রাতের চেয়ে দিনের বেলায় বেশি নিরাপত্তাহীন থাকে। বিশেষ করে রাতের নিরাপদ আশ্রয়স্থল থেকে সকালে যখন খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে তখন তারা শিকারিদের কবলে পড়তে হয়। পাখি শিকার বন্ধে প্রশাসনের মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারের পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধির দাবি জানান বনায়ন সমিতির এ নেতা।
এ ব্যাপারে পাইকগাছা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জানান, পাখি শিকার বন্ধে থানা পুলিশ সব সময় তৎপর রয়েছে। পাখি শিকারের ব্যাপারে তথ্য পেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ারও আশ্বাস দেন তিনি। এ বিষয়ে তিনি জনসাধারণের সহযোগিতা কামনা করেন।

