কয়রা(খুলনা) প্রতিনিধি : “ ও বউ ধান ভানি রে, ঢেঁকিতে পাড় দিয়া। ঢেঁকি নাচে আমি নাচি, হেলিয়া-দুলিয়া। ধান ভানিরে”। ঢেঁকির পাড়ে পল্লিবধুদের এমন গান এক সময় গ্রাম-বাংলার গ্রামীণ জনপদে সবার মুখে মুখে থাকত। আর এখনও তো অনেকেই বলে থাকেন ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ঢেঁকিকে নিয়ে গান ও প্রবাদ প্রচলিত থাকলেও ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি আজ বিলুপ্তির পথে। এখন আর গ্রাম বাংলার ঢেঁকিতে ধান ভানার দৃশ্য চোখেই পড়ে না। শোনা যায় না ঢেঁকির ধুপধাপ শব্দ।
তবে কালের বিবর্তনে প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে ঢেঁকি। আর বর্তমানে নতুন প্রজন্মের কাছে “ঢেঁকি ” শব্দটি শুধু অতীতের গল্প মাত্র। বাস্তবে এর দেখা মেলা ভার। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে ২/৪ টি ঢেঁকি থাকলেও ব্যবহার তেমন একটা নেই বললেই চলে। আশির দশক থেকে ক্রমে বিলুপ্তির পথে এই ঢেঁকি।
৬০ বছর বয়সী ফুলি বিবি বলেন, আমাদের সময় অনেক মহিলারা ছিল যারা এ বাড়ি ও বাড়ি ঢেঁকি দিয়ে ধান ভেনে (চ্উাল তৈরি) করে সংসার চালাতো। তাদেরকে বলা হতো ভাড়ানি। এরা মানুষের বাড়ীতে ধান ভেনে দিয়ে চাল আনত। আজ সেসব মহিলারা বেকার। তবে ঢেঁকিতে তৈরি চাল বা চালের গুড়া দিয়ে ভাত রান্না বা পিঠা তৈরি করে খাওয়ার মজাটাই আলাদা। তিনি আরও বলেন, ঢেঁকিতে ধান ভেনে যে চাল হতো, সেই চাল দিয়ে ভাত রান্না করার সময় যে ফ্যান হতো সেই ফ্যান আমরা লবণ, চিনি দিয়ে খাইতাম তখন দুধের মত লাগত। খেত খুব মজা হত। আর এখন ধান কলে ভানাইনির পর চালে ফ্যান হয় না। যা হয় তা পাতলা খাওয়া যায় না এমনকি ভাত তরকারি দিয়ে খাইলেও যেন পানসা পানসা লাগে। কোন স্বাদ নেই। আগে ঢেঁকিতে ভানা চাল দিয়ে ভাত রান্না করলে তা শুধু খাইলেও মিষ্টি লাইগদো। সব চাই বড় কথা সকালে ভোরে ঢেঁকিতে ধান ভানলে শরিরে ব্যায়াম হত। এত রোগ শোক হতো না বিশেষ করে মাজায় ব্যাথা হত না। আর ধান ভানার পর যে কুড়া হত সেই কুড়া ভাল নিবিশ হত যা অনেকেই রান্না করে খেত। কিন্তু এখন কলে ধান ভানার পর সে কুড়া হাস মুরগিতে ও ভাল খায় না। আর আগে ধান ভানা কল পাওয়া যেত না ভবিষ্যৎ এদিকে দেউলির হাট খোলায় আর শইনব্যারি হাট খোলায় দুডো কল ছেল তা টাকা দিয়ে ভানাইতে হতো। আর এটটা কথা আগে ঢেঁকির চালে রন্নার পর ভাতে বাড়ত আর এখন চালে ভাত বাড়ে না। ঢেঁকিতে চাল কুটে পাকান পিঠা বানাতাম ফুলে বড় হতো। খেতে কি স্বাদ। আর এখন চালের গুড়ায় ময়দা না দিলে পিঠা ফোলে না।
ঢেঁকিতে ধান কিভাবে ভানতেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঢেঁকি বড় গাছের কাঠের গুড়ি দিয়ে তৈরি। লম্বায় অন্তত ৫/৬ হাত। এর আগায় মাথার কাছাকাছি দেড় ফুট লম্বা মনাই। মনাইয়ের মাথায় পরানো লোহার রিং। মনাই দিয়ে যেখানে আঘাত করে সেই অংশটুকুর নাম নোট। সেটিও কাঠের তৈরি। ঢেঁকিতে ধান মাড়াই করতে ৩ জন লোক প্রয়োজন হয় পেছনে লেজ বিশিষ্ঠ চ্যাপ্টা অংশে ২ জন পা দিয়ে ভানে আর এক জন নোটে আলি দেয়। প্রথমে পাল্ডা ফেলাই, ২য় বার “দ” করি এবং ৩য় বার কাড়াই শেষ করি। তার পর ঝেড়ে চাল বের করি।
এক সময় গ্রামের প্রায় সব সম্ভান্ত পরিবারেই ঢেঁকি ছিল। ধান ভাঙা কল আমদানির পর গ্রামাঞ্চল থেকে ঢেঁকি বিলীন হওয়া শুরু হয়। ফলে গ্রামের মানুষ ভুলে গেছেন ঢেঁকিছাটা চালের স্বাদ। যান্ত্রিক সভ্যতা গ্রাস করেছে গ্রাম বাংলার ্ঐতিহ্যবাহী কাঠের ঢেঁকিশিল্পকে। যেখানে বসতি সেখানেই ঢেঁকি, কিন্তু আজ তা আমাদের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য থেকে মুছে যাচ্ছে। হাতের কাছে বিভিন্ন যন্ত্র আর প্রযুক্তি সহজলভ্য হওয়ায় ঢেঁকির মত ঐতিহ্যবাহী অনেক কিছুই এখন হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময়ে হয়ত সে সবের দেখা মিলবে কেবল জাদুঘরে।
বাংলার ঐতিহ্যগুলো রক্ষার্থে কাজ করতে হবে সবাইকে। নইলে এক সময় ঐতিহ্য গুলোর স্থান হবে জাদুঘওে এবং তা থাকবে শুধু পুস্তকেই সীমাবদ্ধ। বাংলায় এক সময় ঢেঁকির গুরুত্ব ও কদর ছিল অনেক। বর্তমানে বৈদ্যুতিক বা আধুনিক যন্ত্রপাতির ছোয়াতে তা প্রায় বিলুপ্তির পথে। ঢেঁকির মত অনেক বাঙ্গালি ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তির পথে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মেও জন্য সংরক্ষণ করা উচিত এ ঐতিহ্যগুলো।
কয়রায় বিলুপ্তির পথে গ্রামীণ ঐতিহ্য ঢেঁকি
Leave a comment