
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : পানি ফল, দেখতে সিংড়ার মতো বলে স্থানীয়দের কাছে ফলটি পানি সিংড়া নামেও পরিচিত, খেতেও সুস্বাদু। সেই পানি ফল বা পানি সিংড়া চাষে সাফল্য পেয়েছেন সাতক্ষীরার কলারোয়ার বহু কৃষক। মূলত পতিত জলাবদ্ধ জমিতে এর চাষাবাদে ব্যাপক ফলন পরিলক্ষিত হচ্ছে গত কয়েক বছর ধরে। ফলে সাফল্য পেয়ে এই মৌসুমি পানি ফল চাষে অনেকে যেমন ঝুঁকছেন তেমনি পতিত ও জলাবদ্ধ জমিও কাজে লাগানো যাচ্ছে।
যশোর-সাতক্ষীরা আঞ্চলিক মহাসড়কের দু’ধারে পৌরসদরের গোপিনাথপুর ও যুগিবাড়ির কয়েকশত বিঘা জমি বছরের বেশিরভাগ সময় থাকতো জলাবদ্ধ। ফসল তেমন হতোই না। বাধ্য হয়ে কেউ কেউ ভেড়িবাঁধ দিয়ে মাছ চাষের ঘের তৈরি করেছে। তবে অনেকে সেটাও পারেনি। ফলে বেশির জমি থাকতো অনাবাদী। সেই অনাবাদী ও জলাবদ্ধ জমিতে পানি ফল বা পানি সিংড়া চাষাবাদে সাফল্য পাচ্ছেন প্রান্তিক কৃষকেরা। এখন সেই জলাবদ্ধ পতিত জমিতে শোভা পাচ্ছে পানি ফলের গাছ। প্রতিদিন ভোরে নারী-পুরুষ হাটুপানিতে বা কোমরপানিতে নেমে ফল তুলছেন। দিনভর সেখানে যশোর-সাতক্ষীরা আঞ্চলিক মহাসড়কের ধারে বসে পানি ফল বা পানি সিংড়া বিক্রি করতে দেখা যায়। আর ক্ষুদ্র মৌসুমি ব্যবসায়ীরা ভ্যান, ইজিবাইক বা অন্য যানবাহানে বস্তায় ভরে এই পানি ফল বিক্রির জন্য নিয়ে যান অন্যত্র। এছাড়াও এই পানি ফল বা পানি সিংড়া চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়।
পলাশ, সঞ্জু, সিয়াম, রাসেলসহ অনেকে জানান, উপজেলার পতিত জমিতে পানি ফলের চাষ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। মূলত কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় এ ফল চাষে আগ্রহী হচ্ছেন এখানকার কৃষকরা।
তারা জানান, প্রতি বছর বোরো ধান কাটার পর সেখানকার পতিত জমিতে পানি জমে থাকে। সেই জলাবদ্ধ জমি ও আশপাশের ডোবাসহ খাল-বিলের জমে থাকা পানির মধ্যে এই ফলের লতা রোপণ করা হয়। তিন থেকে সাড়ে তিন মাসের মধ্যে গাছে ফল আসে। এ ফল চাষে সার-কীটনাশকের প্রয়োজন হয় না।
পানি ফল চাষি ওসমান, তৌহিদ, আবুল, কাদের, কবিরসহ কয়েকজন জানান, সরকারি-বেসরকারি খাত থেকে ঋণ সহায়তা পেলে আরো অনেক প্রান্তিক কৃষক পানি ফল চাষের সুযোগ পেতে পারেন। ফলে জলাবদ্ধ ও পতিত জমি আর অনাবাদী থাকবে না, মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতা ও গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হতে পারে।কলারোয়া উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে পানিফল। চলতি মৌসুমে উপজেলার ৩২ হেক্টর জমিতে পানি ফলের চাষ হয়েছে। এই ফলের বাম্পার ফলন হওয়ায় হাসি ফুটেছে চাষীদের মুখে।
স্থানীয়দের কাছে এই ফল ‘পানি সিংড়া’ নামে পরিচিত। পানি ফল বেশ পুষ্টিকর ও সুস্বাদু।
কলারোয়া পৌর সদরের গোপিনাথপুর গ্রামের পানিফল চাষী আজিবার গাজী ও নাঈম হোসেন জানান, ২০০৮ সালে আজিবার নামে এক কৃষক পার্শ্ববর্তী উপজেলা কালিগঞ্জ থেকে বীজ এনে এই ফলের চাষ শুরু করেন। সেই থেকে ১৪ বছর ধরে কলারোয়ার পতিত ও জলাবদ্ধ জমিতে বাণিজ্যিকভাবে পানি ফল চাষ শুরু হয়েছে। কম খরচে অধিক লাভ ও পতিত জমি ব্যবহারের সুযোগ থাকায় কলারোয়া উপজেলায় ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এর চাষাবাদ।
স্থানীয়রা জানান, প্রথমে পানিফলের আবাদ শুরু হয় গোপিনাথপুর গ্রামের আকবর সরদারের জমিতে। এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন, এমনকি বিভিন্ন গ্রামে। বর্তমানে উপজেলার গোপিনাথপুর, তেলকাড়া, গোয়ালচাতর, কুশোডাঙ্গা, মুরারিকাটি ও কেড়াগাছি এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে পানিফল। বাংলা ভাদ্র মাস থেকে আশ্বিন মাস পযন্ত চাষীরা পানিফলের আবাদ করেন। আর বেচাকেনা চলে বাংলা কার্তিক, অগ্রহায়ণ থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত। যশোর সাতক্ষীরা মহাসড়কের কলারোয়া পৌরসদরের গোপিনাথপুর এলাকায় রাস্তার দু’ধারে দেখা মেলে পানি ফলের ক্ষেত। আর মহাসড়কের ধারেই পানিফল বেচতে বসে যান চাষীরা। পাওয়া যায় কলারোয়ার বাজার, বিভিন্ন মোড় ও ফুটপাতেও। বর্তমানে উপজেলার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য জেলায়ও যাচ্ছে কলারোয়ায় উৎপাদিত পানিফল।
লতার মত গাছটির শেকড় নিচে থাকলেও পানির ওপরে ভেসে থাকে পাতাগুলো। অনেকটা কচুরিপানার মতো। আর ফলগুলোতে দুটি শিং-এর মত কাঁটা থাকে, তাই স্থানীয়দের কাছে এটি পানি সিংড়া নামে পরিচিত। ফলগুলো দেখতে সবুজ ও লাল হয়। খোসা ছাড়ালে বেরিয়ে আসে সাদা মিষ্টি সুস্বাদু আশ।
পৌর সদরের আয়জুল ও লাভলু, তাহিদুর রহমান, নাঈম ,ওসমান গনিসহ কয়েকজন চাষী জানান, জলাবদ্ধ জমিতে পানিফলের চাষাবাদ করা হয়। প্রতি বিঘা জমিতে পানিফল আবাদে ১২-১৫ হাজার টাকা খরচ হয়, আর ফল বিক্রি হয় প্রায় ৩৫-৪০ হাজার টাকার। এর চাষাবাদ বেশ লাভজনক।
তারা জানান, গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রতি কেজি পানিফল ৪০-৪৫ টাকা দরে পাইকারী বিক্রি হয়। আর খুচরা বিক্রয় হয় ৫৫ টাকা দরে। দেশের অন্যান্য জেলায় পানিফলের চাষাবাদ হয় না। তাই মানুষ কম চেনে। কিন্তু স¤প্রতি সাতক্ষীরা জেলার কলারোয়া উপজেলা থেকে এই ফল যশোর, ঢাকা, মানিকগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা, বগুড়া, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে কলারোয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শুভ্রাংশ শেখর দাস বলেন, মৌসুমী ফল হলেও পানিফলের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। এতে অনেক পতিত জমির ব্যবহার যেমন নিশ্চিত হচ্ছে, তেমনি কর্মসংস্থানও হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে পানিফল চাষে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শুভ্রাংশু শেখর দাস জানান, পানি ফল সম্ভাবনাময় ফসল। এটি বর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। উপজেলায় চলতি বছর প্রায় ৩৮ হেক্টর পতিত জমিতে পানিফল চাষ হয়েছে। পানিফলের পুষ্টির মান অনেক বেশি।
তিনি আরো জানান, যেকোনো পতিত পুকুর, ডোবা অথবা জলাশয়ে পানি ফল চাষ করা সম্ভব। এর উৎপাদন খরচও কম।

